উপজেলা নির্বাচনে বিভেদ-সংঘাত এড়াতে চায় আওয়ামী লীগ

উপজেলা নির্বাচনে বিভেদ-সংঘাত এড়াতে চায় আওয়ামী লীগ

একদিকে জোয়ার, অন্যদিকে ভাটা। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরব; রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নীরব। আওয়ামী লীগ নেতারা উপজেলার ভোটে লড়াইয়ের জন্য মুখিয়ে আছেন। তপশিল ঘোষণা না হলেও সরকার সমর্থক প্রার্থীরা আগেভাগেই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। বিপরীতে বিএনপিতে নেই উত্তাপ। এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল দলটি। সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও ভোট বর্জনের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি

উপজেলার ভোটে নতুন করে আর বিভেদ চাইছে না আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে তৈরি হওয়া সংঘাতময় পরিস্থিতি এবার এড়াতে চাইছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক কাউকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের আগেই দলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব নিরসনেও নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশল।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আগামীকাল শনিবার আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে। তৃণমূল নেতা ছাড়াও দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিও বিশেষ নির্দেশনা দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ বর্ধিত সভাটি সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে বর্ধিত সভার সব প্রস্তুতি গুছিয়ে আনা হয়েছে।

৪৯২ উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৪৮৫টিতে নির্বাচন হবে। তপশিল না দিলেও এসব উপজেলায় চার ধাপের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথম ধাপের ভোট হবে আগামী ৪ মে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপ ১১ মে, তৃতীয় ধাপ ১৮ মে ও চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ২৫ মে। তবে কোন কোন উপজেলায় কোন ধাপে নির্বাচন হবে, তা নির্ধারণ করা হবে ওই সব উপজেলা পরিষদের প্রথম বৈঠকের তারিখ অনুযায়ী। উপজেলা নির্বাচনের আগেই আগামী ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভোট হবে। ইসি থেকে এ দুটি সিটিসহ আরও বেশ কিছু পৌরসভা নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনও দলীয় প্রতীক ছাড়া, অর্থাৎ উন্মুক্তভাবে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও তার মিত্ররা স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনও বর্জন করছে– বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

এর আগে গত ৭ জানুয়ারির বিএনপিহীন জাতীয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করা হয়েছিল মনোনয়নবঞ্চিত দলের নেতাদের। এতে ২৯৯ আসনের সিংহভাগে মনোনয়নবঞ্চিত দলীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। কোথাও কোথাও একাধিক দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীও লড়াইয়ে নামেন। ফলে বিএনপিহীন নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করা গিয়েছিল। ভোটার উপস্থিতিও সন্তোষজনক বাড়ানো গিয়েছিল। নির্বাচনে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হন ৬২ জন। এর ৫৮ জনই আওয়ামী লীগ নেতা। যাদের বেশির ভাগ আবার দলীয় নৌকার প্রার্থীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জিতেছেন।

তবে নির্বাচনের আগে-পরে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক নেতাকর্মীর মধ্যে বড় রকমের রেষারেষি শুরু হয়। এর ফলে অনেক স্থানে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। অন্তত ছয়জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক নেতাকর্মী ছাড়াও তাদের বাড়িঘর ও স্থাপনায়ও হামলার ঘটনা ঘটে।

দলের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে, তা ছিল নজিরবিহীন। যদিও নির্বাচনের পরপরই যৌথ সভা ডেকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বিভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। পরে গত ২২ জানুয়ারি দলের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি বৈঠকেও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার তরফ থেকে অভিন্ন নির্দেশনা আসে। বৈঠকে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের আসন্ন নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীক ছাড়া অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কয়েকজন নির্বাচনকেন্দ্রিক কোন্দল নিরসনে বর্ধিত সভা ডাকার প্রস্তাবও দেন। উপজেলা নির্বাচনের আগেই বিরোধ মেটানো না গেলে স্থানীয় সরকারের এ ভোটে এর প্রভাব পড়ার শঙ্কার কথা জানান কোনো কোনো নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবারের বিশেষ বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন। এ ছাড়া তৃণমূলে সাংগঠনিক সফরসহ দলের আটটি বিভাগীয় কমিটির মাধ্যমেও বিবদমান নেতাদের ঢাকায় ডেকে দ্বন্দ্ব নিরসনের পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন ছাড়াও বর্ধিত সভায় দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের সব বিভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা পুনর্ব্যক্তও করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বার্তাও দেবেন তিনি। এ কারণেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত দলীয় এমপিদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র এমপিদেরও ওই সভায় বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া বর্ধিত সভা থেকে আগামী ১৪ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি পদে নির্বাচনের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। মনোনয়নবঞ্চিতদের আগামী দিনে দলের জন্য কাজ করার আহ্বানসহ পরে তাদের মূল্যায়ন করার আশ্বাসও দিতে পারেন দলীয় প্রধান।

শনিবারের বিশেষ বর্ধিত সভায় দ্বাদশ সংসদের দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, জেলা/মহানগর ও উপজেলা/থানা/পৌর (জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভা) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের দলীয় চেয়ারম্যানরা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া সভায় সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দলীয় মেয়র এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার নেতার ওই সভায় উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিশেষ বর্ধিত সভা থেকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সব দ্বন্দ্ব ভুলে দলকে আরও গতিশীল করতে নেতাদের দিকনির্দেশনা দেবেন। উপজেলা ছাড়াও সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি নির্বাচন প্রসঙ্গেও বার্তা দেবেন তিনি।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সমকালকে বলেন, সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর দলকে সুসংগঠিত করা, বিভেদ ভুলে উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভুল বোঝাবুঝি নিরসন করাই এবারের বিশেষ বর্ধিত সভার লক্ষ্য। কোন্দল নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা আসতে পারে বর্ধিত সভা থেকে।

samakal