মানুষ, নাকি অ্যান্টি মানুষ?

মিনা ফারাহ

অ্যান্টি মানুষ হওয়া কঠিন কারণ মনুষ্যত্ব ত্যাগ করা সবচেয়ে কঠিন। আমাদের চার পাশে অ্যান্টি ট্রাম্প, অ্যান্টি মুসলিম, অ্যান্টি জায়ন… কোনোটাই নয় বরং অ্যান্টি মানুষদের বিস্ফোরণ। এরা নিজেদের সমালোচনা করে না বরং অন্যের খুঁত খুঁজে বেড়ানোই স্বভাব। এখন তুঙ্গে অ্যান্টি ট্রাম্প সোপ-অপেরা কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প কি শুধু একজনই?

যখন এ দেশে এলাম, অ্যান্টি মুসলিম সেন্টিমেন্ট কম ছিল না, তবুও কাউকেই বিচ্ছিন্ন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রাস্তায় হইচই করতে দেখিনি। আত্মসমালোচনা না করে বরং এভাবে বিদেশীদের সামনে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরে উপকার করছি, না অপকার? আইএসের ঘটনা গুজব নয়। বাস্তবে ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশ, ট্রাম্পের বক্তব্যে উত্তেজিত বেশির ভাগেরই শরীরজুড়ে লাখ বিষফোঁড়া। ১৯৬৫ সালের আগে ইমিগ্রেশন পলিসি ছিল পুরোপুরি প্রো-খ্রিষ্টান ও আগতদের ৯০ শতাংশই খ্রিষ্টান। বিশেষ করে প্রো-খ্রিষ্টান আইনের কারণে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার কথা ভাবাই যেত না। ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের আন্দোলনের প্রভাব না পড়লে কী হতো, কেউ জানে না। ১৯৬৫ সালে ব্যাপক সংস্কারের পর বিশেষ করে মুসলিমদের আগমনের কারণে এখন রয়েছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম। আরব দেশগুলোর যুদ্ধাবস্থার কারণে বহু রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর ভাগ্য পরিবর্তন ঘটল এভাবেই। সুতরাং ছোট-বড়-মাঝারি সব ট্রাম্পেরই সমালোচনা চাই।

কৃষকের ক্ষেতে মড়ক লাগলে গরু-ছাগলের পোয়াবারো। ট্রাম্পের অ্যান্টি মুসলিম বক্তব্যও সে ধরনেরই। এটি ব্যবহার করে প্রচণ্ড শ্রেণিবিভাজন ও ঘৃণা ছড়াতে যারাই তৎপর, ওরা নিজেদেরকেই আলাদা করছে বিপজ্জনক হারে। অথচ অনেকেরই নিজের দেশে মানবাধিকারের কুৎসিত চেহারা, এই দেশে তারাই বিরাট অ্যাক্টিভিস্ট। এখন অ্যান্টি ট্রাম্প কিন্তু নিজ দেশের অ্যান্টি মুসলিম-অ্যান্টি সংখ্যালঘু অবস্থানের বিরুদ্ধে নীরব।

শিয়া-সুন্নির জায়ন আচরণের জন্য দায়ী আসলে ইসরাইল নয়; বরং সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য খাল কেটে কুমির আনল নিজেরাই। ফিলিস্তিনিদের ওপর মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করেনি এমনকি মোসাদ বাহিনীও। মধ্যপ্রাচ্যকে বিধ্বস্ত করা থেকে আইএস উদ্ভাবন… শতভাগ দায়ী শিয়া-সুন্নির বিভক্তি। পণ্ডিত সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো দ্য রিপাবলিক বইয়ে জাতীয় সরকারের কথা লিখেছিলেন প্রায় চার হাজার বছর আগে। বলেছিলেন, সর্বস্তরের শ্রেষ্ঠদের নিয়ে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা। অথচ বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আছে অ্যান্টি মানুষেরা। যেসব বাংলাদেশী অ্যান্টি ট্রাম্প বক্তব্য দিয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন, তারা নিজ দেশের ট্রাম্পদের বিরুদ্ধে একদমই নীরব।

ভুয়া অ্যাক্টিভিস্টদের অ্যান্টি ট্রাম্প বক্তব্য আমাকে মোটেও বিমোহিত না করার পক্ষে যুক্তি প্রচুর। প্রায় ৫৫টি মুসলিমপ্রধান দেশের বেশির ভাগই নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজেরাই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। যে কাজগুলো হয়তো ট্রাম্পের পক্ষে শোভা পায়, ওই কাজগুলোই নিজেরা করছে; অন্যতম দৃষ্টান্ত চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিরোধী দলের ওপর জায়ন আচরণ ছাড়াও জোটে যোগ দিয়ে যখন বোমা ফেলবে, মরবে কি শুধুই দুষ্টরা?


নিজের সমালোচনা কখনোই করব না কিন্তু অন্যের ক্যান্সারের লেজ ধরে ২৪ ঘণ্টাই টানাটানি করব। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একজন অ্যান্টি ট্রাম্প বাংলাদেশী এমপির বক্তব্য আমাকে বিস্মিত করেনি। কারণ এটাই তাদের পারিবারিক চরিত্র। অ্যান্টি ট্রাম্প সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাহবা পাওয়া সহজ কিন্তু সাড়ে সাত বছর যা করছে বাংলাদেশে, ট্রাম্পের অ্যান্টি মুসলিমইজম এর চেয়ে বেশি না কম? শিয়া-সুন্নির বাস্তবতা না থাকা সত্ত্বেও ২০ দলের বিরুদ্ধে না থাকা অনেকটা আচরণ কি মিথ্যা? বিরোধীদলীয় জোটের বিরুদ্ধে একটি দলের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডগুলো টেবিল চাপড়ে আর লুকিয়ে রাখা যাবে না।

বাংলাদেশের অ্যান্টি সংখ্যালঘু বাস্তবতা কত লিখব! ৬৮ বছর ধরে নির্যাতনের জন্য যারাই দায়ী প্রত্যেকেই ক্ষমতায় ছিল। তাদের ইতিহাস যদি প্রচণ্ড অ্যান্টি সংখ্যালঘু না হয়- তাহলে কার? উদাহরণস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ভারতের মুসলমানেরা ৮ শতাংশ থেকে এখন প্রায় ২৩ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ৩২ শতাংশ থেকে কমে প্রায় ৭ শতাংশ হওয়া কি গুজব? অথচ ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ (সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু পর্যন্ত), শুধু ছয় বছর বাদে বাকি ৬৩ বছরই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ক্ষমতা বাঙালি মুসলমানদেরই হাতে। বারবারই খান সাহেবদের অ্যান্টি ভারত অবস্থানের সুযোগ নিয়েছিল সেদিনের আওয়ামী লীগ। এক হাজার ৮০০ মাইল দূরত্বে বসে অ্যান্টি সংখ্যালঘু কর্মকাণ্ড চালানো অসম্ভব। এক আনা জমিও সাথে নিতে পারেনি বরং ইসলামাবাদের কাছে ১৮ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাওনা থাকলে, প্রফেসর আবুল বারকাতের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের জিডিপির ৭০ শতাংশই বাংলাদেশী সংখ্যালঘুদের পাওনা। বাঙালিরাই প্রতিটি যুদ্ধ-দাঙ্গায় ব্যাপক হারে লাভবান সত্ত্বেও এখন প্রত্যেকেই বেড়াল বৈরাগী। সে দিনের মুসলিম লীগের বাঙালির বংশধররাই এখন বিভিন্ন দলে। সমালোচনার জন্য শুধু ট্রাম্পকেই বেছে নিলে চলবে কি? ৪৬ নোয়াখালী কিংবা ৬৪-এর পানাম সিটি… দাঙ্গার চেহারা, দেশত্যাগীর সংখ্যা, শত্র“সম্পত্তি দখল ইত্যাদি ঐতিহাসিক সত্য।

বাংলাদেশী ট্রাম্পদের সমালোচক খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। দুইটি বড় যুদ্ধ, বারবার দাঙ্গা, ’৭১ সালে রিফিউজি, ’৮০ সালে ইমিগ্রান্ট- আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরা। চোখের সামনে সংখ্যালঘুশূন্য হয়ে গেল পাড়া, স্কুল ও প্রতিষ্ঠান। দেশজুড়ে শত্র“সম্পত্তির নামে এমনকি মন্দিরগুলোও দখল। বরং দেখছি ধর্মনিরপেক্ষতার অজুহাতে অ্যান্টি ২০ দল সেন্টিমেন্ট তৈরি করে, সংখ্যালঘুদেরকে আরো আগুনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ভুয়া বিবেকানন্দরা। দলের সাইজ অনুযায়ী অর্পিত সম্পত্তি দখলের পাশাপাশি, ধর্মনিরপেক্ষতার কামান দাগিয়ে ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পদ্ধতিও চালু রয়েছে। শত্র“সম্পত্তি বিলুপ্ত না হয়ে ‘অর্পিত’ সম্পত্তি হয়েছে এবং সংখ্যালঘুদেরকে নীরব থাকতে বাধ্য করেছেন রাজনীতিবিদেরাই। ‘লজ্জা’ বইকে কেন্দ্র করে বিজেপির বাধানো ’৯২ সালের দাঙ্গা এবং লীগের বাধানো রামু-উখিয়ার ঘটনাগুলোও বাঁচিয়ে রাখছেন রাজনীতিবিদেরাই। সাল ছাড়া, ’৪৬ সালের দাঙ্গার সাথে ’৬৪ সালের পার্থক্য কী? সুতরাং বাংলাদেশী যারাই অ্যান্টি ট্রাম্প ধুয়া তুলল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, বলব, আগে ঘরের ট্রাম্পদের সামলান। পরিবারের অ্যান্টি মানুষদেরও সমালোচনা করুন। সুরঞ্জিতবাবু কিংবা সি আর দত্তের মতো নেতা আর অন্ধের চোখে ছানি কাটা ডাক্তার এক। একা বিশ্বজিৎ এবং ফেলানী হত্যাকাণ্ড- নব্য জায়নবাদের মিউজিয়াম। ভুয়া অ্যাক্টিভিস্টদের জায়গা আঁস্তাকুড়ে।

সংখ্যালঘু পরিবারে জন্ম, বিয়ে অন্য ধর্মে… অ্যান্টি মুসলিম বা অ্যান্টি হিন্দু কোনোটাই নয় বরং যা দেখছি সেটাই বলছি। স্বর্গীয় বাবাকে দেখেছি একজন প্রতিবাদী হিন্দু নেতার চরিত্রে- যে কারণে ’৬৪, ’৬৫, ’৭১ সালে বহু মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে। এমনকি ১৯৬৫ সালে আমাদের বাড়িটিও দখল করার মতো মানুষের অভাব ছিল না। রমনা কালী মন্দিরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জায়ন আচরণের ৪৩ বছর এটা। ক, খ, গ, ঘ… রকমারি তফসিলের মাধ্যমে নির্যাতন চলছে, চলবে। সুতরাং যারাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গলার রগ ফুলিয়ে অ্যান্টি ট্রাম্প বক্তব্য দিয়ে টেবিল চাপড়ে ভেঙে ফেলছেন, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হলে বলব- আগে ঘরের ট্রাম্পদের সামলান পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প।


প্রেসিডেন্ট যেই হন- অ্যান্টি ট্রাম্প, অ্যান্টি গান্ধী কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং মার্কিন সংবিধানের প্রথম আইনটি সবাইকে রক্ষা করবে। আমার আপত্তি অন্যখানে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকলে, ধর্মনিরপেক্ষ হয় কী করে? সিদ্দিকীকে বলছি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই প্রশ্নগুলো তুললে খুব খুশি হতাম। যে মুহূর্তে নিহত ব্লগার দীপনের প্রফেসর পিতা রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সংঘর্ষ নিয়ে আদর্শের প্রশ্ন তুললেন, সেই মুহূর্তেই তার প্রতিবাদী কণ্ঠ মিডিয়া থেকে হাওয়া! ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেখলাম, কোনো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপির মুখে ট্রাম্পের ব্রিটেনে প্রবেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দাবি। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী দেশী ডোনাল্ড ট্রাম্পরাই।

মানতেই হবে, মুসলিমদের অ্যান্টি মুসলিম কর্মকাণ্ডের ফসল, ইরাক-ইরান-সিরিয়া… লাগাতার যুদ্ধ। ইউরোপে রিফিউজিদের মধ্যে, কয়জন অমুসলিম? এ জন্য দায়ী জায়নিস্ট কিংবা ট্রাম্প সমর্থকেরা নয়। আত্মসমালোচনা চাই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই শিয়া-সুন্নির বিভক্তি, সাম্রাজ্যবাদীদের অক্সিজেন। অন্যথায় যা হচ্ছে, পারত না। আট বছর ইরাক-ইরান যুদ্ধ এবং সাদ্দামের মাস্টার্ড গ্যাসে প্রায় ১০ হাজার শিয়া হত্যা পাঠ্যপুস্তকে। আইএস উৎপত্তির পেছনে শিয়া-সুন্নি বিরোধের ভূমিকা। আয়াতুল্লাহর দাবি অনুযায়ী মার্কিন সৈন্যদেরকে ইরাক ছাড়তে হয়েছে। সুন্নি সৈন্যরা আইএস-এর ভয়ে অস্ত্র ফেলে পালিয়েছে। সুতরাং হঠাৎ করেই গজিয়ে ওঠা অ্যান্টি ট্রাম্প অ্যাক্টিভিস্টদের মতলব, ট্রাম্প নয় বরং মুসলিমবিরোধী হইচই করে সস্তা জনপ্রিয়তা, যার নমুনা ওই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপির টেবিল চাপড়ানো। বাংলাদেশে আজ যে হারে নির্যাতন নিধন তা অব্যাহত, কম কিসে! ভাগ্য ভালো, বাংলাদেশী জায়নিস্টদের কর্মকাণ্ড পশ্চিমা মিডিয়ার রাডারে নেই, হলে মজা বুঝত লীগ। পশ্চিমতীরের মানুষেরা দু’টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর; কিন্তু বাংলাদেশে যা চলছে, নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেন অনেকটা পশ্চিমতীরেরই উদাহরণ।


নবম সংসদে যেতে যে ম্যানিফেস্টো, সংসদে যাওয়ার পর থেকেই জায়ন আচরণ, ট্রাম্পবিরোধী বাংলাদেশীদের মুখে কুলুপ। প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্পের পক্ষে হয়তো উপমহাদেশের একজন ধর্মপ্রচারককে বিতর্কিত বিচার করে জেলে রাখা সম্ভব। গুটিকয়েক মুসলিম দলকে হয়তো নিষিদ্ধ করে আমেরিকা প্রবেশ বন্ধ করাও সম্ভব। গুয়ানতানামো বে’র উদাহরণ তো আছেই। তার পক্ষে হয়তো এমন অনেক কিছুই সম্ভব, যার বিরুদ্ধে বারবারই অ্যাক্টিভিস্টদের রাস্তায় নামতে হতে পারে। এ দিকে আমরাই দেখছি, বাংলাদেশে। এমনকি ভাত খাওয়া অবস্থায় তুলে নিয়ে গুলি, অন্তঃসত্ত্বার জরায়ুতে গুলি, পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে বিরোধীদেরকে হত্যা, বন্দুকযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে খুন, একাধিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসির মঞ্চে তুলতে টানাহেঁচড়া, কারাগারে সুই ফেলার জায়গা নেই… বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি থেকে সুরঞ্জিতবাবু, যারাই অন্যের সমালোচনায় মুখর! আগে ঘর সামলান।

ট্রাম্প, হিলারি কারো পক্ষেই নই; বরং সচেতন ব্যক্তি হিসেবে যা দেখছি, সেটাই বলছি। ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানে বহু মুসলিম কর্মী, ব্যবসা, সমর্থক। তার বক্তব্যে আহত হওয়ার যুক্তি অবশ্যই আছে কিন্তু মুসলিম বিশ্বজুড়ে এই যে খুনোখুনি, এ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে টেবিল চাপড়ানোর জন্য কেউ নেই। বাংলাদেশের অ্যান্টি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও কোনো বাংলাদেশী ব্রিটিশ এমপিকে দেখিনি টেবিল চাপড়াতে। অ্যাক্টিভিস্টদের ভুয়া জাতীয়তাবাদের মুখোশ উন্মোচনের প্রয়োজন এখনই।


লম্বা গোঁফ রাখলেই আইনস্টাইন আর লম্বা দাড়ি রাখলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না। সংসদীয় গণতন্ত্রে কিভাবে ‘প্রয়োজনীয় বিরোধী দল’ ঢুকে পড়ল, আর কত ছাড়? এরশাদকে প্রশ্ন, তিনি মানুষ, নাকি অ্যান্টি মানুষ? মানুষ হওয়ার দারুণ সুযোগটি মিস করলেন এরশাদ। যদি অ্যান্টি মানুষ না হতেন, সুজাতা সিং-এর কাছে নতিস্বীকার না করে সিএমএইচ-এর স্টিমরোলারের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বলতে পারতেন, ‘যদি ফাঁসিও দেন, আমি আমার দেশের এবং জাতির বিরুদ্ধে যাবো না। বরং সবাই দেখুক, আমিই সেই এরশাদ, যে নাকি বাকশাল এবং তৃতীয় সংসদের কলঙ্ক কবর দিয়ে, ’৯০তে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের দরজা খুলেছি। বুড়া বয়সে এমন পাপ করব না, যে কারণে গৌরব নষ্ট হবে। মিসেস সিং! আই অ্যাম ভেরি স্যরি।’


মানুষ বনাম অ্যান্টি মানুষ, বিতর্কের শেষ নেই। কেজিবি, সিআইএ, মোসাদ বাহিনী চিনি। কিন্তু পঙ্কজ শরণরাও ঢাকায় বসে যে পরিমাণ জায়নিস্টের ভূমিকায়, তবু সমালোচকদের নীরবতা আমাকে দারুণ হতাশ করে। ১২ ডিসেম্বর মানবজমিন, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জরুরি ছিল। …নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ নীতিতে দেশটির পরিবর্তন আসেনি।’ প্রমাণ করল, বাংলাদেশে দিল্লির জায়ন এবং র-এর মোসাদ ভূমিকা। ভুয়া অ্যাক্টিভিস্টদেরকে কঠিন প্রশ্ন, পঙ্কজ শরণের বক্তব্য কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়? পঙ্কজ আমাদের সংবিধানের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এই বক্তব্য যদি মিয়ানমার বা ফিলিপাইনের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাখতেন, নেপালের মতোই ভারতের সাথে ডিশলাইন কেটে দিতেন তাদের নেতারা। এক নেতার উল্টা বক্তব্য, ‘যারা ভারতের শত্রু তারা বাংলাদেশেরও শত্র“।’ কেন? এর মানে ইঙ্গিতবাহী!

কিশোরী ফেলানী থেকে শত শত বাংলাদেশী খুন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য, গত বছর খুন ৩৩, এই বছর ৪৫, বর্ডার গার্ডকে কখনোই দেখিনি পাল্টা গুলি ছুড়তে, কিন্তু কেন এই দৈন্য? এর মানে কি আমরা এখনো সেই জাতি, যারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জায়গা দিতে পলাশীর মাঠে অস্ত্র ফেলে দিয়েছিল! আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাড়াতে ধর্মকে পুঁজি করে, ৯৬ ভাগ ভোটে এমন এক অদ্ভুত দেশ বানালো, মাথা এবং পায়ের দূরত্ব ১২০০ মাইল! শরীরের ওপর দিয়ে পুরোটাই ভারত! সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতাই ঠিক, ‘আমি কবে বড় হবো নাদের আলী!’


একটি জাতি যখন ক্রমেই মনুষ্যত্ব ছেড়ে অমানুষে পরিণত হতে থাকে, তখন তার চেহারা হয় অত্যন্ত বিদঘুটে। দেশটাকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য কত না তোড়জোড়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে আজ অবধি যত গুম-খুন, আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্র্যাসিকে পর্যন্ত লজ্জা দিলো। গত সাড়ে সাত বছরে যত প্রাণ অকালে ঝরে গেল, ৯৯ ভাগই মুসলমান, যাদের কেউ পিতা, কেউ স্বামী, কেউ সন্তান। কলঙ্কমুক্ত হচ্ছি কি হচ্ছি না, একান্তই রাষ্ট্রের নির্বাহী চিন্তাধারা। কিন্তু যখন চায়ের দোকান থেকে অন্তঃসত্ত্বার জরায়ু পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে, তা কি কলঙ্ক নয়? বলব, আগে দেশী ট্রাম্পদের সমালোচনা করেন।

কথায় কথায় ন্যুরেমবার্গের উদাহরণ। নিজেও ন্যুরেমবার্গ নিয়ে বহু লিখেছি। ওই ট্রায়ালের সাথে আমাদের উদাহরণ টানা অযৌক্তিক, বিশ্বজুড়েই অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের সাথে যুক্ত আমেরিকা, ফ্রান্স, সোভিয়েত, ব্রিটেনের মধ্যে বিচার নিয়ে কারোই দ্বিমত ছিল না। হিটলারদেরকে মুক্তি দিয়ে হিটলারের বাচ্চাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলেনি ন্যুরেমবার্গ। বিচার স্বচ্ছ হচ্ছে জানানোর জন্য কোনো সর্দার কিংবা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, কারোই প্রয়োজন হয়নি। কাঁড়ি কাঁড়ি প্রপাগান্ডা মেশিনেরও লাইসেন্স দিতে হয়নি। হরতাল, ভাঙচুর, রাতের অন্ধকারে লাশ দাফন, আতঙ্কজনক অবস্থা, জনে জনে তল্লাশি… কোনোটাই হয়নি ন্যুরেমবার্গে।

সুতরাং দুর্গে অবস্থান না নিয়ে জনগণের কাতারে নেই কেন? জনগণকে ভয় কিসের! ন্যুরেমবার্গের সব কিছুই দিবালোকে এবং ইহুদি হত্যা নিয়ে কারোই দ্বিমত ছিল না। আমাদের দেশে ব্যতিক্রমের কারণ, তাদেরই বিচার করছি, অতীতে যাদের সাথে গলায় গলায় রাজনীতি করেছি। তা ছাড়া স্কাইপ কেলেঙ্কারিসহ ফাঁস হওয়া তথ্যে স্ববিরোধিতার প্রমাণ। ম্যান্ডেলারও বহু আগেই মুজিবের সাধারণ ক্ষমাই নয়, ফকা কিংবা শাহ আজিজ… যাদের সাথে রাজনীতি, জেলে থাকা অবস্থায় গোপনে তাদের দেখাশোনার খবর ঐতিহাসিক সত্য।

ভূমিকা স্বচ্ছ হলে এই মাপের দুর্গের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই কিন্তু সেটাই বাস্তবতা। বন্দুক-মেশিনগান-তৈরি হাসপাতালের নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা। বিচার স্বচ্ছ হলে সরকার এবং জনগণ এক কাতারে দাঁড়িয়ে উল্লাস করবে, মোমবাতিও প্রজ্ব¡লন করবে একসাথে। আইনের নামে একটি দল নিজেকে এত বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে, জনে জনে নিরাপত্তা ছাড়া ঘর থেকেই বের হতে পারছে না।

’৪৮ থেকে ২০১৫… অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ এবং একটি অ্যান্ট্রিমুসলিম আচরণ এই মর্মে শঙ্কিত করে, নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল বাধিয়ে রেখে পশ্চিমাদের মতোই ফায়দা লুটবে একটি দেশ। আগামী নির্বাচনে হয়তো সংসদীয় গণতন্ত্রকে একেবারে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

সারমর্ম : একা ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়, সব ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই আন্দোলন দেখতে চাই।

ইমেইল : farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.com