একই নৌকায় ভারত ও চীন; কিন্তু তার পর?

ওবায়দুল হক : বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কী দাঁড়াবে, তা বুঝতে আমাদের একটু সময় লাগবে। যেহেতু একটি বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আমাদের ওপর একটা চাপ ছিল। পশ্চিমাদের দিক থেকেও এক ধরনের চাপ ছিল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, হয়তো নির্বাচন হবেই না, কিংবা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচনটা হবে, তা নিয়েও অনেক সংশয় ছিল। কিন্তু এসব সংশয় ফলেনি। কেন চাপগুলো নির্বাচন থামাতে পারেনি, সেসব নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। কোনোটাই শতভাগ সত্য বলার প্রয়োজন নেই। সব ক’টি ব্যাখ্যা আমাদের অনুমান বলা চলে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেও এক ধরনের বিভক্তি ছিল। একাধিক ঘটনায় তারা বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা বুঝতে পারি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব ক’টি দেশ অবস্থানে একাট্টা নয়। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ছিল। এসব অবস্থান মূলত জাতীয় স্বার্থ দ্বারা তাড়িত ছিল।

সম্ভবত এ কারণেই যে আদলে নির্বাচন হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম, সেটা হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান ব্যর্থ হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ নিয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। সমালোচক মহল বিষয়টি এভাবেই দেখছে। নির্বাচন যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে না হওয়ার পেছনে এটি একটি ব্যাখ্যা। আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দিল্লি সফর। সে কারণেও নির্বাচনের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও দিল্লি সরকার বরাবর বলছিল, তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। পরে দিল্লির অবস্থানও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে– আসলে তারা কী চায়। কী পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দিল্লি ভ্রমণ করেছিলেন, সে ব্যাপারে আমাদের অনেক ধোঁয়াশা আছে। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে কিংবা কাদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তা আমরা জানি না। সব মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন আমরা সবাই অপেক্ষা করছি, কী ঘটতে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। মোটাদাগে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে– কেউই বলেননি। তাহলে এর ফলাফল কী হতে যাচ্ছে?

পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি হয়তো ভিসা নিষেধাজ্ঞায় সীমিত থাকবে না। তবে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা এখনও সুস্পষ্টভাবে বলা যায় না। এখানে মোটাদাগে কিছু বিষয়ে মন্তব্য তুলে ধরা যায়। একটি বিষয় আমাদের খুবই চিন্তার খোরাক দেয়। যে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারের ব্যাপারে একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছিল, তখন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছিল। অথচ এরই মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকার তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবুও কেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করছে; তাদের সঙ্গে আবার লেনদেন করতে ইচ্ছা পোষণ করছে? এটা অনেকেই ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমার মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিনের শেষে জাতীয় স্বার্থ দ্বারা তাড়িত বলেই এমন আগ্রহ দেখিয়েছে। দেশে তারা যেসব গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের কথা বলে; মনে হয় না তারা খুব নৈতিক জায়গা থেকে কথাগুলো বলছে। মূলত ঘুরেফিরে সব রাষ্ট্রই তাদের নিজেদের স্বার্থেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে থাকে। দেশের রাজনৈতিক এই টানাপোড়েন পরিস্থিতির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র বোয়িং বিক্রির চেষ্টা করছে। একদিকে নির্বাচন নিয়ে কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক, অন্যদিকে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন নিয়ে কথা বলছে।

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা ঘটনা পররাষ্ট্রনীতিতে সবার চোখে পড়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের একই নৌকায় আরোহণ। এটি খুবই অভূতপূর্ব ঘটনা। আমরা এটা বুঝতে পারি– কেন চীন ও ভারত একই অবস্থান নিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সবসময় আমরা দেখে এসেছি, বিএনপি মানে কিছুটা চীন ও ইসলাপন্থি দেশঘেঁষা। আর আওয়ামী লীগ আসলে ভারতপন্থি। সত্তর ও আশির দশকে আমরা এসব ঘটনা দেখতে পেয়েছি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল। তবে মোটাদাগে এ রকমই ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।

এই ঘটনা আমাদের কী বলে? এটাও জাতীয় স্বার্থের কারণে ঘটেছে। ভারতের যেমন জাতীয় স্বার্থ আছে, তেমনি একই কারণে চীনও এগিয়ে এসেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, তারা উভয়ে একই নৌকায় পা দিয়েছে। কিন্তু এটা সামনের দিনগুলোতে এ রকম থাকবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের এটি এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বলা যায়। এটি নিয়ে সমালোচক মহলে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। অনেকেই বলেছেন, এই সরকার বেশ ভালোভাবে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে নিতে পারছে। বাংলাদেশ সরকার বলেছে, ভারত আমাদের কৌশলগত অংশীদার; অন্যদিকে, চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। এ নিয়ে কূটনীতিজ্ঞরা সমালোচনা করে বলেছেন, পরিশেষে এ ধরনের তাল মিলিয়ে চলার নীতি সুফল বয়ে আনবে না। আবার অনেকেই ভারত ও চীনকে একই নৌকায় আরোহণ করানোর ঘটনাকে হাসিনা সরকারের সাফল্য বলে সাধুবাদও দিচ্ছেন। আমার ধারণা, নির্বাচনের এই পরবর্তী সময়ে জাতীয় স্বার্থগুলো এভাবে থাকবে না। যেহেতু ভারত ও চীনের স্বার্থ এক নয়। এই স্বার্থ মূলত একে অপরের বিপরীতমুখী। ফলে এ ধরনের সম্পর্কের একটা প্রভাব পড়বে। দেখার বিষয়, তিস্তার ব্যাপারে চীনা রাষ্ট্রদূত সামনে কোনো বক্তব্য দেন কিনা। এ বিষয়ে চীনের কোনো হস্তক্ষেপ ঘটলে তা ভারতের জন্য অস্বস্তিকর হবে। এসব পরিস্থিতিতে কী ঘটবে, তা বুঝতে সময় লাগবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরে কী হবে তা ওপরের বিষয়গুলো দ্বারাই নির্ধারিত হবে। আমার ধারণা, সামনের দিনগুলোতে পররাষ্ট্রনীতি হবে রিঅ্যাক্টিভ; প্রোঅ্যাক্টিভ হবে না। অনেক ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের মতো দেশে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের বেলায় অনেক ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হয়। এটা বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য সত্য। আমরা মনে করে থাকি, বাংলাদেশও জাতীয় স্বার্থ সামনে রেখে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে থাকে; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে অনেক চাপ থেকে। এ কারণে প্রধান বিশ্বশক্তিগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হবো। আমার ধারণা, সরকারও অপেক্ষা করছে দেখতে– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়ার জন্যও অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া নির্বাচনোত্তর আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অথবা আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে আরও কিছু বিষয়। এক, দ্রুত পরিবর্তনশীল মিয়ানমার গৃহযুদ্ধের পরিণতি; দুই, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। যদি এই দুই জায়গায় অবস্থার বড় কোনো পরিবর্তন ঘটে, তাহলে সেটাকেও পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণনায় নিতে হতে পারে।

ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব যে তৈরি হয়েছে– তা আমরা সবাই স্বীকার করি। এ গুরুত্বকে আমরা আমাদের স্বার্থে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি কিনা, তা দেখতে হবে। ভারতের অভিজ্ঞতা বলে, আমরা সেটা পারিনি। ভারতকে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি, তার বিনিময়ে আমাদের অপারগতার কারণে হোক কিংবা অনিচ্ছার কারণেই; আমাদের ‘লিভারেজ’ বা কৌশলগত সুবিধা, দরকষাকষির সুবিধা আমরা ব্যবহার করতে পারিনি।