এবার টেকনাফের ওপারে গোলাগুলি

নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর। এপারে টেকনাফ
নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর। এপারে টেকনাফছবি: প্রথম আলো

মিয়ানমারের রাখাইনে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এত দিন বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। এবার টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গোলাগুলি বেড়েছে। গুলির বিকট শব্দে যেন কেঁপে উঠছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও দ্বীপ ইউনিয়ন সেন্ট মার্টিন। এ কারণে সেখানকার বাসিন্দারা ভয়ে আছেন। ভীতিকর পরিস্থিতিতে গত দুই দিনে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

অপর দিকে টেকনাফের ওপারে গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ায় সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা এপারে আসতে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের মংডু শহরের আশপাশের এলাকাগুলোতে সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। তবে অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।

২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। ৫ ফেব্রুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সংঘর্ষ চলাকালে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ সে দেশের ৩৩০ জন এ দেশে ঢুকে পড়েন। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে তাঁদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কাঁপল টেকনাফ সীমান্ত

টেকনাফ উপজেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে বৃহস্পতিবার রাতভর থেমে থেমে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে। গতকাল শুক্রবার সকালে দুটি বিকট শব্দে এপারের মাটি কেঁপে ওঠে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টা ও বেলা ২টায় আরও চারটি বিকট শব্দ শুনতে পান বাসিন্দারা।

এর আগে বুধবার ভোর ৪টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত টেকনাফের দক্ষিণাংশের ওপারে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। ধোঁয়া উড়তেও দেখা যায় কয়েকটি স্থানে।

টেকনাফের দক্ষিণাংশে থাকা সেন্ট মার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে গতকাল কথা বলে জানা গেছে, প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙেছে। শাহপরীর দ্বীপের ওপারে মিয়ানমারের মংডুর হাসুরাতায় গতকাল সকালে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন তাঁরা। শাহপরীর দ্বীপের বাজারপাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, মিয়ানমারে রাতভর থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে।

সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। দূর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। গতকাল সকালে দুটি বিকট শব্দ পাওয়া গেছে।

এমন অবস্থায় আতঙ্কে রয়েছেন টেকনাফ সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুস সালাম বলেন, রাতভর থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন তাঁরা। এ জন্য স্থানীয় লোকজন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

এই জনপ্রতিনিধি বলেন, নাফ নদীর পূর্ব ও দক্ষিণাংশে রাখাইন রাজ্য। যেসব স্থান থেকে গুলির আওয়াজ আসছে, সেখানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশপাশের মেগিচং, কাদিরবিল, নুরুল্লাহপাড়া, মাংগালা, ফাদংচা ও হাসুরাতা এলাকা অবস্থিত। এসব এলাকায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির কয়েকটি চৌকি (ক্যাম্প) রয়েছে।

টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুস সালাম

এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহি উদ্দিন আহমেদ বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে দুটি গ্রুপের মধ্যে থেমে থেমে রাতভর গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন সীমান্তে থাকা বিজিবির সদস্যরা। সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।

নতুন করে সেখানে সংঘাত শুরু হলে মংডু শহরে থাকা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারে। তাই বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সীমান্তে কড়া পাহারায় থাকতে হবে, এমন মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) টেকনাফ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবুল হোসেন।

পর্যটনের ভরা মৌসুমে সীমান্তে অস্থির পরিস্থিতির কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে বন্ধ রয়েছে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল। বুধবার সকালে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাটে।
পর্যটনের ভরা মৌসুমে সীমান্তে অস্থির পরিস্থিতির কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে বন্ধ রয়েছে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল। বুধবার সকালে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাটে।ছবি: জুয়েল শীল

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা দলে দলে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিল। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে কেউ যাতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমার থেকে অস্ত্র নিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘মিয়ানমার থেকে অস্ত্র নিয়ে কাউকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। পরিত্যক্ত কিছু অস্ত্র নিয়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কিছু সদস্য এখানে আসতে পারে। তারা সবাই ধরা পড়েছে। বিজিবি সবাইকে আটক করেছে। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমাদের বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অস্ত্র নিয়ে ঢোকার অবস্থা নেই।’

গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুরো মিয়ানমারে শুধু আরাকান আর্মি নয়, অনেকগুলো বিদ্রোহী গ্রুপ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। আরাকান আর্মি বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের এ অঞ্চলে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধের কারণে এ অঞ্চলে কিছু গোলাগুলির শব্দ আসছে। আমরা বিজিবির ফোর্স বাড়িয়েছি। কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশ সজাগ রয়েছে।’

সেন্ট মার্টিনে পর্যটক নেমেছে অর্ধেকে

মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। নিরাপত্তার স্বার্থে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। বর্তমানে সেন্ট মার্টিন-কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন-চট্টগ্রাম নৌপথে পর্যটক চলাচল চালু রয়েছে। কিন্তু তিন দিন ধরে সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ বেশি আসায় পর্যটকেরা আসছেন কম।

চট্টগ্রাম থেকে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আসেন প্রবাসী ব্যবসায়ী আবু আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে খবর পেয়ে সেন্ট মার্টিন যাত্রা বাতিল করেছেন।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দা রয়েছেন প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। এর মধ্যে বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্টের কর্মচারী রয়েছেন তিন হাজারের মতো। দ্বীপে ২৪০টির বেশি হোটেল, মোটেল, কটেজ, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ (খাবার হোটেল) রয়েছে। দ্বীপের অধিকাংশ হোটেলের কক্ষ খালি পড়ে রয়েছে। এখানকার বাসিন্দারাও পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাহাজমালিকেরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কে জানে!

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে ১২টি জাহাজ চলাচল করত। ১৪ হাজার পর্যটক আসত প্রতিদিন। টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন জাহাজ বন্ধ থাকা এবং অতি সম্প্রতি গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ায় পর্যটক অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থা কত দিন থাকবে আমরা জানি না।’

প্রথম আলো