মেহেদী হাসান
ঢাকা
হুগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। হুগোর বয়স তখন কত, মেরেকেটে ১০–১২ হবে। এক সংবাদকর্মী তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তুমি কি ডিয়েগোর মতো হতে পারবে?’
হুগো তাঁর বড় ভাইয়ের চেয়ে ৯ বছরের ছোট, ওদিকে ডিয়েগো তত দিনে আর্জেন্টাইন ফুটবলে প্রতিষ্ঠিত—ওই বয়সেই বাস্তবতা বুঝতে পারা হুগোর উত্তর ছিল, ‘কখনোই ডিয়েগোর মতো হতে চাইনি। কারণ, আমার ভাই মঙ্গল গ্রহের।’
বড় ভাইয়ের প্রতি আবেগ, ভালোবাসার কখনোই কমতি ছিল না রাউল ও হুগোর। ’৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তির মতো তাঁর দুই ছোট ভাইও ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেন। প্রতিভা ও সামর্থ্যের ফারাকে তাঁরা ডিয়েগোর ধারেকাছেও নেই।
সাবেক স্ট্রাইকার রাউল ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে ১২টি ক্লাবে খেলে চষে বেড়িয়েছেন দুনিয়া। আর্জেন্টিনা, কানাডা, জাপান, ইতালি, পেরু, ভেনেজুয়েলা, যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া ফুটবলের বিভিন্ন স্তরে খেলে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন ‘লালো’ নামে খ্যাত রাউল।
‘এল তুর্কো’ নামে খ্যাত হুগোও মেজ ভাইয়ের পথ অনুসরণ করেন। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ইতালি, অস্ট্রিয়া, কানাডা ও জাপানের ঘরোয়া ফুটবলে খেলার পাশাপাশি দেশের অনূর্ধ্ব–১৬ দলেও খেলেছেন সাবেক এই মিডফিল্ডার।
রাউলের মতো হুগোও বড় ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। বড় ভাইয়ের মতোই মিডফিল্ডার হতে চেয়েছিলেন। ১৩ মাস আগে ভাইয়ের মৃত্যুর পর একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দিন যায় আর কষ্ট বাড়ে। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না! বারবার মনে হয় ফোন করি…।’
হুগোর এখন অন্তত কষ্টমোচন হবে! নেপলসে ডিয়েগোর ফেলে আসা রাজত্বে শেষজীবন কাটিয়ে আজই তাঁর কাছে পাড়ি জমিয়েছেন হুগো। এতে ম্যারাডোনা পরিবারের দুই সাবেক মিডফিল্ডার বিরহডোর কাটিয়ে যেমন অন্যলোকে গাঁথা পড়লেন একসূত্রে, তেমনি এই পাড়ে পৃথিবীর ‘বক্সে’ একা হয়ে গেলেন তাঁদের স্ট্রাইকার ভাইটি—রাউল। দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ভালোবাসার ‘পাস’ আর আসবে না।
তবে একদিন পাস এসেছিল। তিন ম্যারাডোনাই একবার একই দলের হয়ে খেলেছিলেন। আরেকটু খোলাসা করে বলা যায়। স্প্যানিশ ক্লাব গ্রানাদার হয়ে এক প্রীতি ম্যাচে খেলেছিলেন তিন ভাই।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখনই কিংবদন্তি। ’৮৬ বিশ্বকাপ বলতে গেলে একাই আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে ঈশ্বরতুল্য মর্যাদা পেয়েছেন আর্জেন্টিনায়। শুধু–ই কি নিজের দেশে? ১৯৮৭ সালে বোকা জুনিয়র্স থেকে রাউলকে নিজেদের করে নেয় গ্রানাদা।
স্প্যানিশ ফুটবলে তখন দ্বিতীয় বিভাগে খেলা দলটি রাউলকে কেনার চুক্তিতে একটি শর্তও বেঁধে দিয়েছিল—তিন ভাইকে গ্রানাদার জার্সিতে প্রীতি ম্যাচে অংশ নিতে হবে। রাউলের সঙ্গে চুক্তির অন্যতম শর্তই ছিল এটা।
নাপোলিকে তত দিনে বিশ্বমানের ক্লাবে তুলে আনা ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে খেলবেন তাঁর দুই ভাই—আশির দশকে ইউরোপে ঘরোয়া ফুটবলের স্ফুরণ ঘটার সে সময়ে রোমান্টিক সমর্থকদের জন্য এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে!
ফুটবল বাজারে নিজেদের পসার–পরিচিতি ও কদর বাড়াতে সেই সুযোগটা নিয়েছিল গ্রানাদা। কিংবা ‘টিওয়াইসি স্পোর্টস’–এর মতো ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায়, বোকা থেকে রাউলকে নিয়ে আসার পর তাঁর পারিশ্রমিকের সংস্থান করতে তিন ভাইয়ের প্রীতি ম্যাচ খেলার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল গ্রানাদা। কিন্তু অফিশিয়ালি বলা হয়, ম্যারাডোনা পরিবারের প্রতি নৈবদ্যের স্মারক ম্যাচ।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখন দুনিয়াজুড়ে প্রীতি ম্যাচ খেলে বেড়াচ্ছেন। তাতে পকেটও ভারী হচ্ছে বেশ। কিন্তু ভাইয়ের জন্য গ্রানাদার হয়ে প্রীতি ম্যাচে একটি পয়সাও নেননি। শুধু কি তাই, ১০ নম্বর জার্সি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনা—‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ হিসেবে তত দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও গ্রানাদার ১০ নম্বর জার্সিটি রাউলকে দিয়ে নিজে নিয়েছিলেন ৯ নম্বর জার্সি।
মেজ ভাই ‘লালো’র প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ থেকেই ‘এল পিবে’ (ডিয়েগো ম্যারাডোনা) একবার (রাউল বোকায় যোগ দেওয়ার আগে) বলেছিলেন, ম্যারাডোনা পরিবারে ‘তিন ভাইয়ের মধ্যে সে–ই (রাউল) সেরা।’ কিন্তু তত দিনে দুনিয়া জেনে গিয়েছিল কে সেরা, চিরকালের প্রথাবিরোধী ম্যারাডোনা তা মানবেন কেন! ভাইয়ের গায়ে ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে দেওয়া হয়তো সেই প্রথাবিরোধী মানসিকতারই প্রকাশ ছিল।
সে যাই হোক, হুগো তখন ১৮ বছর বয়সী। ইউরোপের ফুটবলে পা রাখার চেষ্টা করছেন। বড় ভাইয়ের সুপারিশে নাপোলি তাঁকে দলে ভেড়ালেও আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় করায়নি, পাঠিয়ে দেয় ইতালির আরেক ক্লাব আসকোলিতে।
গ্রানাদা ওদিকে সেই প্রীতি ম্যাচের প্রতিপক্ষ হিসেবে ঠিক করে সুইডিশ লিগে তখন দাপট ছড়ানো রয় হজসনের মালমো এফসিকে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক এই কোচ পরে এই ম্যাচ নিয়ে বলেছিলেন, ‘মালমোকে কেন প্রীতি ম্যাচে ডাকা হলো, সে বিষয়ে শুরুতে আমরা কিছু জানতাম না। ওখানে (স্পেন) যাওয়ার পর জানলাম, ডিয়েগো ম্যারাডোনা এই ম্যাচে খেলবে।’
ডিয়েগো ম্যারাডোনাও এই ম্যাচ নিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘তিন ভাই মিলে একই দলে খেলাটা স্বপ্নের মতো। গ্রানাদা দারুণ এক কাজ করেছে। কোনো অফিশিয়াল ম্যাচে এই প্রথমবার আমরা তিন ভাই একসঙ্গে খেলব।’
১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর—সেই ম্যাচের আগে গ্রানাদা শহরে পা রাখলেন ম্যারাডোনার মা, বাবা ও বোনেরা। বিমানবন্দরে তাঁদের উষ্ণ হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন গ্রানাদার সমর্থকেরা। ক্লাবটির মাঠ লস কারমেনেসে সে ম্যাচে গ্রানাদার অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর হুগো? আন্দ্রেয়া পিরলোর মতো মাঝমাঠের গভীরে খেলতে অভ্যস্ত হুগো পরেছিলেন ৮ নম্বর জার্সি। অর্থাৎ ৮, ৯, ১০—তিন ম্যারাডোনা!
প্রথমার্ধে এগিয়ে যায় হজসনের মালমো। কিন্তু প্রথমার্ধেই স্বভাবসুলভ বাতাসে ভাসানো পাস বুক দিয়ে নামিয়ে রক্ষণচেরা পাস দেন ডিয়েগো। আক্রমণভাগে ততক্ষণে দৌড় শুরু করা রাউল শুধু টোকা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারেন গোলের।
বিরতির পর মালমো আবার এগিয়ে গেলেও ‘ট্রেডমার্ক’ ফ্রি–কিক থেকে গ্রানাদাকে সমতায় ফেরান ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পরে গ্রানাদাকে ৩–২ গোলের জয় এনে দেন মানোলো। তাঁকে ঘিরে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সে কী উচ্ছ্বাস! মানোলোর গোলেই তো তিন ম্যারাডোনার জয়! তখনকার স্প্যানিশ মুদ্রা ২০ মিলিয়ন পেসোয় বিক্রি হয়েছিল সেই ম্যাচের স্বত্ব। স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
গত বছরের ২৫ নভেম্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর হুগোর নিশ্চয়ই সে ম্যাচের স্মৃতি মনে পড়েছিল, মন পুড়েছিল। আর এখন নিশ্চয়ই ভাইয়ের সঙ্গেই গল্পগুজব হচ্ছে সে ম্যাচ নিয়ে।