দুটি ঘটনা। কাছাকাছি সময়ে ঘটা দুটি ঘটনার মধ্যে তেমন মিল নেই, আবার মিল আছে যথেষ্ট। একটি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যটি নারায়ণগঞ্জে। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাশে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য। সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যে রবীন্দ্রনাথের হাতে ছিল পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’। তাঁর বিষণ্ন মুখ ছিল স্কচটেপে আঁটা। লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ দেশের সব পর্যায়ের মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে নির্মিত ভাস্কর্যটি চলতি ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে রাখার পরিকল্পনা ছিল এর নির্মাতাদের।
পরিকল্পনায় ছেদ পড়ল। কে বা কারা সরিয়ে ফেলল ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যের উদ্যোক্তাদের ভাষায়, রবীন্দ্রনাথকে গুম করা হলো। পরে তাঁরা ‘গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!’ লেখা একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেন ভাস্কর্যের স্থানে। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে কারা গুম করেছেন, কারা সেই সাহস ও সামর্থ্য রাখেন, কাদের প্রচ্ছন্ন মদদ এর পেছনে কাজ করেছে, সেটা বুঝতে খুব জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। এ ভাস্কর্য কাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তৈরি করা হয়েছে, সেটাও বোঝেন সবাই। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর যখন ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়টির সমালোচনা করেন, তখন সেটা আমাদের মনে আর বিস্ময় জাগায় না।
ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে প্রোক্টর বলেন, ‘একটা ভাস্কর্যের পাশে আরেকটা ভাস্কর্য নিয়ে আসা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কারা এই কাজ করল, তা আমরা জানার চেষ্টা করছি। যে চিন্তা থেকেই ভাস্কর্যটি বসানো হয়ে থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এটা শেয়ার করার দরকার ছিল। ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য স্থাপনের তো কিছু নিয়মনীতি আছে, যে-ই সেটি সরিয়ে থাকুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কেউ এসে একটি ভাস্কর্য বসিয়ে যাবে, তা তো প্রত্যাশিত নয়।’ প্রোক্টরের এ বক্তব্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, ভাস্কর্য স্থাপনের এ বিষয় তিনি কোনোভাবেই পছন্দ করছিলেন না। আর সে কারণেই তাঁর কিছু ছাত্রের তৈরি ভাস্কর্যটি সরানো তাঁকে বরং দুশ্চিন্তামুক্তই করেছিল। অন্তত তাঁর বক্তব্যে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্য ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জের। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গত মঙ্গলবার বিকেলের ওই অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা ছিল ‘একুশের উচ্চারণ দূর হ দুঃশাসন’। সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের অভিযোগ, ব্যানারের এ লেখা দেখে সেটি খুলে ফেলতে চাপ দেন সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান। শেষমেশ লেখাটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠান করেন তাঁরা।
সরকার এখন এমন সব বিষয়ে ভীত হতে শুরু করবে, যেগুলো দূর থেকে দেখলে কোনোভাবেই সরকারের জন্য ভীতিকর বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো বিষয়ে মানুষ হঠাৎ ক্ষুব্ধ হতে পারে, সংঘবদ্ধ হতে পারে— এমন ভয় সরকারকে প্ররোচিত করে এমন সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে, যেটা সাদাচোখে দেখলে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি আনিচুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যানারে ‘দুঃশাসন’ শব্দটি লেখা থাকায় সেটি নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে হামলা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ কারণে তাঁদের ব্যানারের সে লেখা বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছিল। তবে চাপ দিয়ে বাধ্য করার অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি।
আচ্ছা, একটা অস্থায়ী ভাস্কর্য যদি টিএসসিতে থাকত, তাহলে কি খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেত সরকারের? কিংবা ‘একুশের উচ্চারণ দূর হ দুঃশাসন’ লেখা ব্যানারটি কি সরকারের ক্ষমতায় থাকার পথে ন্যূনতম কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত? বরং এগুলো সরিয়ে ফেলায় এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এসব পদক্ষেপ এ মুহূর্তে অন্তত সরকারের জন্য কিছুটা হলেও সমস্যা তৈরি করেছে।
আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো ক্ষমতাসীন সরকারকে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ শক্ত চাপ দিচ্ছে—এটা এখন প্রকাশ্য। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোকে যথেষ্ট পরিমাণ ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ দিচ্ছে কি না, সেটা খেয়াল করছে তারা। একই সঙ্গে তারা দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, নজর রাখছে সেদিকেও। সে বিবেচনায় কিছু প্রতিবাদ, যেগুলো আক্ষরিক অর্থেই প্রতীকী, যেগুলো সরকারের ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পথে ন্যূনতম কোনো বাধা তৈরি করে না, সেগুলো করতে দেওয়া এক অর্থে সরকারের জন্য ভালো। সেসব প্রতিবাদ সরকারের গণতান্ত্রিক আচরণ হিসেবে বহির্বিশ্বের কাছে প্রদর্শিত হতেই পারে। উল্টো দিকে বলা যায়, এসব ক্ষেত্রে বাধা দেওয়াটা বরং সরকারকে পশ্চিমাদের কাছে প্রশ্নের মুখোমুখি করবে। বলাই বাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা নারায়ণগঞ্জের পুলিশ এভাবে ব্যাপারটি ভাবেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?
এই ‘কেন’র উত্তর খোঁজার আগে দেখে আসি আরও একটি ঘটনা। গতিধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ববি হাজ্জাজের বই প্রেসিডেন্টের লুঙ্গি নাই একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করেছে বাংলা একাডেমির টাস্কফোর্স কমিটি। মজার বিষয় হলো টাস্কফোর্সের সভাপতি স্বীকার করেছেন, তিনি বইটি পড়ে দেখেছেন, বইটির মধ্যে কিছুই নেই। নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘বইটির নামই আপত্তিকর। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির পদবিকে কটাক্ষ করে বইটির শিরোনাম করা হয়েছে।’ অর্থাৎ, শুধু নামের কারণে বইটি নিষিদ্ধ করেছে বাংলা একাডেমি।
লেখক তো ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, যাঁর দ্বারা ওই পদকেই নির্দেশ করা হয়। প্রেসিডেন্ট তো থাকতে পারে যেকোনো মামুলি প্রতিষ্ঠানেরও। আর রাষ্ট্রপতি থাকলেও-বা কী? কেবল নামের কারণে কোনো বই নিষিদ্ধ কোনো সভ্য সমাজে হয় না। এ ধরনের ঘটনা ঘটে বদ্ধ সমাজে, যেখানে মানুষের চিন্তা আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না; মানুষ কী ভাববে, কী বলবে, কী লিখবে, কী করে প্রকাশ করবে—তার সবই নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারিতে। বাংলাদেশে এখন ঠিক তা-ই চলছে। আগের দুটি ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠতেই পারে, বইটি বইমেলায় নিষিদ্ধ না করা হলে কী সমস্যা হতো? সরকারের পতন হতো? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধত?
একটা সরকার যখন জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় থাকে তখন তা কোনোভাবেই জনগণের সন্মতির সরকার নয়। জনগণের সম্মতিহীন সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। এই বলপ্রয়োগজনিত ভীতি সরকারটির বিরুদ্ধে নাগরিকদের অনেক ক্ষেত্রে নিবৃত্ত করে। কিন্তু এ রকম সরকারের নিয়তিও শেষ পর্যন্ত অনিবার্য। নিপীড়ক, কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার অন্তর্গতভাবেই ভীত থাকে চিরকাল। জনগণের সম্মতি না থাকাজনিত নিরাপত্তাবোধহীনতা কাজ করে তাদের ভেতর। এমন পরিস্থিতিতে ভীতি তৈরি জন্য তারা যখন বল প্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তখন জনগণের মধ্যেও সরকারে ব্যাপারে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। এ বাস্তবতাই সরকারটিকে ক্রমাগত আরও বেশি ভীত করে তোলে, যার অনিবার্য ফলস্বরূপ সে হয় আরও বেশি আক্রমণাত্মক, আরও বেশি নিপীড়ক।
জনগণের ভোট ও সন্মতি ছাড়া ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকার সে কারণেই ভীত এবং সে কারণে আরও বেশি নিপীড়ন করার অবশ্যম্ভাবী দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে। সুতরাং সরকার এখন এমন সব বিষয়ে ভীত হতে শুরু করবে, যেগুলো দূর থেকে দেখলে কোনোভাবেই সরকারের জন্য ভীতিকর বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো বিষয়ে মানুষ হঠাৎ ক্ষুব্ধ হতে পারে, সংঘবদ্ধ হতে পারে— এমন ভয় সরকারকে প্ররোচিত করে এমন সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে, যেটা সাদাচোখে দেখলে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়।
- রুমিন ফারহানা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী