এটাই তাহলে সেরা ফাইনাল

  • রফিকুর হায়দার ফরহাদ, কাতার থেকে
  •  ২০ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০১
এটাই তাহলে সেরা ফাইনাল। – ছবি : সংগৃহীত

রোববার ১৮ ডিসেম্বর ছিল কাতারের জাতীয় দিবস। এই দিনে উৎসবের নানা আয়োজন করে কাতার সরকার। কিন্তু দোহার মাটিতে রাতটা যেন পরিণত হলো আর্জেন্টিনার জাতীয় দিবসে। যে দিনটির জন্য তাদের ৩৬ বছরের অপেক্ষা। ১৯৮৬ সালের পর যেটা দিয়েগো ম্যারাডোনা, দিয়েগো সিমিয়নি, রবার্তো আয়ালা, হাভিয়ার মাসকেরানোরা পারেনি সেটাই তৃতীয় চেষ্টায় করে দেখালেন লিওনেল মেসি। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে ১২০ মিনিটের ম্যাচ ৩-৩ গোলে শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশটির। ২০২২ বিশ্বকাপের দুই সেমিফাইনাল এক পেশেই হয়েছিল। কিন্তু ফাইনাল যে এতটা উপভোগ্য হবে তা কারো কল্পনাতে ছিল না। যা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ম্যাচ এবং অন্যতম সেরা ফাইনালের মর্যাদা পেয়ে গেছে।

`আমি সেই ১৯৬২ সাল থেকে মাঠে বসে বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করছি। এমন ফাইনাল আগে দেখিনি। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
দারুণ উপভোগ্য এক ফাইনাল দেখল ফুটবল বিশ্ব।` ম্যাচ শেষে ৮৫ বছর বয়স্ক জার্মান সাংবাদিক হুবর্টের এই মন্তব্যের সাথে কোনোভাবেই দ্বিমত পোষন করবেন না কোনো ফুটবলপ্রেমী। কি ছিল না লুসাইল স্টেডিয়ামে প্রায় ৯০ হাজার দর্শক উপস্থিতির এই ম্যাচে। হ্যাটট্রিক, তিন পেনাল্টি, গ্রেট ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পের তিন গোল, লিওনেল মেসির জোড়া গোল, শেষ ম্যাচে আঞ্জেল ডি মারিয়ার গোল, টাইব্রেকারে সেই বিখ্যাত আর্জেন্টনাই গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের শট রুখে দেয়ার কৃতিত্ব, আর শেষ বাঁশিতে মেসির হাতে প্রত্যাশিত শিরোপা সবই দেখেছে সারা দুনিয়ার মানুষ।

গত দুই বিশ্বকাপের চিত্র বলে দিচ্ছে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ম্যাচ মানেই তুমুল আকর্ষনীয়। রাশিয়ার মাঠে ফ্রান্স ৪-৩ গোলে জিতেছিল। সে ম্যাচ বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ম্যাচের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আর রোববারের ফাইনাল বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফাইনাল বলা হচ্ছে। ফ্রান্স এই ম্যাচে দুই দফা পিছিয়ে থেকেই ম্যাচ ফিরেছে। বিশেষ করে প্রথমার্ধে দুই গোলে পিছিয়ে দুই মিনিটের ঝড়ে স্কোর ২-২ করা, অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ফের পিছিয়ে পড়ে আবার স্কোর ৩-৩ করাটা তাদের কম আনন্দের নয়। আর ফাইনালে ১৯৬৬ সালের পর প্রথম হ্যাটিট্রকের ঘটনা ঘটলো এবার কাতারে। ইংল্যান্ডের জিওফ হাস্টের পর ফ্রান্সের এমবাপ্পের বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করা। তবে হাস্ট শিরোপা উৎসব করতে পারলেও ফরাসি স্ট্রাইকারকে মাঠ ছাড়তে হয়েছে কান্না জড়িত কণ্ঠে।

১৯৮৬ সালের আর্জেন্টিনা-পশ্চিম জার্মানির ফাইনালও এমন উপভোগ্য হয়েছিল। আর্জেন্টিনা দুই গোলে লিড নেয়ার পর ইউরোরিয়ান প্রতিপক্ষটি ২-২ করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ম্যারাডোনার দল ৯০ মিনিটেই ৩-২ গোলে ম্যাচ জিতে নেয়। ১৯৯৪ সালের ব্রাজিল-ইতালি ফাইনাল টাইব্রেকারে গড়ালেও তা কোনোভাবেই এতোটা চিত্তাকর্ষক ছিল না। ২০১৪ সালের আর্জেন্টিনা-জার্মানির ফাইনালে জয় সূচক গোল অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে হলেও ম্যাচটি গোল মিসের কারণে আকর্ষণ কাড়তে পারেনি। গোলময় বিশ্বকাপ ফাইনাল সেই ১৯৩০ সালের প্রথম আসর থেকেই। আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল উরুগুয়ে। ১৯৩৪ সালে ইতালির ২-১ গোলে ফাইনাল জয় চেকোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপও ছিল ছয় গোলের। ইতালি ৪-২ গোলে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে। ব্রাজিলের মারাকানা ট্র্র্যাজেডির ফাইনাল ১৯৫০ সালে। সে বছর উরুগুয়ে তাদের ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ হাতে নেয়।

১৯৫৪ সালের পশ্চিম জার্মানি এবং হাঙ্গেরির ফাইনালও ছিল বেশ উপভোগ্য। ৩-২ গোলে প্রথম বিশ্বকাপ জয় জার্মানদের। বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বাধিক ৭ গোল হয়েছে ১৯৫৮ সালে। সেবার ব্রাজিল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে ৫-২ গোলে সুইডেনকে হারিয়ে। ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় ৩-১ গোলে চেকোস্লাভিয়াকে পরাজিত করে।

ছয় গোলের বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছে ১৯৬৬ সালে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের দর্শরাও। এতে ইংল্যান্ড ৪-২ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানিকে। সে ম্যাচেই ফাইনালে প্রথম হ্যাটট্রিকের ঘটনা। এই কীর্তি ইংল্যান্ডের জিওফ হাস্টের। ২-২ গোলে ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ে হাস্টের দুই গোলে হ্যাটট্রিক এবং ইংলিশদের একমাত্র শিরোপা জয়। ১৯৭০ এর ফাইনালে পাঁচ গোল হলেও এতে ব্রাজিলের চার গোল ছিল ইতালির বিপক্ষে। ১৯৭৪ সালের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ২-১ নেদারলান্ডসকে এবং ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে হারায় নেদারল্যান্ডসকে। ১৯৮২ এর বিশ্বকাপের ফাইনালেও ৩-১ গোলে জয় পরাজয় নির্ধারণ। এতে ইতালি জয় জার্মানদের বিপক্ষে। ১৯৯০ সালে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানি।

ব্রাজিলের বিপক্ষে ১৯৯৮ সালের ফাইনাল ৩-০ গোলে জিতে নেয় ফ্রান্স। ২০০২ সালের পরের আসরে ব্রাজিল ২-০ গোলে হারায় জার্মার্নিকে। ২০০৬ সালের ফাইনালে ইতালি ১-১ গোলে ১২০ মিনিট শেষে টাইব্রেকারে হারায় ফরাসিদের। ২০১০ সালের স্পেনের প্রথম বিশ্বকাপ জয় অতিরিক্ত সময়ের ১-০ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে। ২০১৪ সালের ফাইনালে গোল হয়েছে একটি। এতে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারায় জার্মানি। ৬ গোলের ফাইনাল হয়েছিল ২০১৮ সালেও। তবে ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়ার সে ম্যাচে কোনোভাবেই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না।

একই সাথে এবার দারুণ এক নিরাপত্তার বিশ্বকাপ দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। ভোর রাতেও যদি কোনো নারী একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন তাতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনার এক সাংবাদিক সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হন ব্রাজিল বিশ্বকাপ কভার করতে এসে। কাতার বিশ্বকাপে অল্প দূরত্বে স্টেডিয়ামগুলোর অবস্থান হওয়ায় এক দর্শক দিনে চারটি ম্যাচও দেখতে পেরেছেন।