ঢাকা
রাষ্ট্রপতির সংলাপ
একের পর এক রাজনৈতিক দলের বর্জনের কারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ এরই মধ্যে অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। বর্জনকারী দলগুলো বলছে, লোকদেখানো এই সংলাপ অর্থহীন; কারণ, দিন শেষে সরকার যেটা চায়, সেটাই হবে। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির পক্ষে সরকারপ্রধানের পরামর্শের বাইরে যাওয়ার সুযোগও নেই।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন গত ২০ ডিসেম্বর। ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৩১টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৬টি দল অংশ নিয়েছে। বর্জন করেছে ৪টি দল—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও এলডিপি। বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে আরও ৩টি দল—বিএনপি, জেএসডি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
বর্জনকারী দলগুলোর ভাষ্য, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়েছিল। ওই দুই সংলাপে অংশ নিয়ে তারা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল, তার কোনোটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে নতুন করে বলার কিছু নেই।
সংলাপে এ পর্যন্ত অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই সরকারির দলের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক কিংবা সরকারঘেঁষা। এসব দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি সুনির্দিষ্ট কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি, বরং তাঁর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথাই বলেছেন। অর্থাৎ সরকারের চাওয়ার বাইরে রাষ্ট্রপতির যাওয়ার সুযোগ কম—এটাই বোঝা গেছে।
সরকারি সূত্র বলছে, আগামী সংসদ অধিবেশনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে পারেন রাষ্ট্রপতি। ১৪ কিংবা ১৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোর সম্ভাবনা রয়েছে। সে সময়ও প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হবে রাষ্ট্রপতির। এরপর ইসি গঠনের বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
সরকার ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরের সূত্র বলছে, শুরুতে সরকার–সমর্থক বা সরকারঘেঁষা রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সংলাপকে কার্যকর ও সফল দেখাতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। কারণ, শুরুতে সরকারবিরোধীদের আমন্ত্রণ জানালে সংলাপ গতি হারানোর আশঙ্কা ছিল। বিএনপি ও সরকারবিরোধী অনেক দল সংলাপ বর্জন করতে পারে—সেটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির আসলে ক্ষমতা নেই। তিনি সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই সত্য। আর সরকার প্রতিটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানায়। এ জন্য নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে ইসি গঠনের কোনো অর্থই হবে না। তাই প্রথমে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে।
আইন চায় সবাই
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে এখন পর্যন্ত অংশ নেওয়া সব দলই ইসি গঠনে সংবিধানের নির্দেশনা মেনে আইন করার দাবি করেছে। ফলে আইন প্রণয়নের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির ওপর এক রকম চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সরকার–সমর্থক ও সরকারবিরোধী সব পক্ষের রাজনীতিকেরা।
২০১২ ও ২০১৬ সালের মতো এবারও সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না—এই আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা দিতে বাড়তি কিছু যোগ হতে পারে।
১৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের চলতি বছরের প্রথম অধিবেশন বসছে। এতে উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এই ভাষণে ইসি গঠনের বিষয়ে নির্দেশনা আসতে পারে বলে সরকারের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন। তিনি কী সিদ্ধান্ত দেন, এর ওপর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নির্ভর করবে। এখন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেই অনুযায়ী সরকার কাজ করবে।
সংসদকে যুক্ত করার প্রস্তাব
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণতন্ত্রী পার্টি সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা হলে এতে জাতীয় সংসদকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, সার্চ কমিটি সাংবিধানিক পদাধিকারীদের নিয়ে গঠন করতে হবে। তারা সিইসি ও অন্য কমিশনারদের প্রতিটি পদের জন্য চারজন করে নাম প্রস্তাব করবে। এই তালিকা সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে বাছাই করে সেখান থেকে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি সিইসি ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। একই কথা বলেছে গণতন্ত্রী পার্টি। তবে তারা ইসি গঠনে প্রতি পদে পাঁচজনের নাম সার্চ কমিটি প্রস্তাব করবে—এমনটাই বলেছে।
এই বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা হলেও আগের দুবারের প্রক্রিয়ায় এবারও তা করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে; বরং সংসদকে যুক্ত করলে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। এ জন্যই তাঁরা সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম নিয়ে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠায়। সেখান থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তবে নিয়োগ পাওয়া চারজনের নামই আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের শরিকদের দেওয়া নাম থেকে আসে। বিএনপির তালিকা থেকে নেওয়া হয় একজনকে। দুটি কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক আছে।
এই অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন ইসি গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এ নিয়ে চলমান সংলাপের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ শুরু করেছেন, এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে হয় না। এটা লোকদেখানো, নিষ্ফল প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৮–এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সবকিছুতেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতীতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ভবিষ্যতেও নেবেন—এটাই স্বাভাবিক।