দেশের আইনজীবীদের অন্যতম সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৪-২৫) নির্বাচনে দুদিন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হলেও গণনা নিয়ে হট্টগোল ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে ভোট গণনা করা হয়নি। আজ শুক্রবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ব্যালট সিলগালা অবস্থায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হয় গত বুধবার ও গতকাল বৃহস্পতিবার। ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়। তবে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে আজ শুক্রবার ভোরে সমিতি মিলনায়তনে হট্টগোল, বাদানুবাদ ও মারধরের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতেই ভোট গণনা করা হবে কি না, এ নিয়ে কয়েকজন প্রার্থীর মধ্যে মতবিরোধের জের ধরে হট্টগোল ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন।
নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়েরের বক্তব্যের একটি ভিডিও ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, সমিতির মিলনায়তনে তিনি বলেছেন, ‘শুধুমাত্র নাহিদ সুলতানা (যুথী) সম্পাদক প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। তাই তাঁকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো।’
অবশ্য আবুল খায়ের আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট গণনা হয়নি। ব্যালট সিলগালা অবস্থায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
তবে নাহিদ সুলতানা আজ সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপকমিটির আহ্বায়ক আবুল খায়ের সকালে সমিতির সম্পাদক হিসেবে আমাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন। সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ।’
আর সাদা প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত উপকমিটি ভোট গণনা করতে সক্ষম হয়নি। শনিবার ভোট গণনা হতে পারে।’
এ সবই গত দুই বছরের ‘নাটকের ধারাবাহিকতা’ বলে মন্তব্য করেছেন নীল প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস। তিনি সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে তো নির্বাচন উপ কমিটির প্রধান সম্পাদক পদে ফলাফল ঘোষণা করেছেন। ব্যালট বাক্স বহিরাগতরা সমিতির বাইরে নিয়ে গেছে। এখন হয়তো আবারও নাম ঘোষণা হতে পারে। এ সবই নিজেদের মত নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করার নাটক মাত্র।
বহিরাগতদের উপস্থিতি, হট্টগোল ও মারধর
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ শেষে সমিতি মিলনায়তনে ভোট বাছাই প্রক্রিয়া শেষ হয় রাত দুইটার পর। এর আগে কোনো কোনো প্রার্থী ব্যালটের সঙ্গে মুড়ির মিল না থাকার কথা উল্লেখ করে আপত্তি তোলেন। পরে ভোট গণনা শুরু করা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এর আগে থেকে অর্থাৎ সন্ধ্যার পরপরই সমিতি ভবনের বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের অবস্থান করতে দেখা যায়। সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানা ও বিএনপি–সমর্থিত নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন রাতেই ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। তবে এত রাতে প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকার কথা উল্লেখ করে সাদা প্যানেলের সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হকসহ কয়েকজন প্রার্থী শুক্রবার (আজ) দিনের বেলায় ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়।
উপস্থিত একাধিক আইনজীবী জানান, বাছাইপ্রক্রিয়ার পর একপর্যায়ে উপকমিটির আহ্বায়কের কাছ থেকে একজন প্রার্থীর সমর্থক মাইক্রোফোন কেড়ে নেন। পরে কমিটির অপর একজন সদস্য তা আহ্বায়কের কাছে ফিরিয়ে দেন। একপর্যায়ে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ব্যালটগুলো সিলগালা করে রাখা হবে। শুক্রবার দুপুরের পর ভোট গণনা হবে। তবে শুক্রবার ভোট গণনা নিয়ে আপত্তি জানান একাধিক প্রার্থী। শুক্রবার ভোরের দিকে উপস্থিত একজন আইনজীবী মিলনায়তন থেকে বের হওয়ার ফটক খুলে দিতে গেলে তাতে আপত্তি জানান উপকমিটির একজন সদস্য। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তি সমিতি মিলনায়তনে ঢুকে পড়েন। তাঁরা নির্বাচন পরিচালনা–সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফের ওপর চড়াও হন। এ সময় মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে আরও কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মারধরের ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।
এস আর সিদ্দিকী জানান, তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন। এ জন্য একজন প্রার্থীর সমর্থককে দায়ী করেন তিনি।
নিন্দা ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি
সমিতির নির্বাচনে ভোট গণনার সময় হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি মো. ইয়াহিয়া ও সাধারণ সম্পাদক হাসান তারিক চৌধুরী শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভোট গণনার সময় এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও ন্যক্কারজনক। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
সমিতির নির্বাচনের তফসিল অনুসারে, ৬ ও ৭ মার্চ ভোট গ্রহণ হয়। নির্বাচনে ৭ হাজার ৮৮৩ জন ভোটারের মধ্যে ৫ হাজার ৩১৯ জন ভোট দেন। সভাপতি, সহসভাপতি (দুটি), সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদক (দুটি), সদস্য ৭টিসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এ নির্বাচন হয়ে থাকে। ১৪টি পদের বিপরীতে এবার নির্বাচনে ৩৩ জন প্রার্থী হন।
সাধারণ আইনজীবীদের ভাষ্য, সমিতির নির্বাচনে বরাবরই মূলত দুটি প্যানেলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ মনোনীত প্যানেল (সাদা হিসেবে পরিচিত)। অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল হিসেবে পরিচিত)। এই প্যানেল থেকে সভাপতি পদে এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও সম্পাদক পদে মো. রুহুল কুদ্দুস নির্বাচনে অংশ নেন। অন্যদিকে সাদা প্যানেল থেকে সভাপতি পদে আবু সাঈদ সাগর ও সম্পাদক পদে শাহ মঞ্জুরুল হক নির্বাচনে অংশ নেন। এর বাইরে সভাপতি পদে আরও দুজন, সম্পাদক পদে দুজন এবং কোষাধ্যক্ষ পদে একজন প্রার্থী হন। এর মধ্যে ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া ও নাহিদ সুলতানা সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন।
সমিতির গত নির্বাচনে (২০২৩-২৪) উপকমিটির আহ্বায়ক নিয়ে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের আপত্তি এবং এর জের ধরে ভোটের দিনই ভাঙচুর, হট্টগোল ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছিল।
Prothom alo