সুদ যোগ হয়ে প্রতি মাসে ব্যাংক খাতে আমানত বৃদ্ধির কথা। তবে না বেড়ে অনেকদিন ধরে ১৮ লাখ কোটি টাকার আশপাশেই রয়েছে। এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) বাবদ ৪ শতাংশ হারে ৭২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখার কথা। অনেক ব্যাংক নির্ধারিত সীমার বেশি রাখলেও কিছু ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। সব মিলিয়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নীতিমালা জারির আগেই একের পর এক ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় সম্মত ছিলেন না। কিন্তু কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সায় দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা করা হয়নি। একীভূতকরণ করতে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে আসতে পারে, তা না বুঝেই তড়িঘড়ি করা হয়। বিষয়টি একেবারে নতুন হওয়ায় এত আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বেশ কিছুদিন ধরে এমনিতেই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক ধার করে চলছে। এর মধ্যে একীভূতকরণ নিয়ে আতঙ্কের কারণে সংকট আরও বেড়েছে। কেবল একীভূতকরণের আলোচনায় থাকা ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন হচ্ছে, তেমন নয়। অন্য ব্যাংক থেকেও উত্তোলন হচ্ছে। যারা টাকা তুলছে, তাদের অনেকেই আরেক ব্যাংকে রাখছে। কেউ কেউ বেশি সুদের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে রাখছে। এ অবস্থার উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করা দরকার। সামগ্রিকভাবে না বলে কীভাবে আমানত ফেরত পাবে, না দিলে ওই ব্যাংকের কী হবে– ইত্যাদি ধরে ধরে উল্লেখ করতে হবে। না হলে একীভূতকরণ সফল হবে না। বরং আতঙ্কে পড়ে ভালো কিছু ব্যাংক দুর্বল হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, যে উপায়ে ব্যাংক একীভূতকরণ করা হচ্ছে, তাতে প্রকৃত সমস্যার সমাধান হবে না। বরং চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ভালো ব্যাংকগুলোকেও সমস্যায় ফেলা হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা ঋণখেলাপিদের প্রতি সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। রাঘববোয়াল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে এখন সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ গোপন করতে সরকার এর আগে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। তাঁর মতে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না করে ব্যাংক একীভূতকরণ করে প্রকৃত সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী সমকালকে বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া কখনও মসৃণ হয় না। ফলে একীভূতকরণ শুরুর আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। একীভূতকরণ একমাত্র অপশন না রেখে বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হতো। কোনো ব্যাংকের হয়তো ২ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি। এখন তাকে সময় দিয়ে বলতে হতো, এ সময়ের মধ্যে মূলধন জোগান না দিলে ব্যাংক থাকবে না। এ ছাড়া আমানতকারীরা অনেক সময় সঠিক তথ্য পায় না। কিছু হলেই মনে করে টাকা ফেরত পাবে না। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে হবে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া যে উপায়ে ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, তাতে আতঙ্ক ছড়াবে– এটাই স্বাভাবিক। কেননা, যে নীতিমালা দেওয়া হয়েছে সেখানে আমানত ফেরতে অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে। তবে ফেরত না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্ব নেবে কিনা– বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে কাজ করা অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত না দিলেও তাদের কিছুই হচ্ছে না। আবার একীভূত হওয়ার পর তিন বছর কারও চাকরি যাবে না বলা হচ্ছে। এখন মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলে সুরক্ষা দেওয়া হবে কিনা– বলা হচ্ছে না। এ ছাড়া দায় থাকুক বা না থাকুক, একীভূত হওয়া ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডি ভালো ব্যাংকে যেতে পারবেন না। আবার ব্যাংকটি খারাপ করার পেছনে যাদের দায় আছে, তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত হবে কিনা, সে বিষয়ে বলা নেই। সবচেয়ে বড় বিষয়, মন্দ ঋণের কী হবে– তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, আগামী বছরের মার্চের পর বাধ্যতামূলক ব্যাংক একীভূতকরণ শুরু হওয়ার কথা। আর এ জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। তবে এসব না মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও পলিসি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের এ পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিকে ডেকে একীভূত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে গত ১৪ মার্চ এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত গভর্নরের সঙ্গে দেখা করার পরদিন পদত্যাগ করেন। এর পর গত ৩ এপ্রিল সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল এবং বাংলাদেশ কৃষির সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূত হতে বলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ৮ এপ্রিল সিটি ও বেসিক ব্যাংক এক হতে বলা হয়। ঈদের আগে ৯ এপ্রিল ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হতে বলা হয়। এভাবে একীভূত করার খবরে আমানত তোলার প্রবণতা দেখা দেয়।
এর পর গত ১৫ ও ১৬ এপ্রিল সাংবাদিকদের ডেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, আপাতত আর কোনো ব্যাংক একীভূত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য শুরু থেকে দাবি করে আসছে, এসব ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হচ্ছে। তবে গত ১৭ এপ্রিল বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক এবং ২৭ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া হোঁচট খায়। ব্যাংক দুটির পর্ষদের বৈঠকে বলা হয়– স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়া তো দূরে থাক, এ নিয়ে তারা জানেনই না। দু-একজনকে ডেকে নিয়ে যেভাবে একীভূত হতে বলা হয়েছে, তাও আনুষ্ঠানিক নয়। ন্যাশনাল ব্যাংক সরাসরি একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরপরই ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একীভূত না হওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া থমকে যায়নি। তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ন্যাশনাল ব্যাংককে সময় দেওয়া হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আসবে।
samkal