আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে। এই জোটের শরিকরা জানে না তাদের পরবর্তী করণীয়। জোটটিকে আবারও সক্রিয় করতে শরিক দলগুলো তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগের দিকে। তারা এখন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষায় রয়েছে।
যদিও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং সরকার গঠনের দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও শরিকদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ। আবার ১৪ দলের কোনো বৈঠক না হওয়ায় শরিক দলগুলো তাদের বক্তব্য তুলে ধরারও সুযোগ পায়নি। এ অবস্থায় হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে চলতে থাকা ১৪ দল অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আগামীতে ১৪ দলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা, সেটা নিয়েই শঙ্কায় পড়েছেন শরিক দলগুলোর নেতারা।
তাদের দৃষ্টিতে, বিদ্যমান পরিস্থিতি জোটের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে জোটের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক এবং জোটকে সক্রিয় করার ন্যূনতম আশ্বাস মিললেও সার্বিক সংকটের কিছুটা হলেও নিরসন হতে পারে। এতে শরিকদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ দূর হতে পারে। জোটটিও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে শিগগির সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠকের ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
১৪ দলীয় জোটের এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শুরু গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে। ওই নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে শরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তিনটি, ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি ও জাতীয় পার্টি-জেপি একটি আসনে ছাড় পায়। যার মধ্যে তিনটিতেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হন শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা। হেরেছেন জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সহসভাপতি মোশাররফ হোসেন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর কোনো সংসদ নির্বাচনে এবারের মতো এত কম আসন পায়নি শরিকরা। আগের তিনটি নির্বাচনে জোট শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ১২-১৬টি আসনে ছাড় পেয়ে গড়পড়তায় ছয়-সাতটি আসনে জিতেছিল। এবার অর্ধেকের কম আসনে ছাড় ও জয় পেলেও বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। এর পরও শরিক দলগুলোর প্রত্যাশা ছিল, শরিক দলগুলোর দু-একজন নেতাকে অন্তত মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই দেওয়া হবে। তাও হয়নি। শরিক দলগুলোর একমাত্র প্রাপ্তি সংরক্ষিত মহিলা আসনের একটি পদ লাভ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৪ দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির একাংশের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কানন আরা সংরক্ষিত মহিলা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দল গঠন হয়। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ ২৩ দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে এই জোট যাত্রা শুরু করে। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকারও ছিল তাদের। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারে জোট শরিকদের কয়েকটি মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ অনেকটাই ‘একলা চল’ নীতি নিয়ে চলছে। ফলে ২০১৯ সালে তৃতীয় দফায় গঠিত সরকারের পর এবার চতুর্থ মেয়াদের সরকারের মন্ত্রিপরিষদে শরিক দলের কোনো নেতার ঠাঁই মেলেনি।
অন্যদিকে ১৪ দলের স্থবিরতার এই প্রভাব শরিক দলগুলোকেও কিছুটা অভ্যন্তরীণ বিরোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোনো কোনো শরিক দলের সভায় দলীয় নেতারাই এখন ১৪ দলে থাকার প্রয়োজনীয়তা কিংবা লাভালাভ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। জবাবে শীর্ষ নেতারা দৃশ্যত কোনো প্রাপ্তিযোগ দেখাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব বদলের প্রশ্ন উঠলে দলগুলোতে ভাঙন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি নেতাকর্মীর মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভও তৈরি হচ্ছে।
সূত্রমতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এমন পরিস্থিতিতেই জাসদ ভেঙে বাংলাদেশ জাসদ গঠিত হয়েছিল। কিছুদিন বাংলাদেশ জাসদ ১৪ দলের শরিক হিসেবে কার্যক্রম চালালেও পরে ঘোষণা দিয়েই জোট ছাড়ে। এরও আগে-পরে ১৪ দলে থাকা না থাকার প্রশ্নে বিরোধের জের ধরে ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দলও ভেঙেছে।
জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেছেন, ১৪ দলের রাজনীতি আছে। আদর্শও রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগই এটাকে অকার্যকর করে রেখেছে। কাজেই ১৪ দলের ভবিষ্যৎ কী, সেটা নির্ভর করছে এই জোটকে নিয়ে আওয়ামী লীগ কী সিদ্ধান্ত নেবে, তার ওপর।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ১৪ দলীয় জোট সক্রিয় থাকবে, কী থাকবে না– সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের ওপর। সার্বিক বিষয় নিয়ে ১৪ দলের বৈঠক ছাড়াও জোটের প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশা করছি আমরা। এগুলো যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দলের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ যদি এই জোটের গুরুত্ব বুঝতে পারে, তাহলে এটা সক্রিয় হবে। আর না বুঝতে পারলে ১৪ দল এখন যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে।
১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, ১৪ দলীয় জোটের নেতারা আগে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে বসবেন। তার পর আমরা নিজেরা বসে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করব। সে জন্যই আমরা অপেক্ষায় রয়েছি, কবে নেত্রী আমাদের বৈঠকের জন্য ডাকেন।
samakal