সরকারি ব্যাংকের নতুন কর্মীদের জন্যও নতুন নিয়মে পেনশন

পেনশন

বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) ব্যাংক, বিমা ও পুঁজিবাজার খাতের কোনো নতুন চাকরিজীবীই আর বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী পেনশন পাবেন না।

সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক, কৃষি, কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ সব সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটবে। এমনকি পদ্মা অয়েল, যমুনা অয়েলসহ সরকারের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা রয়েছে, তেমন কোম্পানিগুলোতে নতুন যোগ দেওয়া কর্মীদের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থা থাকছে না।

পেনশন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১৩ মার্চ জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে তা জানা গেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগামী ১ জুলাইয়ের পর এসব প্রতিষ্ঠানে যাঁরা নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন, তাঁদের ‘প্রত্যয়’ নামক একটি পেনশন কর্মসূচির আওতায় আসতে হবে।

তবে বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের অবসরভোগী চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পাচ্ছেন, সেভাবেই পাবেন। ১০ বছর চাকরি আছে, এমন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা নতুন ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারেন অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও থেকে যেতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও পেনশন পেতে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে আসতে হবে প্রত্যয় পেনশন কর্মসূচির আওতায়। বর্তমানে প্রগতি, প্রবাস,সুরক্ষা ও সমতা নামে সরকারের চারটি পেনশন কর্মসূচি রয়েছে। গত বছরের ১৭ আগস্ট চালু হওয়া এসব কর্মসূচিতে দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি মিলিয়ে ১৪ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক হয়েছেন ২৬ হাজার ৮৫১ জন।

অর্থ বিভাগ গতকাল বুধবার প্রত্যয় কর্মসূচির রূপরেখা ঘোষণা করেছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে অর্থ বিভাগ যুক্তি দিয়ে বলেছে, কর্মচারীদের অবসরোত্তর-জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার প্রত্যয় চালু করেছে। আগামী জুলাইয়ের পর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যাঁরা যোগদান করবেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। এতে বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রত্যয় কর্মসূচি প্রযোজ্য হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করে প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবেই সব বলা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, প্রজ্ঞাপনটি এখন বিশ্লেষণ করবেন তাঁরা, প্রত্যয় তাঁদের নতুন কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য হবে কি না।

অর্থ বিভাগ বলেছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কমসংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানেই পেনশন কর্মসূচি চালু আছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আনুতোষিকের আওতাভুক্ত এবং তাঁদের জন্য প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল (সিপিএফ) ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর-সুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পেলেও মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁরা আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন।

প্রত্যয় বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান অর্থ হচ্ছে ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত কোনো ব্যবসায়-উদ্যোগ, কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অথবা শিল্প-বাণিজ্য সম্পর্কিত বা অনুরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান। আর স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যেগুলো কোনো আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে রয়েছে কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি।

প্রজ্ঞাপন জারির ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সম্প্রতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া ও মহাসচিব অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, একই বেতনকাঠামোর আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দুরভিসন্ধি রয়েছে কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ফেডারেশন এ প্রজ্ঞাপনের প্রত্যাহার চায়।

অর্থ বিভাগ বলেছে, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থা থেকে তা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। প্রত্যয় কর্মসূচিতে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে ওই কর্মচারী মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।

প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এ দুয়ের মধ্যে যেটা কম তা তাঁদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ জমা হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে।

আইসিবির চেয়ারম্যান সুবর্ণ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য বলছে, এটি আইসিবির নতুন কর্মীদের ওপর বর্তাবে। চূড়ান্ত বিচারে তা কতটা ভালো হবে, তা মূল্যায়ন করার সময় এখনই আসেনি।

অর্থ বিভাগ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ৩০ বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে চাঁদা জমা হবে ৯ লাখ টাকা, আর সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এ অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে। শুধু তাই নয়, জমা হওয়া চাঁদার ওপর বিনিয়োগ রেয়াত পাওয়া যাবে। পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত। পেনশন কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা বাবদ ৩২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় হয়।

সার্বিক বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, পেনশন বাবদ বাজেটে সরকারকে ভালো একটা অঙ্ক বরাদ্দ রাখতে হয়। নতুন যাঁরা চাকরিতে আসবেন, তাঁদের বয়স ৬০ বছর না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে পেনশন বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। ফলে সরকারের ওপর চাপ কমবে। এটাই সরকারের বড় স্বস্তি। তবে যাঁরা এখন পেনশন পান না, তাঁদের জন্য পদক্ষেপটি ইতিবাচক হয়েছে। তবে যেহেতু বৈষম্য তৈরির বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, পেনশন কর্তৃপক্ষ অংশীজনদের নিয়ে একটি বহুপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করতে পারে এবং ওই বৈঠকে উঠে আসা পরামর্শ বা সুপারিশ সরকার আমলে নিতে পারে।

prothom alo