- গৌতম দাস
- ১০ অক্টোবর ২০২০
বাংলাদেশের একটা ক্রিটিক্যাল সময় পার করছে, সামনে সম্ভবত আরো খারাপ সময় আসছে। সাথে আবার এটা এমন একটা সময় যখন বাংলাদেশের সরকারের রেটিং ভালো নয়, হওয়ার কোনো কারণ নেই। অথবা সরকারও এ সময়ে অন্তত ৪০ শতাংশ লোক তার পক্ষে আছে মনে করে বোকার সাহস দেখাতে একটা খোলা সার্ভে হতে দিতে চাইবে না বা মনেও করবে না। সাধারণভাবে এশিয়ার জন্যই বিশেষ করে ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর জন্যই খুব খারাপ সময় এটা। মূল কারণ, গ্লোবাল অর্থনীতির পুরান নেতা আমেরিকার বদলে পালাবদলে চীনের ক্রমশ নেতা হয়ে হাজির হওয়ার সময় হয়েছে। মূলত গ্লোবাল নেতা হওয়ার পালাবদলের এই সময়, বিশেষ করে এশিয়ান স্টেজ বা রঙ্গমঞ্চে ছোট দেশগুলোকে নিজের নৌকায় বা জোটে তুলতে টানাহেঁচড়ার খুব ভয়ঙ্কর সময় সামনে। তার প্রকৃত মাত্রা ও চিত্রটা পাবো আমরা আগামী ৩ নভেম্বর আমেরিকার নির্বাচনের পরের সপ্তাহ থেকে। কারণ এই টানাহেঁচড়ার পেছনের একটা বড় কারণ নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে ‘দেখন শোভা’ বা রোডশো। এই নির্বাচনে ট্রাম্পকে দেখাতে হবে, তিনি চীন বিরোধিতায় প্রবল লড়ছেন ও এমন সক্রিয়ভাবে তৎপর যে, নিজের অসুস্থতা ভুলে করোনার বেড থেকে উঠে এসেছেন।
চীনবিরোধী ‘কোয়াড’ জোট গড়তে (আমাদের সমতুল্য অর্থে) ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও এই ৬ অক্টোবরও জাপানে কোয়াড পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিটিং করে লড়ে যাচ্ছেন। অথচ ভেতরের কাহিনী হলো, এবারো তারা একসাথে পাঁচ রাষ্ট্র মিলে একটা বিবৃতি দিতে পারেননি। আলাদা আলাদা করে দিয়েছেন আর তাতে নিজ নিজ ইস্যু ঢুকিয়েছেন। এ থেকেই সন্দেহ ৩ নভেম্বরের পরে কোয়াডের কোনো মিটিং আদৌ আর হয় কিনা, হলে সেটা কেমন হয়, ভাষ্য কী থাকে তা দেখতে হবে আগে। আমেরিকান ইলেকশনের আগের মাসে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে এমন তৎপর ছিলেন জানা যায় না।
আমেরিকার বদলে চীন নতুন নেতা হতে যাচ্ছে, এটা কোনো মানুষ বা সাবজেক্ট দ্বারা নির্ধারিত ঘটনা নয়; অবজেক্টিভলি নির্ধারিত, আর এটা আমেরিকার পরপর তিনটা সরকারি সার্ভেরই একই মূল ফাইন্ডিং বা প্রাপ্ত ফলাফল। অবজেকটিভ বা বস্তুগত শর্ত বলতে এখানে প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে হাজির হয়েছে চীনের পর্যায়ের বিপুল বিনিয়োগ সমতা বা চীনের হাতের বিপুল সারপ্লাস, সঞ্চিত সম্পদ। যা সম্ভবত সবাই মানবে তা হলো এই চীনা সমতা, এটা আনপ্যারালাল; মানে এই বস্তগত মতার তুলনা একমাত্র চীন নিজেই। কিন্তু সমস্যা হলো, কোনো দেশ নিজে পরাজিত হয়েছে জানলেও একেবারেই চলতে না পারা অবধি কে যেচে পরাজয় স্বীকার করতে চায়! জটিলতা সেখানেই। তবে বোকার স্বর্গে বাস করা কেউ কেউ তো থাকেনই। অথবা আমেরিকান ছোট এন্টারপ্রাইজের পরিচালক কেউ, যার পে আমেরিকার বাস্তবতা মেনে নেয়া তো আসলেই কঠিন, এদের কেউ কেউ এর পরেও সামরিক দিক থেকে আমেরিকা এখনো অনেক গুণ শক্তিশালী- এ দিয়ে আমেরিকার শক্তি মেপে চলতে চাইবে হয়তো। তাদের বুঝানো সম্ভব নয় যে, সামরিক শক্তি দিয়ে গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্ব কায়েম করা যায় না।
কিন্তু তবু এই নির্ধারিত ফাইন্ডিংসে যে মুখ্য অংশটা এখনো অমীমাংসিত তা হলো, এই পালাবদল কি একটা যুদ্ধের পরিণতিতে হবে, না আপসে টেবিলে বসে কথা বলে শেষ হবে? আমরা এখনো জানি না। গত পালাবদলের কথা মনে করে দেখুন।
অবশ্য এর আগেও যে পালাবদল হয়েছে তা অনেকে আমলই করেন নাই হয়তো। তাদের মন করিয়ে দেই, ৭৫ বছর আগে আমেরিকা গ্লোবাল পলিটিক্যাল নেতা হয়েছিল সব কলোনি-দখলদারদের পরাজিত করে অথবা তাদের উপরের নেতা হয়ে আর সেটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অর্থাৎ যুদ্ধের ফলাফল হিসাবেই আমেরিকা নেতা হয়েছিল ব্রিটিশদের উপরে। ওরা গর্ব করত যে, কলোনি সাম্রাজ্যের সূর্য নাকি কখনোই অস্ত যাবে না। সেই গর্ব ভেঙে চুরমার করে আমেরিকা। তবু এটা কোনো নিশ্চয়তা নয়। তাহলে এবারো যুদ্ধের পরেই কেবল চীন নেতা হবে।
এছাড়াও যুদ্ধ হলে সেটা ছোটখাটো যুদ্ধের সীমায় থাকবে তো? না বড় আত্মহত্যার কোনো কাণ্ড ঘটবে? ‘আত্মহত্যা’ বলছি এজন্য যে, বেশির ভাগ মন্তব্যকারী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে একটা কথা প্রায়ই বলে ফেলে। কিন্তু তাতে এটা বুঝাই যায়, তারা কী নিয়ে কথা বলছে, এর কোনো কল্পনাও তাদের মাথায় কিছু নেই। তারা প্রায় সবাই গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্পনাটাই মাথায় রেখে এবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা অবলীলায় বলে যায়। অথচ তারা আমলই করেনি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটা কোনো পারমাণবিক বোমার যুদ্ধ ছিল না। তাই রাষ্ট্রনেতারা পকেটে সেকালে পারমাণবিক বোমার কোড নিয়ে ঘুরতেন না। একালে ঘোরেন! তবু কেবল আমেরিকা ওই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ওই যুদ্ধের পটভূমিকে উসিলা করে পারমাণবিক বোমা কেমন নৃশংসভাবে মানুষ মারতে পারে এর পরীক্ষা করে নিয়েছিল। ‘হারু পার্টি’ ছিল হিটলারের বন্ধু জাপানের সামরিক সরকার; অথচ বেচারা জাপানের জনগণের ওপর পারমানবিক বোমা প্রয়োগ করে এর পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছিল। এর ফলাফল ছিল চরম ভয়াবহ, এটা বললেও কম বলা হবে। কিন্তু তবু একালে যারা অবলীলায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছেন মনে হয় না তারা আমল করেছেন যে, এবার হবু যুদ্ধে প্রধান তিন থেকে ছয়টা দেশ পারমাণবিক বোমাসমৃদ্ধ হবেই। সুতরাং এবার যদি (সীমিত নয় এমন) বড় যুদ্ধ হয় তাহলে দুনিয়াই শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই নিজে বাঁচার তাগিদে হুঁশজ্ঞানটুকু অন্তত যদি থাকে তবে বড় যুদ্ধের কথা কেউ বলবে না বা সেদিকে যাবে না। কিন্তু যুদ্ধ লেগে গেলে কে নিশ্চয়তা দিতে পারে এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে! নাকি দুনিয়াই শেষ হবে?
তাই এসব সম্ভাবনার দিক মাথায় রেখে এশিয়ান স্টেজে চীন ও আমেরিকার মহড়া আর লেজে ফাঁকফোকরে প্রক্সিতে ভারতের ভাবধরা- সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা আমাদের মতো দেশের জন্য অস্বস্তিকর।
এমন অবস্থায় আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি (উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী) স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশ সফরে আসছেন আগামী ১৪ অক্টোবর। মি. বিগান আমাদেরকে বলে কয়েই তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে তুলে নিতে চেয়েই আসছেন। ঢাকার আমেরিকান এমবেসি আমাদের তাই জানিয়েছেন। আমেরিকা তার স্বার্থের কথা ও পথে তাদের মতে আমাদের ‘হেদায়েত’ করতে চাইবে। তাতে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়, পাবলিক ইন্টারেস্ট তো দেখতে হবে! আর ঠিক এই বিষয়ে আমাদের জন্য আইডিয়েল ও সঠিক অবস্থান হবে নিউট্রালিটি; মানে কারো নৌকায় বা জোটে না ওঠা। কোনো যুদ্ধে বা কারো যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া মানে হবে শেষ সম্বলটাও হারানো। অথচ আমাদের জন্য সময়টা কঠিন এজন্য যে, আমাদের এখনকার সরকার দুর্বল, পেছনে জনসমর্থন নেই; তাই স্বর নরম করে ফেলতে পারে। আর সে কারণে সেই ঘাটতি পূরণ করতে ওদিকে আবার ক্ষমতায়ও থাকতে চাইবে বলে কোনো না কোনো আপস যাতে না গিলে ফেলে, এই ভয় আমাদের থাকবে। অথচ এসময় দরকার ছিল অভ্যন্তরীণভাবে অন্তত এই ইস্যুতে পাবলিকের সবপক্ষের ঐকমত্য, একক অবস্থান নিয়ে এক ভয়েজে কথা বলা।
ওদিকে ইতোমধ্যেই মনে হচ্ছে মি বিগান আমাদের সাইলেন্ট মেজরিটিকে একটা প্রাথমিক ভুল মেসেজ দিলেন। তিনি বাংলাদেশে কাজ শেষে ভারতে যাচ্ছেন। এর মানে কি একালেও ভারতকে বগলে করে আমেরিকা এশিয়ায় এসেছে? এর অর্থ-ইঙ্গিত খুবই সুদূর প্রসারীভাবে হবে নেতিবাচক। যদি মানে তাই হয় তবে আমাদের দেশের মানুষের জন্য খুবই খারাপ মেসেজ তিনি এনেছেন। এর মানে বাংলাদেশের সাইলেন্ট মেজরিটির মনোভাব আমল করতে ও ক্ষোভ বুঝতে আমেরিকা আবার ব্যর্থতার পথই বেছে নিতে যাচ্ছে। যেখানে হাত পরিষ্কার রাখতে ও দেখাতে আমেরিকার উচিত আলাদা ডেস্ক মানে আলাদা স্টাফ থেকে ভারতকে ডিল করা। তাই এরকম চললে আমেরিকার বাংলাদেশে কাজ করা বা ভূমিকা রাখার যতটুকু শেষ সুযোগ আছে তা অকার্যকর করা হবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এতে বাংলাদেশে আমেরিকার কোনো পরিকল্পনাই পাবলিকের দিক থেকে কোনো সমর্থন বা আমল পাবেই না।
তাই একটা উদাহরণ হিসাবে এবার মালদ্বীপকে সামনে রেখে কথা বলব। তবে মালদ্বীপ এশিয়ার ছোট দেশ হিসাবে পালাবদলের কালের সমস্যা ভালো মোকাবেলা করেছে বলে নয়; বরং কিভাবে আরো জটিল জালে আটকে গেছে এর উদাহরণ হিসেবে মালদ্বীপকে নিয়ে কথা বলছি। বাইরে থেকে দেখে মালদ্বীপের মূলসমস্যা, দুই প্রধান দল দুই গ্লোবাল পালাবদলের ক্যাম্পের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে একটু ফারাক হলো এটা চীন-আমেরিকা না হয়ে চীন-ভারত হয়ে আছে; মানে আমেরিকার প্রক্সি এখানে ভারত। যেকোনো দেশের জন্য এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক, দেশের প্রধান দুই রাজনীতির দল যদি চীন ও ভারতের এজেন্ট হয়ে কায়েমি দোকান খুলে বসে যায়। এরই আরেক উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কা। অভ্যন্তরীণভাবে বলা হয় মালদ্বীপ মূলত নাকি দুই সৎভাই মামুন আবদুল গাইয়ুম আর ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম মূলত তাদের আর তাদের অনুসারী বা অনুগামী রাজনীতিকদের নিজেদের দুই দল হিসেবে ভেতরের লড়াই হাজির হয়েছে।
এ বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দুই ভারতীয় পত্রিকার দুটো রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। সুধা রামচন্দ্রন ব্যাঙ্গালোর থেকে লিখেছেন আগস্টে জাপানি ‘ডিপ্লোমেট’ পত্রিকায়, আর সীমা দাসগুপ্তা কলকাতা থেকে লিখেছেন গত সপ্তাহে হংকংয়ের এশিয়ান টাইমসে। সুধার লেখাটা একেবারেই প্রো-ইন্ডিয়ান ভাষ্য বা ভারতের ‘জাতীয়’ স্বার্থ মেনে লেখা বলা যেতে পারে। সীমার লেখাটা সে তুলনায় অনেক নিউট্রাল।
২০১৮ সালের শেষে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইয়ামিন (প্রো-চাইনিজ) হেরে যান প্রো-ইন্ডিয়ান নাশিদ গ্রুপ ও দলের কাছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ জনসংখ্যাও প্রায় ১২শ’ দ্বীপমালার দেশ মালদ্বীপ যার মাত্র ছোটবড় ১৮৫টা বসবাসযোগ্য। বাকিটায় চাষাবাদ হয় মূলত। ইয়ামিনের গত আমলে এমন মূল বা বড় চারটা দ্বীপকে একটা ব্রিজ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে, যার একটাতে এয়ারপোর্ট আর শিল্পকারখানার জন্য জোন আছে। আর বাকি দুটোতে বসবাসের জন্য ১৬-২৫ তলা করে আবাসিক ফাট তৈরি করেছে ইয়ামনের সরকার চীনা ঋণে। এরকম প্রতি ফ্লাটে যদি দু’জন করে বাসিন্দা থাকে তবে মালদ্বীপের ৮৬ শতাংশ জনসংখ্যাকেই সরকার আবাসন দিতে পারবে, এতই বিপুল সংখ্যায় ফ্লাট নির্মাণযজ্ঞ চলছে এখনো।
এখন সুধার লেখায় অভিযোগ হলো, ইয়ামিন ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে এসব নির্মাণ করেছে। আর অভিযোগের স্বরে লিখছেন, এখন এই ঋণ কি মালদ্বীপ পরিশোধ করতে পারবে? নাকি শ্রীলঙ্কার মতো হবে? মানে, বলতে চাইছেন, ভারত শ্রীলঙ্কায় যেমন প্রপাগান্ডা করতে পেরেছিল তেমন প্রপাগান্ডা করার সুযোগ কি পাবে?
আসলে প্রপাগান্ডা ও গুজব এখনই শুরু হয়ে গেছে।
ধরা যাক, সুধার আশঙ্কামত মালদ্বীপ চীনা ঋণ পরিশোধে বিরাট সমস্যায় পড়বে। ইব্রাহিম সোলিহ এখন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। তাহলে সোলিহ-নাশিদ গ্রুপ যারা এখন ক্ষমতায়, এরা তো ক্ষমতায় এসেই নতুন করে ইন্ডিয়ান ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ মালদ্বীপ সরকার আরো প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার ভারতীয় ঋণ নিয়ে এবার একইভাবে অন্য তিনটা দ্বীপ যুক্ত করতে রাস্তা বানাচ্ছে। এখন চীন ঋণ শোধে যদি মালদ্বীপের মুরোদই না থাকে তবে ভারতীয় ঋণ নিচ্ছে কেন? আর এই ভারতীয় ঋণের বেলায়ও এর কিস্তির অর্থ কোথা থেকে আসবে, শোধ দিবে কী করে? অর্থাৎ সুধার অনুমিত, কথিত ঋণের ফাঁদের গল্প আসলে ছিল প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন মাত্র। আর মালদ্বীপের অর্থনীতির আসল দায় সহ্যমতার ওপর দাঁড়িয়ে কোনো পেশাদারের বিশ্লেষণ-প্রাপ্ত ফলাফল জেনে নিয়ে তিনি কথা বলেননি। ভারতীয় সাংবাদিক হয়ে ভারত সরকারের পক্ষে কোনো প্রপাগান্ডা করা তার কাজ নয়। কিন্তু তিনি প্রবল জাতিবাদী বলে কথিত জাতীয় স্বার্থে এই মিথ্যা প্রপাগান্ডা শুরু করে দিয়েছেন। এমনি দুই দলের, এমন চীন বা ভারতের পক্ষ নিয়ে প্রপাগান্ডা শুরু করা এই ধরনের প্রপাগান্ডাই সবচেয়ে আপত্তিকর, চরম ক্ষতিকর। আর মালদ্বীপের প্রধান দুর্ভাগ্য আর পতনের কারণ হবে এটা। এ জন্যই বলছি একেকটা দল চীন বা ভারতের দালালি নিবে, দেশ ভাগ হয়ে এটা চলতেই পারে না। এমন হলে সে দেশ শেষ হয়ে যাবে।
আবার এই নাশিদ (২০১৩ সালের প্রো-ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্ট ছিলেন) তিনি ইয়ামিনের আমলে দুর্নীতির দায়ে জেলে ছিলেন। কিন্তু কোনো এক (সম্ভবত অসুস্থতার) অজুহাতে জামিন পেয়ে সেসময় পালিয়ে শ্রীলঙ্কা চলে যান আর সেখান থেকে মিডিয়ায় ইন্ডিয়ান আর্মিকে মালদ্বীপ দখলের প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এদের দল আবারো ২০১৮ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলে সেবার ঘোষণা দিয়ে প্রো-ইন্ডিয়ান সরকার কায়েম করেছিলেন যেখানে সোলিহ হন প্রেসিডেন্ট আর নাশিদ স্পিকার। আর পুরাতন চেয়ার-খেলায় রোটেশনের মতো ইয়ামিন এখন জেলে।
সোলিহদের অভিযোগ হলো চীন ঋণ থেকে ইয়ামিন সরকারের আমলে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। আরো অভিযোগ, চীনা প্রাইভেট কোম্পানির কাছে লোনে তারা মালদ্বীপের কিছু প্রাইভেট ব্যবসায়ীকে রিসোর্ট বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইয়ামিনের সরকার ওই লোনে গ্যারান্টার হয়ে আছে। অতএব এখানে এই গ্যারান্টার হওয়া মানে, এই অর্থও আত্মসাৎ হয়ে গেছে। সোলিহ-নাশিদের অর্থমন্ত্রী অভিযোগ তুলে বলছেন, মোট ৯৫৩ মিলিয়ন ডলার হলো গ্যারান্টার হওয়া অর্থে ইয়ামিন সরকার চীনা ঋণ নিয়েছে। আর সরকার নিজে নিয়েছে বাদ বাকিটা। এভাবে মোট ১.৪ বিলিয়ন ডলার চীনা ঋণ নিয়েছে। সে ঋণ পরিশোধে নাকি শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হবে মালদ্বীপের। আসলে এই প্রো-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী বুক ফুলিয়ে সবাইকে ‘হাইকোর্ট’ দেখাচ্ছে। ভেবেছে, সারা দুনিয়া এই চাতুরী বুঝবে না। প্রশ্ন তুলেছে তাহলে বাড়তি ৮০০ মিলিয়ন ডলার ভারতীয় ঋণ নিলো কেন আর এই ঋণের কিস্তি দেবে কিভাবে?
এখন প্রকৃত ঘটনাটা হলো, রাষ্ট্র কেন এখানে গ্যারান্টার হতে গেল এর পে সরকারের উপযুক্ত সাফাই থাকা দরকার ছিল। কিন্তু অন্যদিকের আরেক কথাও জেনে রাখা ভালো। তাহলে, ফেয়ার বিচার হবে। তা হলো, বিশ্বব্যাংকের নিয়ম ও কালচার অনুযায়ী যারা ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হয়ে যায় এরা কনসেশনাল সুদের (মাত্র ০.৭৫ শতাংশ যা ১ শতাংশেরও কম) ঋণ আর পাবে না। ২ শতাংশ সুদের ঋণের শ্লটে যেতে হবে। এছাড়া আরো একটা শ্লট আছে যেটাকে আইএফসি (ইন্টারনাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন) লোন বলে, যার সুদ ৪ শতাংশের কম নয়। আইএফসি বিশ্বব্যাংকেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে ওর লোন পাওয়া যায়। কিন্তু শর্ত হলো এই লোন কেবল মাত্র বেসরকারি কোম্পানিকে দেয়া হবে, সরকারকে নয়। এছাড়াও আরেক শর্ত হলো তবু সরকারকেই ওই লোনের গ্যারান্টার হতেই হবে। ইতোমধ্যে দুইটা বেসরকারি এক হাজার ২০০ মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পে আইএফসির লোন নেয়া হয়েছে। তার অন্তত একটা মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন প্রকল্প অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই এমন গ্যারান্টার হয়ে আছে। সম্ভবত এটাকে অনুকরণ করে মালদ্বীপে সরকারি গ্যারান্টারে চীনা বেসরকারি লোন নিয়েছে। আরো কথা আছে,এই লোন চুক্তি কিন্তু হয় ওই বেসরকারি লোন গ্রহীতা কোম্পানির সাথেই দাতার। যদি পরিশোধে কোনো সমস্যা দেখা দেয় সে ক্ষেত্রে সরকার যাতে লোন আদায়ে দাতার পক্ষ নেয়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
এই যদি হয় আমেরিকার বিশ্বব্যাংকের কালচার বা নিয়ম তাহলে আমেরিকার বন্ধু ভারত কেন এই প্রপাগান্ডা শুরু করেছে? ৯৫৩ মিলিয়ন ডলারের সরকার গ্যারান্টার বলে এই অর্থও ‘সরকার চীনা ঋণ নিয়েছে’ বলে পাড়া মাতাচ্ছে কেন? এগুলাই চরম অসততা ও আম প্রপাগান্ডা। চীন-ভারতের স্বার্থে মিথ্যা প্রপাগান্ডার লড়াই দেশের ওপর চড়ানো। এই হলো মালদ্বীপে ভাগ হয়ে দালালদের কায়কারবার থেকে পাওয়া শিক্ষা।
এখন তামাসা হলো, মালদ্বীপ নিয়ে ভারতের দুই লেখকের আশঙ্কা একই। তাই শিরোনামও প্রায় এক। দু’জনই আশঙ্কা করছেন, ভারত মালদ্বীপে টিকবে কিনা; প্রভাব টিকাতে আর কতদিন পারবে? প্রথম লেখক সুধা রামচন্দ্রনের আশঙ্কা, চীনের মতো ভারতের বেশি ঋণ দেবার মুরোদ নাই, তাই সমস্যা। আর দ্বিতীয় লেখক সীমা দাসগুপ্তের আশঙ্কা ভারত হেরে যাচ্ছে; কারণ সোলিহ-নাশিদ গ্রুপ প্রো-ইন্ডিয়ান হলেও সম্ভবত ইতোমধ্যে চীনের সাথে যোগাযোগ করে বসেছে। এছাড়াও মালদ্বীপে নন-পার্টিজান এক সংগঠন মালদ্বীপে ভারতের উপস্থিতি, হেলিকপ্টার ও আকাশ থেকে সমুদ্রসীমা মনিটরিংয়ের কিছু বায়ুযান সঠিক প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে সরবরাহ করা হয়নি। এ ছাড়া এটা পরিচালনার জন্য পাইলটদের ট্রেনিং শেষ করতে দেরি করে মালদ্বীপ ছাড়তে ভারতীয় সেনাদের গড়িমসি নিয়ে সবমিলিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে তারা পাবলিক সমাবেশে প্রতিবাদ করা শুরু করে দিয়েছে। তাই সীমা দাসগুপ্তার আশঙ্কা, ভারতকে মালদ্বীপ ছাড়তে হতে পারে। তাই তার লেখার শিরোনামই হলো সরাসরি, ‘মালদ্বীপে সামরিক অবস্থান হারানোর ঝুঁকিতে ভারত’। অর্থাৎ ভারতের ফকিরি ছ্যাঁচরামি করতে এখানেও দেখা যাচ্ছে। এতে ভারতের কোন ইজ্জত বাড়ে তা কে জানে!
এদিকে সীমা দাসগুপ্ত দুটা ভয়ঙ্কর তথ্য দিয়েছেন। সীমা লিখেছেন, ‘বর্তমান নেতা সোলিহ একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন, যেটা অনুসারে মালদ্বীপে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িত বিষয়ে ভারতীয় আদালতের রায় প্রযোজ্য হবে।’ এটা এক ভয়ঙ্কর নতজানু চুক্তি। আমাদেরও এটা নিয়ে আশঙ্কিত হওয়ার ব্যাপারে আছে। সারা দুনিয়ার রেওয়াজ হলো, স্থানীয় দেশের আদালত আর কিছু বিতর্ক দেখা দিলে আন্তর্জাতিক কোনো সালিশি আদালত যেমন বিশ্বব্যাংকের বিরোধ-বিতর্ক নিরসনের আদালত, না হয় ইউরোপীয় সমতুল্য সালিশি আদালতের কথা বাণিজ্য চুক্তিতে উল্লেখ থাকে।
এছাড়া আরেক তথ্য হলো; সীমা লিখছেন, ‘ভারতের নজরদারি বিমান ও হেলিকপ্টার মোতায়েন এবং এগুলো পরিচালনার জন্য মোতায়েন করা ভারতীয় সেনা ও সরঞ্জামাদির বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুর“ করেছে মালদ্বীপ। এমন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ও ছড়িয়েছে যে, মালদ্বীপের কিছু অংশকে ভারত নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে।’ মালদ্বীপের সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, ভারতের সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে মালদ্বীপের পাবলিকের মধ্যে গভীর হতাশা দেখা দিয়েছে যার গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক