গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন বলা যাবে না। এটা একটা তামাশা। পুরো দেশবাসীর সঙ্গে তামাশা এটি। সংজ্ঞা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনটি কোনো নির্বাচনের মধ্যে পড়ে না উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, আইনি দিক থেকে এটাকে তারা নির্বাচনের কথা বললেও নৈতিক দিক থেকে এটা কোনো নির্বাচন নয়। নির্বাচনের সংজ্ঞা অনুযায়ী আইনি যে বাধ্যবাধকতা, সেটা মানলেও এটা কোনো নির্বাচন নয়।
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের যে সংজ্ঞা সেটা অনুযায়ী যেকোনো দেশের শাসননীতি হওয়ার কথা জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে। একটা সত্যিকারের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটবে। একটি প্রকৃত বা সত্যিকারের ইলেকশনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বী তারা সকলেই সেখানে অবাধে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। যারা ভোটার তারা ঠিকমতো ভোট প্রয়োগ করতে পারবে। তাদের ভোট অনুযায়ীই ফলাফল নির্ধারিত হবে। এইসব বিষয়গুলো নিয়েই একটি নির্বাচন।
এর কোনো একটি অংশ বাদ গেলে তখন আর সেটি নির্বাচন থাকে না। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে সরকার রয়েছে, সেখানে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠেছে। এমন ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য কারও জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এরকম একটি ব্যবস্থা আমরা ২০১৮তে দেখেছি। শাসক দল এখানে ঠিক করে দিচ্ছে কোন আসনে কোন দল জয়ী হবে। এই যে একটি কর্তৃত্ববাদী মডেল বানানো হয়েছে, এই মডেলেই তারা এখানে নির্বাচন করতে চায়।
বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম দলগুলো, ইসলামী দলগুলোসহ আরও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল, যার সংখ্যা ৬৩ তারা কেউ নির্বাচনে যাচ্ছে না। সবাই নির্বাচনটি বয়কট করেছে। তারপরেও সরকার বলছে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করবে। কিন্তু তাদের জোট বা মিত্ররা, যাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য তারা কেউই সরকারের কথায় ভরসা রাখছে না। এর ফলে তারা সরকারের কাছে আসন সমঝোতার দাবি তুলেছে। বর্তমান জনসম্মতিহীন সরকারের যে সংসদ রয়েছে সেখানকার যে বিরোধী দল রয়েছে জাতীয় পার্টি, বলা হচ্ছে আগামী সংসদেও তাদের বিরোধী দল বানানো হবে। সেই জাতীয় পার্টির যে চেয়ারম্যান তিনি পর্যন্ত বললেন, ভিক্ষার সিট নিয়ে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তারপরেই আমরা দেখলাম ২৬টি আসনে সমঝোতা করে তার দল নির্বাচনে যাওয়ার কথা বললো। সেটা হয়তো তিনি দেশি-বিদেশি নানা চাপে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ, একটি বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না নেয়ার যে স্বাধীনতা সেটা পর্যন্ত এখানে নেই।
ভোটের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, সরকার এখন এমন একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা তৈরি করছে, যার মাধ্যমে বিরোধী যারা রাজনৈতিক দল আছে, যারা নির্বাচনে যাচ্ছে তাদের ভিক্ষার সিট দিতে চায়। এটা করে ক্ষমতাসীন দল আবারো ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। এটা কোনো নির্বাচন হতে পারে না। যে নির্বাচনের আগেই মানুষ জেনে যাচ্ছে- কে জয়ী হবেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটা কোনো নির্বাচন নয়। নির্বাচন মানে কেবল ব্যালটে একটি সিল দেয়া নয়। ভোট দেয়া মানে হচ্ছে নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হবে। ভোট হবে নির্ণায়ক। নাগরিকরা যে রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি- এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটিকে অকার্যকর করা হয়েছে। এরফলে রাষ্ট্র নিজেও ঝুঁকিতে পড়ছে। নাগরিকরাও বিপদে পড়ছে। তাই আগামী ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনকে নির্বাচন বলা যায় না। যে নির্বাচনের ফলাফল, জয়-পরাজয় পূর্ব নির্ধারিত সেটি নির্বাচন নয়।
ক্ষমতাসীন দল নিজেদের দলের কয়েকজনকে স্বতন্ত্র আবার কয়েকজনকে ডামি দাঁড় করিয়ে দিয়ে একটি নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাচ্ছে। এটা আসলে একটি ডামি নির্বাচন। যে প্রক্রিয়ায় দেখা যাবে- নৌকা জিতলে নৌকার জয় হবে। আবার স্বতন্ত্র জিতলেও নৌকারই জয় হবে। এমন একটি নির্বাচনে মানুষের কোনো আগ্রহ নেই।
বাংলাদেশে যে চারটি নির্বাচন মানুষের কাছে তুলনামূলক গ্রগণযোগ্য হয়েছিল-১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। ৯১ সালে ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৯৬ সালে ৭৪ শতাংশ, ২০০১ সালে ৭৫ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৮৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিল। যখন সত্যিকারের বিরোধী দল অংশ নেয়, তখন দেখা যাচ্ছে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে যায়। বিপরীতে এই সরকারের আমলে আমরা যে নির্বাচন দেখেছি মানুষ ৫ শতাংশ ভোট দিয়েছে। তারা সেটাকে ১১ শতাংশ, ২০ শতাংশ ভোট দেখিয়েছে। এইবার অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন ৭০ শতাংশ মানুষ নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য বসে আছেন। এতে করে বোঝা যাচ্ছে, তারা কতো শতাংশ ভোট দেখাতে চায়। এখন একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা যদি বলে দেন, অমুক প্রার্থী জয়লাভ করেছেন, অমুক প্রার্থী নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন তাহলে এটা চ্যালেঞ্চ করবে কে? এখানে সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। এখানে গণমাধ্যম সংকুচিত, প্রশাসন দলীয়। এমনকি এখানে ন্যায়বিচারও পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন একটি পরিস্থিতিতে যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে নির্বাচন নয়; এটা আসলে ক্ষমতার লাইসেন্স নবায়ন করা। এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করার জন্য বিরোধী দলের প্রতি সর্বোচ্চ দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। এই যে দমন ও নির্যাতন করা হচ্ছে- এটা কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারাই আবার বলছেন। সরকারে থাকা কৃষিমন্ত্রী একইসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও বটে। তিনি বলে দিচ্ছেন- বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের এইভাবে আটক করা না হলে হরতালে গাড়ি চালানো সম্ভব হতো না! তিনি এটাও বলেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের একরাতের মধ্যে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। বিএনপি ছাড়াও আন্দোলনরত সকল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর একইভাবে হামলা-মামলা দিয়ে আটক করার ঘটনা ও দমন করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা ও আটকের ঘটনাগুলো সাজানো তা বুঝতে হলে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নৌকার প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে থাকা শাজাহান ওমরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একই মামলায় বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে থাকলেও শাজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ায় মুক্তি পেয়ে গেলেন। কৃষিমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, একরাতের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে, এই কথায় পরিষ্কার যে দেশের বিচারব্যবস্থা আইন-আদালত কোনো কিছুই স্বাভাবিক বা নিয়মতান্ত্রিক নেই।
তিনি বলেন, এমন একটি বাস্তবতায় এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের জন্য যে কতোটা রাজনৈতিক পরাজয়, সেটাও তারা অনুধাবন করতে পারছেন না। এই তফসিলটি মানুষের ভোটাধিকার হরণের কাজ করছে। ফলে আমরা মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য এই ভোট ও নির্বাচনকে বর্জন করছি।
আন্দোলনে কতোটা আশাবাদী জানতে চাইলে জোনাইদ সাকি বলেন, আমরা জনগণের শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ঐতিহ্য সে ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। প্রবল চাপ প্রয়োগ, ভয়ভীতি ও দমনপীড়ন যেভাবে চলছে, সেখানে মানুষের কোনো রাজনৈতিক পরিসর নেই। আন্দোলন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশের যে আন্দোলনের সংগ্রামের ইতিহাস বিপুলসংখ্যক মানুষকে রাজপথে নামিয়ে আনা, আমরা সেটার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অতীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবে কোনো আমলে মানুষের প্রতি দমনপীড়ন আটক চলেনি। গণতন্ত্রের লেবাসে এমন দমনপীড়ন আগে চলেনি। ফলে জনগণ এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কীভাবে রাস্তায় নামবে সে পথটি তৈরি করতে হবে। আমরা আশাবাদী যে দেশের মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাজপথে নামবে। তবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনগণ এই সরকারের পাতানো নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে না।
মানব জমিন