এক বছরে পেঁয়াজ, রসুন ও জিরার দাম দ্বিগুণ

এক বছরে পেঁয়াজ, রসুন ও জিরার দাম দ্বিগুণ
প্রতীকী ছবি

চাল, ডাল ও তেলের মতো নিত্যপণ্যের বাজার উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল। মাছ, মাংস ও ডিমের সঙ্গে এ বছর বাজারে সবজির দামও চড়া। এর মধ্যে গত বছরের তুলনায় ক্রেতাদের পেঁয়াজ-রসুন থেকে শুরু করে এলাচি-লবঙ্গের মতো মসলাও চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে এলাচ, লবঙ্গ ও রসুনের দাম নতুন করে আরও বেড়েছে। বাজারের অধিকাংশ মসলাই আমদানিনির্ভর।বাজারে বিভিন্ন ধরনের মসলা পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১১ ধরনের মসলার দামের খোঁজ নিয়েছে এই প্রতিবেদক। এসব মসলার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, দারুচিনি, জিরা, এলাচি, লবঙ্গ, ধনিয়া, তেজপাতা ও শুকনা মরিচ। এসব মসলার দাম বাজারে গত এক বছরে সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১২৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ১০০ শতাংশের বেশি মূল্য বৃদ্ধি মানে দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া। উল্লিখিত ১১ ধরনের মসলার মধ্যে টিসিবির হিসাবে পেঁয়াজ ও রসুনের দাম এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আর জিরার দামও দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বাকি মসলাগুলোর দাম ৪ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত বছরে মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে দামের কোনো হেরফের হয়নি শুধু তেজপাতার। যদিও রান্নায় তেজপাতার ব্যবহার খুব বেশি হয় না।

নতুন করে বাড়ল এলাচ, লবঙ্গ, রসুনের দাম

বাজার ঘুরে জানা যায়, বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে দামি মসলা ছোট দানার এলাচি আর লবঙ্গ। এ দুটি মসলার দাম কেজিতে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা। গত এক সপ্তাহে নতুন করে এ দুটি মসলার দাম কেজিতে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে এলাচির দাম এক সপ্তাহে কেজিতে ৪০০ টাকা এবং লবঙ্গের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর বাইরে বেড়েছে রসুনের দামও। পণ্যটির দাম এক সপ্তাহে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে এখন প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৬০ টাকা।

মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে দেশের ঘরে ঘরে রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পেঁয়াজ, রসুন, হলুদের। এ ছাড়া রান্না সুস্বাদু করতে অন্যান্য মসলার ব্যবহারও হয় কমবেশি। দেশে মসলার বড় অংশই আমদানিনির্ভর। এ কারণে আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়লে দেশে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। তার বড় উদাহরণ সম্প্রতি বাজারে দেখা গেছে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। গত ডিসেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের বাজারে এক লাফে রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকায় উঠে যায়। তবে সেই দাম কিছুটা কমে এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকায়। বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০-৪৫ টাকা।

ব্যবসায়ীরা যা বলছেন

মসলা আমদানিকারকেরা বলছেন, ডলার-সংকটের কারণে এখন আমদানি ঋণপত্র খুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার গত এক বছরে ডলারের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বিক্রিতে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের মসলা পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে।

বাংলাদেশ পাইকারি গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, গরমমসলার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে মসলার কিছু পদের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার বাড়তি দামে আমদানি করার পর সেই দামের ওপর শুল্কায়ন হচ্ছে। তাতে স্বাভাবিকভাবে খুচরা বাজারে মসলার দাম বেশি পড়ছে।

টিসিবির বাজারদর

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল বুধবারের বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, বাজারে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হয় ৯৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। এক বছর আগে এ দাম ছিল ৫০০ থেকে ৫৭০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে জিরার দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে এলাচি ও লবঙ্গের দামও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ছোট আকারের এলাচির কেজি এখন ২ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এক বছর আগে এ দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া এক বছরে লবঙ্গের দাম কেজিতে ৪০০ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকায় উঠেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানেও নতুন করে এলাচি ও লবঙ্গের দাম আবার বেড়েছে।

গরমমসলার মধ্যে বছর ঘুরে দারুচিনির দাম তুলনামূলক কম, ৪ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া ধনিয়ার দাম কেজিতে ১০০ টাকা বা ৬৯ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৬০ টাকায়। তেজপাতা এক বছর আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে, কেজি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

টিসিবির হিসাব বলছে, নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার পরও দাম এখনো বেশ চড়া। পেঁয়াজের সঙ্গে বেড়েছে রসুনের দামও। এক বছর আগেও আমদানি করা রসুনের কেজি ১১০ থেকে ১৩০ টাকা ছিল, এখন ২২০ থেকে ২৪০ টাকা। দেশে নতুন রসুনের আবাদ হয়েছে। তবে এখনো বাজারে আসেনি। তাই আমদানি করা রসুনের ওপরই নির্ভরশীল বাজার।

আদা, হলুদ ও শুকনা মরিচের দামও বাড়তি। আদার বাজারের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। হলুদ ও শুকনা মরিচের দেশে উৎপাদিত হলেও চাহিদা মেটাতে আমদানিও করতে হয়। বাজারে বর্তমানে আমদানি করা আদার কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে এ দাম ছিল ৯০ থেকে ১৫০ টাকা। দেশি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায়, এক বছর আগে এ মসলার দাম ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। আর শুকনা মরিচের কেজি ৩৯০ থেকে ৪৫০ টাকা, এক বছর আগে ছিল ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকা।

বেড়েছে আমদানি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মসলা (পেঁয়াজ, আদা ও রসুন বাদে) আমদানি হয় ১ লাখ ৭৬ হাজার টনের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ৩০ হাজার টন বেশি মসলা আমদানি হয়েছে।

মসলা আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র (এলসি) খোলা এখন বড় সমস্যা বলে জানান মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে ব্যাংকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ টাকা দিয়ে এলসি খোলা যেত। এখন ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সহজে ঋণপত্র খোলা গেলে বাজারও স্থিতিশীল হবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রথম আলো