অর্থবিত্ত আর সুখের সহাবস্থান বিরল

  • সালাহউদ্দিন বাবর
  •  ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:০৬

সালাহউদ্দিন বাবর – ছবি : নয়া দিগন্ত

এ জীবনে সবাই সুখী হতে চায়। সবাই এটা জানেন, এই বিশ্বে তার অবস্থান খুব সংক্ষিপ্ত এক অভিযাত্রা। ক্ষণকালের এই জীবন তাও আবার নানা দুর্যোগ অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। পাহাড় শৃঙ্গে উঠা যত কঠিন তার চেয়ে অধিক দুরূহ সুখের সন্ধানের জন্য পথে নামা। সেটা ফসকে যায়, সুখ সন্ধানের পথকে আসলে বলতে হয় এক ‘মরীচিকা’। সুখ কী, কোথায় তার সন্ধান পাওয়া যায়? এর দার্শনিক জবাব অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল খোঁজার মতোই।

জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসর, নানা দুর্যোগ দুর্বিপাক, কষ্টভোগ এসব ভরা। তার পরও সুখ-শান্তি যশ প্রতিপত্তি, নিরোগ দেহে দীর্ঘ জীবন; স্বস্তি তার সাফল্যের দিগন্ত ছোঁয়া অদম্য স্পৃহা মানুষের। এসব অর্জনের মধ্যে সুখ কী লুক্কায়িত? সব পেলে সুখ কি হাতের মুঠোয় আসবে সত্যি? কিন্তু সুখ তো ‘সোনার হরিণ’, কোন গহিন অরণ্যের কত প্রতিবন্ধকতার ভেতর তার বাস কেউ তা জানে না।

মানুষ বহু কিছু চায় অথচ না পাওয়ার মর্মপীড়া মানুষকে সুখী হওয়ার পরিবর্তে বরং তাকে দুখের সলিলে ডোবায়। এটাও দেখা যায় কেউ রাজমহলে বাস করলেও সব কিছু তার বিস্বাদ ঠেকে। সুখ সম্পর্কে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আমার সুখ’ কবিতায় লিখেছেন ‘ভালোবাসা ঘেরা ঘরে কোমল শয়নে তুমি যে সুখেই থাকো, যে মাধুরী এ জীবনে আমি পাইয়াছি তাহা তুমি পেলে নাকো।’ শুধু বিস্বাদই নয়, মানুষতো সুখ না পেয়ে বিনিদ্র যামিনী যাপন করে। পক্ষান্তরে বহু মানুষ পর্ণকুটিরে রাত্রিতে তৃপ্তির নিদ্রায় বিভোর থেকে অতি প্রত্যুষের অপূর্ব বর্ণালী সকাল দেখে; দিনের সূচনায় বিধাতার অপার সৃষ্টি তাকে সুখ আনন্দ দেয়। অথচ ধনবান অসংখ্য মানুষ যারা সুখ আনন্দের তল্লাশিতে কাতর, তারা হয়তো অনেকেই সেই প্রত্যুষের আনন্দ উপভোগ করার কোনো দিন সুযোগই পান না। এই ধরায় যার যত বেশি আকাঙ্ক্ষা অভিলাষ, তা না পাওয়ার ব্যথা-বেদনা সে হৃদয়কে দলিত মথিত করে। আকাশছোঁয়া অপেক্ষা জীবনকে বিষিয়ে তোলে। বিশ্বকবির অপর এক কবিতা এখানে উল্লেখ করা প্রণিধানযোগ্য: ছোট ছোট দুঃখ, সুখ, ছোট ছোট আশা, ছোট ছোট অনুভূতি এ নিয়ে বাঁচা। বন্ধু হলে দুখের মাঝে সুখটা দেবে খুঁজে ভণ্ড হলে সুখের মাঝে দুঃখ দেবে গুঁজে।’ এর মধ্যে কোনো দর্শন নেই। নিরেট বাস্তবতাই নিহিত। সত্যিকথার সুখানুভূতি।

ছোট ছোট আশা নিয়ে যিনি পর্ণকুটিরে পরিজনদের নিয়ে রাত যাপন শেষে ঊষায় বেরিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে, গোধূলিলগ্নে যতটুকু যা কিছু জোটাতে পারেন, তাতে কোনো খেদ ক্ষোভ আর বেদনার স্পর্শ থাকে না। আলো-আঁধারিতে সেই খাদ্য পরম তৃপ্তিতে পরিবার-পরিজনসহ গ্রহণ করে গভীর নিদ্রায় জগৎজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান একটি সুন্দর প্রত্যুষের আশা নিয়ে। কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে ত্যক্ত বিরক্ত করে না যামিনীতে। এভাবেই ছোট ছোট আশা আর অনুভূতি নিয়ে হাজারো মানুষ বেঁচে থাকে, তাদের জীবনের সূর্যাস্ত না আসা পর্যন্ত। তারা বিত্তের দিগন্তের রেখা দেখে বটে তবে তা ছুঁয়ে আসার কোনো বাসনা জাগে না।

আর যিনি বা যারা মেঘলা মনে সকালে সব কিছু অর্জনের জন্য সীমাহীন প্রত্যাশা নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের সব বিবেচনা পাশে ফেলে, হিমালয় চূড়ায় উঠে যান আর ভাবেন সুউচ্চতা থেকে নিচে যা কিছু দেখতে পান তার সব লাভের জন্য যত কাতরতা; ক্ষণিকের তরেও চোখ ফেরান না জীর্ণশীর্ণ কোনো দুস্থ অভাবী মানুষের দিকে; তাদের শুধু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সব কিছু প্রাপ্তির জন্য যত চেষ্টা। সর্বভুক এসব মানুষের ক্ষুধা কোনো কালে মিটে না। সব সময় খাবার আশায় থাকেন মাতোয়ারা। কতটুকু তার প্রয়োজন তা তাদের বিবেচনায় থাকে না। রাশি রাশি ভারা ভারা সবই তার ডিঙ্গায় তুলতে হবে। তাদের কাছে জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য, বিত্ত-বৈভবের মধ্যেই সুখের অন্বেষণ করা। পরে রজনীর দুই প্রহর শেষে যখন ঘরে ফিরে যতই সুখাদ্য গ্রহণ করেন, সবই তখন তিক্ত আর বিস্বাদ হয়ে উঠে। যখন হিসাব করতে বসেন দিনান্তে কী পেলেন, আর কতটুকু হাত ছাড়া হলো, অপূরণের মাত্রা যদি হিসাবের বাইরে থেকে যায়, অপরিচিত দুঃখ-বেদনা আর গভীর হতাশা নিমজ্জিত হন। তখন পরিবার-পরিজনদের সান্নিধ্য কামনা করেন না। ভুলে যান সব সুবচন, ভাব আর ভঙ্গিমা।

তাই বিজ্ঞজনদের এই অনুভব-আসলে সুখ তো সোনার হরিণ কার কাছে কখন কোন স্বরূপে ধরা দেবে; সেটা ব্যক্তির বোধ বিবেচনার ওপরই নির্ভর করে।

পর্ণকুটিরে যাদের বসবাস আর রাজমহল যাদের ঠিকানা। উভয় শ্রেণীর মানুষ থাকে পরিবার-পরিজন নিয়ে; তাদের ঘরোয়া জীবনের যে চিত্র খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দুই শ্রেণীর মানুষ পারিবারিক জীবনে কতটা সুখ আর আনন্দের তা সহজে পরিষ্কার হয়। সুখ আসলে কী? মন মস্তিষ্কে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে অনেকের সারা জীবন ক্ষয় হয়ে যায়। তবুও এমন প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর জানা সম্ভব হয় না। অনেক জ্ঞানী মনীষী আর বোদ্ধাজন কখনো সুখের সন্ধান করেন না। কেননা সেটা আলো নয়, আলেয়া। এর সন্ধান করার অর্থ মরীচিকার পেছনে ফেরা। প্রকৃত একজন সুখী লোকের অস্তিত্ব হচ্ছে সাদা কাকের মতোই দুর্লভ। তবে অনেক গুণীজন এ-ও মনে করেন, ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই সুখী হওয়া সম্ভব। যার যতটুকু আছে তা, নিয়েই তৃপ্ত সন্তুষ্ট থাকলেই হয়। অযথা সোনার হরিণের পেছনে হন্যে হওয়া অর্থহীন।

দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার উপায় কী? এ বিষয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: থেকে শুরু করে বিশ্বের মনীষীর অজস্র পরামর্শ, বাণী বা উক্তি রয়েছে। দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে হলে অর্থবিত্তকে তথা এর গুরুত্বকে পেছনে নিয়ে আসতে হবে। সেখানে পরিবারের সবার মধ্যে প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ভক্তি স্নেহ মমতাকে স্থান করে দিতে হবে। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি সন্তান সন্তুতির প্রতি ফল্গুধারা বইয়ে দিতে হবে। সন্তানদেরও বুঝতে হবে স্নেহের এই সুন্দর বিশ্বে তাদের বিচরণ করতে পারা তাদের অভিভাবকের জন্যই সম্ভব হয়েছে। ইসলাম, বিশ্বনবী সা: মাতাকে সম্মান ও তার আশীর্বাদকে সন্তানদের জন্য পরম পাওয়া বলে ঘোষণা করায় সন্তানদের চিন্তাচেতনার জগতে এক শুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থেকে। শিশুকালে শৈশবে পিতা-মাতার স্নেহ আর ভালোবাসা মমতা তাদের মধ্যে সুখের অনুভূতি ও চেতনার উন্মেষ ঘটায়। সেই স্মৃতি পরিণত বয়সে পিতা-মাতার প্রতি তাদের কর্তব্য পালনে প্রেরণা জোগায়।

বস্তুত পারিবারিক জীবনে সুখ শান্তি আসে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, গুরুজন তথা প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন আর তাদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টায় ব্রতী হলে। কেননা না প্রবীণ দেহ মন তো তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে, নিজের প্রয়োজনটা পূরণের জন্য পরিশ্রম করার শক্তি-সামর্থ্য থাকে না। বয়োজ্যেষ্ঠ নিয়ে এই বোধ জাগ্রত থাকলে এর সমাধান হতে পারে। সবাইকে ভাবতে হবে, শৈশবে সে যখন অক্ষম অসহায় ছিল এই গুরুজন প্রতিক্ষণে ছিল তার সাথী, পরিচর্যা করে আহার বিহার, রোগ ভোগ কালে ওষুধ পথ্য নিয়ে আজকের বৃদ্ধ অক্ষম গুরুজনই পরম স্নেহভরে তার পাশে থাকত। আজ যে তরুণ শিক্ষা-দীক্ষা পেয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার রসদটাই জুগিয়েছেন আজকে বৃদ্ধ অক্ষম গুরুজন। তার কোনো বিনিময় পেতে চাননি। কাল কারো জন্য বসে থাকে না আজ যে তরুণ কাল সে জরাজীর্ণ হবে, এটা স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম। তাই ভাবা উচিত উদাহরণ একটা রেখে যেতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য। বিশ্বাসী মানুষ এটাকে স্রষ্টার কৃপা পাওয়ার নিমিত্ত বলেই ভাবে। তাই তার ভেতর যে চেতনা সৃষ্টি হয়, সেটা গুরুজনের প্রতি সেবা শুশ্রূষার প্রেরণা জোগায়।

প্রাচ্যে এভাবেই পারিবারিক জীবন মধুময় হয়ে ওঠে। সুখের সায়রে ভাসতে পারা যায়। পিতামাতার স্নেহ ভালোবাসা কখনোই কোনো প্রতিদানের আশা করে না। তবে এমন সুখের একটা পটভূমি আছে। এর মধ্যে বংশের সেই শিক্ষা ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ না করলে তা একসময় হারিয়ে যাবে। প্রবীণদের প্রতি বিনম্র হওয়া সুখের একটা উপাত্ত বটে। প্রবীণদেরও দায়িত্ব অতীতের স্মৃতিকে লালন করা; নবীনদের ভেতর তা সঞ্চারিত করা; এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। কারণ আজকের দিনে নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে বুঝিয়ে রাখতে হবে ঐতিহ্যকে লালন করার বিষয়ে। এখন যে নতুন বোধ সমাজে বিস্তার লাভ করছে, তাহলো সবার প্রতি প্রেমপ্রীতি শ্রদ্ধা ভক্তির পরিবর্তে কেবল নিজেকে নিয়েই শুধু ভাবনা; আর সব কিছু গৌণ। অতীত হয়ে পড়েছে বিবর্ণ ধূসর। সমতার উর্বর জমিন, আজ পরিবর্তিত হচ্ছে শুষ্ক নিঃষ্ফলায়। তাতে জল সিঞ্চন, আর আত্মসুখের যে পরগাছা জন্মাচ্ছে, তাতে উৎপাদন করতে হবে মমতার যত বচন দিয়ে।

আর সময় সাক্ষী হয়ে আছে খ্যাতি ধনবান হলেই সুখী হওয়া যায় না। অর্থ দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য কেনা সম্ভব, সমাজে বিত্তবান হওয়ার খ্যাতি লাভ করা যায় হৃদয়ের অহংবোধ, দিগন্ত জোড়া শত কোটি মানুষের কল্যাণের জন্য। শত কোটি মানুষের কল্যাণ আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নানা বিষয়ে গবেষণা, অনুসন্ধান, আবিষ্কার; তা নিছক আত্মসুখ বিত্ত লাভের লক্ষ্যে নয়। বিশ্বজোড়া মানুষের আনন্দ, সুখ, স্বপ্ন, স্বাদ পূরণ করতে পারে। মনে রাখা আর উপলব্ধির বিষয়, ধন মানুষকে কৃপণতা স্বার্থপরতার চোরা গলিতে নিয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে, জ্ঞান অর্জন স্রষ্টা ভীতি, মানুষকে উদার মহৎ আর পরার্থে উৎসর্গিত হওয়ার দীক্ষা দেয়। তাতে এক অনাবিল প্রশান্তি আর ঐশ্বরিক চেতনায় সমৃদ্ধ করে সাধককে দেয় পরমানন্দ।

অর্থ খ্যাতি বীরত্ব কোনো এক সময় কাউকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে বটে; কিন্তু তা কখনো ব্যক্তিজীবনকে সুখী করতে পারে না। এটি সবাই জানেন, বিখ্যাত দার্শনিক জাঁপল সাঁত্রে সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করেছেন, কিন্তু সুখ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। নোবেল লরেট অমর্ত্য সেন যখন খ্যাতির শীর্ষে, তখন তার ঘর ভেঙে গেছে। তার বহু আগের কথা, মহাবীর নেপোলিয়ন যখন বিশ্ব জয়ের পথে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন, তখন তার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সী জোসেফাইন তরুণ লেফটেন্যান্টের হাত ধরে চলে গেলেন নেপোলিয়নকে বিদায় জানিয়ে। অথচ নেপোলিয়ন ও জোসেফাইন পরস্পর গভীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বিয়েতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। জোসেফাইন ছিলেন বিধবা। তবে তার প্রেমে ভাটা পড়েছিল। রাজপ্রাসাদের যত স্বচ্ছন্দ ও শত শত সেবিকার সেবা, তাদের দুই পুত্রসন্তান, কিছুই বাধা হতে পারেনি জোসেফাইনকে নতুন প্রেমিকের সাথে মিলনানন্দে ভাসতে। এমন বহু অঘটন ঘটে। আমাদের দেশেও ভাওয়াল রাজ্যে রানী ও রাজপ্রাসাদের তার প্রেমিক ডাক্তার এতটা হীন কাণ্ড ঘটিয়েছিল যে, ভাওয়াল রাজাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল।

আজকের স্বাচ্ছন্দ্যের বিস্ময়কর যুগে ঘটছে অসংখ্য ঘর ভাঙা তথা বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা। আর এসব ঘটনা ঘটছে পশ্চিমের উন্নত দেশে যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য আর সম্ভোগের কোনো শেষ নেই। অথচ সেই সুখ আজ আর সবার জীবনে টিকছে না। দ্বৈত জীবনের দীর্ঘ সুখ আনন্দ শত স্মৃতি সন্তান-সন্তুতি কিছু ঠেকাতে পারছে না ঘর জোড়া রাখতে। প্রাচ্যে এই বিচ্ছেদের ঘটনা কম। তাদের পারিবারিক বন্ধন অনেক বেশি মজবুত। এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান বেশি। অভাব অভিযোগ কদাচিৎ তাদের বিচ্ছিন্ন করে। তবে আমাদের দেশে বিচ্ছেদের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তা এখনো ঝড়ো হাওয়ায় রূপ নেয়নি। পাশ্চাত্যের প্রতি প্রীতি যে হারে দেশে বাড়ছে, তাতে ধর্মের দীক্ষা তথা ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক যে দায় ভালোবাসা-সহনশীল তৃপ্ত থাকার বোধকে ভুলিয়ে দেয়া হয় বা ভুলে যাওয়া হয় তবে ঝড় শুরু হতে বিলম্ব হবে না।

বিজ্ঞান নিয়ে সাধকের যত অনুসন্ধান-গবেষণা তা কিন্তু স্বীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নয়, তা বলেছি। কোটি মানুষের স্বপ্ন-সাধ পূরণ করেই তাতে তৃপ্ত হন। কোভিডের টিকা আবিষ্কারের জন্য নিরলস সাধনা যারা করেছেন, তারা কিন্তু পরিশ্রমের বিনিময় পাওয়ার জন্য করেননি; আহার-নিদ্রা পরিজনদের সান্নিধ্যকে ভুলে যান। শুধু আজ নয়, অতীতের যত সাধক-গবেষক সৃষ্টির জন্য গভীর রজনীতে নরম শয্যা ছেড়ে কাজ করে গেছেন; তাদের বিনিময় স্রষ্টার কাছে মজুদ থাকবে। এসব ব্যক্তি আসলে প্রকৃত সুখী মানুষ।

তবে কিছু বিজ্ঞানী আছেন যারা সৃষ্টির ধ্বংসের প্রতিভূ যারা নিয়মিত গবেষণা করছেন কতটা শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র, মারণাস্ত্র তৈরি করে রাষ্ট্রীয় অর্থবিত্ত লাভ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দেশে দেশে চলছে প্রতিযোগিতা। কোন দেশের বিজ্ঞানী কত দ্রুত আর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, কারা কতটা বেশি ভীতিকর বিশ্বের জন্য। এসব জ্ঞানপাপী বিজ্ঞানীর প্রতি মানুষের কোনো শ্রদ্ধা ভালোবাসা কিঞ্চিৎ পরিমাণও থাকা উচিত নয়। বিশ্বে আজ উষ্ণায়নের জন্য যে বিপদের মুখে মানবসভ্যতা সে ক্ষেত্রে এসব জ্ঞানপাপীর অবদান কম নয়। আজ উষ্ণায়ন হ্রাস পেলেই পৃথিবী বাঁচবে। এসব বিজ্ঞানী এ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন নন। তারা তাদের মেধাটা যদি পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার গবেষণায় নিজেকে ব্রতী করেন, বিশ্বের শত শত কোটি মানুষের জন্য সুখশান্তি আর স্বস্তির পথটা উন্মোচিত হতে পারত। যেসব সাধক উষ্ণায়নে রোধের জন্য কাজ করছে, সেসব বিজ্ঞানী যদি তাদের সাথে একযোগে কাজ করতেন, বিশ্ব রক্ষার আন্দোলন আরো শক্তি ও গতি লাভ করতে পারত।

ধর্মের প্রভাব কিভাবে সুখের সাথে সম্পর্ক সংযুক্ত, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। ধর্মাশ্রয়ী মানুষ বেশি সুখী বলে দেখা গেছে। সুখের সাথে ধর্ম সামঞ্জস্যপূর্ণ। ‘ধর্ম’ ব্যাপক অর্থবোধক। ধর্ম সুখের অনুভূতি দিতে পারে। ধর্ম মানুষের স্বল্পে তুষ্ট হওয়া, তা ছাড়া গভীর ভালোবাসার অসাধারণ চেতনার সৃষ্টি করে। ধর্মে অনেক বিষয় রয়েছে যার দ্বারা একজন ব্যক্তিকে সুখ আনন্দ দিতে সক্ষম। ধর্ম মানুষের মনোজগতে আশাবাদ, স্বেচ্ছাসেবা, অন্যের সাফল্য কামনা সৃষ্টি করে, অপরের সুখ আনন্দে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ ঈর্ষাতুর নয়, বরং তাতে সে তৃপ্ত; তার শুভ কামনা করে। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে উচ্চ ধার্মিকতা বিষণ্ণতা এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও আত্মহননের ঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, যৌন জীবনে পবিত্র থাকা এবং সন্তুষ্টির দিক থেকে তারা অনেক এগিয়ে। ধর্ম বিশ্বাসীরা ধর্ম ও সুখের মধ্যে যোগ সাধন করে ধর্মীয় আচার অনুশীলনের মাধ্যমে। ইসলামে শতভাগ সুখকে ‘রিয়াদ বাই আল-কাদাহ’ বলা হয়, ভাগ্যে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। এর অর্থ হলো ঈমানদার হওয়া, যদি আমরা সত্যি আল্লাহকে ভালোবাসি এবং তাঁর ওপর সন্তুষ্ট থাকি। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ভাবি।

ঐশ্বর্য যেমন মানুষকে সুখী, শান্ত করতে পারেনি, তেমনি সমাজের অবক্ষয় বিপথগামিতা থেকে তরুণ সমাজকে ফেরাতে পারছে না। জীবন তো একটা, স্রষ্টা এ জীবনকে সরল পথে রাখার বহু অনুশীলন মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন। যারা তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন, তারা আনন্দে সলিলে অবগাহন করার সুযোগ পেয়ে চলেছেন। এ জন্য অর্থবিত্ত থাকা না থাকা কোনো প্রশ্ন নয়। এই শুভ বোধ জীবন থেকে নির্বাসিত হলে হতাশা থেকে ভুল পথে মানুষ হাঁটতে শুরু করে। এমনকি আত্মহননের দ্বারে গিয়ে পৌঁছে যায়।

চিকিৎসক মনোবিজ্ঞানী আত্মহননকে অবসাদ, হতাশাজনিত বৈকল্য বলে বিবেচনা করেন। বিশ্বের অনেকে তাকে গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচনা করে কিন্তু তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো অব্যর্থ পথ বাতলানোর চেষ্টায় সফল হননি যদিও আত্মহত্যাকারীদের আত্মঘাতক, আত্মঘাতী বা আত্মঘাতিকা হিসেবে অভিহিত করেছে। তাতে কি কোনো ইতিবাচক ফল এসেছে? সমস্যার কিনারা হয়েছে?

সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ক্যারিবীয় দেশ গায়ানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই এ তথ্য। ছোট এ দেশে প্রতি এক লাখ নাগরিকের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৪৪.২ শতাংশ। প্রচণ্ড দারিদ্র্য, মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন এর কারণ। তরল বিষপান করেই গায়ানার মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে। বিশ্ব সংস্থার (জাতিসঙ্ঘ) দায়িত্ব, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশটিকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। আর এনজিওগুলোর অবশ্য দায়িত্ব ছিল তরল বিষের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো।

আমাদের দেশও মাদকের ভয়াবহ ছোবলের কবলে। এক গবেষণাপত্র সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ মাদকসেবী তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। কী দুর্ভাগ্যজনক তথ্য। তরুণদের এই অধঃগতির পেছনের কারণ হচ্ছে পারিবারিক অবজ্ঞা, অজ্ঞানতা, মাদকের অপকারিতা সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষা আর ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব। এদের মধ্য থেকে হতাশা দূর করতে না পারলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যাবে। মাদক গ্রহণের পরিণতি সম্পর্কে সজাগ করতে পরিজনদের ব্যর্থতা সর্বাধিক। তা ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোর মাদক নিয়ে গুরুত্ব দানে অপারগতাও রয়েছে। মাদক প্রাপ্তি এত সহজ কেন? তা ছাড়া সর্ষের মধ্যে ভূতের লালন পালন করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাদকের সাথে সম্পর্ক আবিষ্কার, মাদক নিরোধ করার দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীয় কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে চরম শৈথিল্যও কম দায়ী নয়।

অন্য দিকে বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা কম নয়। দেশে প্রতি বছর ১১ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এই হিসাবে বছরে প্রতি জেলায় গড়ে ১৭২ জন জীবন স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিচ্ছে। জাপানে একসময় আত্মহত্যা ঘটত খুব বেশি। গত ১০ বছরে সে সংখ্যা কমেছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে এ সময়ে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি এনজিওর তথ্য মতে, দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি। এখন মাদকাসক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় মাদকের বিষক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যু ঘটছে যার সংখ্যা খুব কম নয়। মাদকাসক্তদের নিরাময়ের জন্য দেশে অনেক ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু এদের চিকিৎসার মান সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সরকারি-তদারকি তেমন নেই। দেশে দারিদ্র্যের জ্বালা যন্ত্রণা বেদনা নিয়ে যারা আত্মহত্যা করে; তার দায় কিছুটা হলেও কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। দারিদ্র্যবিমোচন করার ক্ষেত্রে সরকারের অসফলতাই এর একটা কারণ।

আত্মহত্যার ক্ষেত্রে গায়ানার পরই উত্তর কোরিয়ার স্থান। সে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর পেছনে দারিদ্র্য আছেই। আর সে দেশের কর্তৃপক্ষের নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সরকারি নির্যাতনের ভয় থেকে প্রচণ্ড চাপ- এসব কারণে সেখানে এত বেশি আত্মহত্যা বলে মনে করা হয়।

অর্থনৈতিক সচ্ছলতা যে, মানুষের হৃদয়ে সুখানুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, তার একটা উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। এ দেশকে সচ্ছল দেশ হিসেবে ধরা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার হার ২৮.৯ শতাংশ। চাকরির চাহিদা পূরণের চাপ এবং পড়ালেখা ও সামাজিক চাপের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ায় এত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে নভেম্বর মাসে কলেজে ভর্তি পরীক্ষার আগে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। বিষয়টি এতটাই উদ্বেগজনক যে, সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর নজরদারি করে সম্ভাব্য আত্মহত্যা ঠেকানোর পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কায়ই বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এর হার ২৮.৮ শতাংশ। দারিদ্র্য, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা এর কারণ। এ ছাড়া সুরিনাম (২৭.৮ শতাংশ), মোজাম্বিক (২৭.৪ শতাংশ), নেপাল (২৪.৯ শতাংশ), তানজানিয়া (২৪.৯ শতাংশ) প্রভৃতি দেশের মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে।

জাপানে সাধারণভাবে আত্মহত্যার হার আগের চেয়ে কমেছে। তবে হাইস্কুলের নিচে পড়ে এমন শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। এ দিকে জাপানে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ‘সম্মানজনক আত্মহত্যার’ ‘ঐতিহ্য’কেও দায়ী মনে করে অনেকে।

ইসলামের শিক্ষা শিরোধার্য করতে হবে। ইসলাম এসেছে শান্তি সুখ সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার জন্য। মানুষকে ভালোবাসা, তার পাশে থাকা সবার সুখ আনন্দে শরিক হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পরম সত্তার কাছে তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে শুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ প্রেরিত পুরুষ নবী মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষার পথ প্রশ্নাতীতভাবে অনুসরণ করা উচিত; কেননা নবী সা: স্রষ্টার নাজিল করা বক্তব্য বাণী প্রচার করেছেন।

আত্মহত্যা বর্তমান সমাজে সংঘটিত জঘন্য পাপ কাজগুলোর অন্যতম একটি। এ কারণেই ইসলামে আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ। ইসলাম কখনো আত্মহত্যার মতো কোনো অপরাধকে সমর্থন করে না। এমন কাজ থেকে বিরত থাকায় গুরুত্ব প্রদান করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে একাধিক সূরা নাজিল করেছেন। (ক) তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল (সূরা নিসা; আয়াত ২৯)। (খ) তোমরা নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৬)।

ndigantababor@gmail.com