ঋত্বিক কি সাম্প্রদায়িক ?

ফরহাদ মজহার

December 30, 2019

Image may contain: one or more people, sunglasses and text

২০১২ সালে প্রকাশিত সুগত সিংহের °যুক্তি… তক্কো… ঋত্বিক…” বইটি আমার হাতে আসে নি। এখনও পড়ি নি। তবে বন্ধু Sayan Bhattacharyya-এর মন্তব্যে জানলাম। ফেইসবুকে প্রকাশকের পাতায় বলা হয়েছে, “ঋত্বিক ঘটক ‘শুধু’ হিন্দু উদ্বাস্তুদের দেখিয়ে গেলেন, এই অভিযোগ কি ঠিক? দেখিয়ে থাকলে, কেনই-বা দেখিয়েছিলেন? ঠিক কী ছিল তার কারণ?”। ভাল প্রশ্ন।

তাঁরা বলছেন, “ঋত্বিকের মধ্যে কি কোনও ইসলামবিদ্বেষ ছিল? এক কথায় পরিষ্কার উত্তর — না। ইসলাম সম্পর্কে তাঁর একটা উদাসীনতা ছিল। তাই তিনি হিন্দু ধর্মের গভীরে ঢুকে দু’বাংলার মিলনের সূত্র খুঁজতে চেয়েছেন, ইসলামের মধ্যে তেমন কিছু পান নি। হিন্দু বাঙালির মর্ম মূলে তিনি ঢুকতে চেয়েছেন, মুসলমান বাঙালি তাঁর পরিধির বাইরে থেকে গেছে। এই গোলমালটা তাঁর হল কেন?”। বেশ। আরও ভাল প্রশ্ন।

কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে ‘উদাসীন’ থেকে ‘দু বাংলার মিলনের সূত্র খোঁজা’ কিভাবে সম্ভব জানি না। বইটি পড়বার পর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। দেখা যাচ্ছে, মুসলমান বাঙালি ঋত্বিক ঘটকের পরিধির বাইরে থেকে গেছে — একথাটা আমি প্রথম বলছি না। সীমান্তের ওপাশে আগেই আলোচিত হয়েছে। এটা খুবই আশার কথা।

হিন্দুত্ববাদকে বোঝার জন্য শুধু বাইরে খাড়া নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দৃশ্যমান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দিকে তাকালে চলবে না, সেকুলার ও প্রগতিশীলদের নিজেদের দিকেও তাকাতে হবে। মুসলমান বাঙালি যদি মনোজগতের পরিধির বাইরে থেকে যায় তাহলে হিন্দুত্ববাদের বীজ তাদের মনোজগতেও হাজির ছিল। এখন তা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে মাত্র। কিন্তু নিজের জগতকে চিনবার বা জানবার চেষ্টা করে নি বলে বাইরের হিন্দুত্ববাদের রূপকে তার অচেনা মনে হয়। এর দোষ সে মোদী ও অমিত শাহের ওপর চাপাতে চেষ্টা করে।

সীমান্তের দুই পাশের বাংলাভাষীরা যদি আধুনিক জাতিবাদের কুফল ও কুৎসিত দিক এড়াতে চায়, যথা হিন্দুত্ববাদ ও ইসলামি জাতিবাদ, তাহলে পরস্পরের জগতে তারা কে কিভাবে বিরাজ করছে তার পর্যালোচনা করতে হবে। এর মধ্য দিয়েই আগামিতে পরস্পরের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক নির্মাণের সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চেনা সম্ভব হবে। নইলে না। হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে বেদ উপনিষদ, গীতা বা সনাতন ধর্মের কোন সম্বন্ধ নাই। অন্যদিকে ইসলামি জাতিবাদের সঙ্গে ইসলামের সম্বন্ধ বিরোধাত্মক। ইসলাম জাতীয়তাবাদ বরদাশত করে না। জাতিবাদ একান্তই আধুনিক ফেনমেনা। এর সঙ্গে ধর্মের সম্বন্ধ নাই। ধর্মের মর্ম নির্ণয়ের জন্য ধর্মের পর্যালোচনা জরুরী বিষয়। ঠিক। দর্শন ও রাজনীতির দিক থেকে সেই কাজ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধর্মের পর্যালোচনা জাতিবাদের ইতিহাস বোঝা এবং জাতিবাদের পর্যালোচনা থেকে আলাদা। ভিন্ন বিষয়।

আমরা দ্রুত উপমহাদেশে এক বিধ্বংসী হানাহানির দিকে ছুটে চলেছি। যদি আমরা তার মোকাবিলা করতে চাই তাহলে আগামিতে আমরা কি করতে ইচ্ছুক সেই নেগোশিয়েশান বা পারস্পরিক কথোপকথন চালাবার ক্ষেত্রগুলো দ্রুত শনাক্ত করা দরকার। সেই প্রয়োজনেও পরস্পরের জগতে আমরা হিন্দু বা মুসলমান হিশাবে কে কিভাবে হাজির রয়েছি তার পর্যালোচনা খুবই জরুরী।

ঔপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের দ্বিখণ্ডিত করেছে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু বাস্তবতার দুটো দিক আছে। এক. বাংলাভাষীরা সেই ইতিহাস মেনে নিতে পারে, বাঙ্গালি হিন্দু ও বাঙ্গালি মুসলমান কলোনিয়াল বিভাজনের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে, কিম্বা দুই. সেই ইতিহাস অতিক্রম করে যাবার সাধনাও করতে পারে। আগামীতে কী হবে আমরা জানি না। কিন্তু উপমহাদেশে বাংলাভাষীরা নিজেরা যদি নতুন ইতিহাস গড়তে চায়, তাহলে ইতিহাসের দাস না হয়ে ইতিহাসের কর্তা হবার সাধনায় তাদের রত হতে হবে। ঋত্বিক ঘটককে প্রগতিশীলতার ‘কাল্ট ফিগার’ বানিয়ে কাজ হবে না। সেটা কলোনিয়াল বিভেদকে আড়াল করে রাখা ছাড়া আর কোন ফায়দা দেবে না। দরকার আন্তরিক পর্যালোচনা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব কবি হয়েও বাংলাভাষীদের বিশ্ব এক রাখতে পারেন নি। আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে।

হিন্দুর জগতে মুসলমান, কিম্বা মুসলমানের জগতে হিন্দু কিভাবে আছেন সেই দিকে চোখ ফেরাবার সময় হয়েছে। এখানে হিন্দুর প্রতি মুসলমানের কিম্বা মুসলমানের প্রতি হিন্দুর আচরণ নিয়ে কথা হচ্ছে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার মামলা নয়, সমস্যা অনেক গভীরে। ঋত্ত্বিক ঘটক সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। প্রশ্নই আসে না। দেশ ভাগে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কিন্তু মুসলমান শরণার্থি তাঁর ট্রায়লজিতে অনুপস্থিত, এই বাস্তবতা অসাম্প্রদায়িক হিন্দুর জগত বোঝার সহায়ক।

ফুঁ দিয়ে ইতিহাস উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ইতিহাস তৈরি করতে হয়। আর তৈরি করতে হলে সবার আগে দরকার নিজের দিকে নির্মোহ চোখে তাকানো, নিজেদের বদ্ধমূল ধারণা ও অনুমানের পর্যালোচনা।

আশা করি বিভক্তি ও বিভাজনের ঔপনিবেশিক ক্ষত সীমান্তের দুই দিকের বাংলাভাষীরা নিরাময়ে সক্ষম। সামনে এগিয়ে যাবার ডাক এসে পড়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম বাংলাভাষিদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

নিতান্ত বেয়াকুব না হলে এই মূহূর্ত কেউ হাতছাড়া করবে না।

https://www.facebook.com/…/a.85950153772…/1093242044355831/…

ঋত্বিক ঘটক ‘শুধু’ হিন্দু উদ্বাস্তুদের দেখিয়ে গেলেন, এই অভিযোগ কি ঠিক? দেখিয়ে থাকলে, কেনই-বা দেখিয়েছিলেন? ঠিক কী ছিল তার কারণ?

সম্প্রতি ঋত্বিককে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে আবার, তার অনেকখানি রাজনৈতিকও। এই সমস্ত প্রশ্ন, আর ঋত্বিকের মনোজগৎ, তার দার্শনিক জিজ্ঞাসা নিয়ে ভেবেছিল ২০১২ সালে প্রকাশিত একটি বই।

°সহজপাঠের বই:

°যুক্তি… তক্কো… ঋত্বিক…
°সুগত সিংহ
°২০০ টাকা

পাওয়া যাবে বইমেলায়, স হ জ পা ঠ-র ১৮০ নম্বর স্টলে।

#books
#bookfair
#kolkatabookfair
#sahajpaath
#sahajpaath2020
#bibliophile
#ritwikghatak
#film

Source: https://www.facebook.com/718000741/posts/10158041039930742/