মিনার রশিদ
মহিউদ্দীন চৌধুরীর ছেলে হিসাবে উপমন্ত্রী নওফেল বাপের নাম ঠিক ঠাক রাখছে বলেই মালুম হচ্ছে। বাপকা বেটা হিসাবে তিনি জাতির পক্ষ থেকে একটা সাব্বাশ পেতেই পারেন। মূর্তি বা ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে ঘাড় ত্যাড়া মওলানাদের ঘাড় মটকানোর হুমকি দিয়েছেন। ২০১৩ সালের ৫ই মের ঘাড় মটকানোর কথা দেশের জনগণ যেহেতু ভুলে নাই। কাজেই এই হুমকিটিই বোধ হয় যথেষ্ঠ হবে।
আওয়ামী লীগ ও তার পোষ্য বুদ্ধিজীবীগণ এক কুইক-রাজাকার-টেস্টিং-কিট বানিয়েছে যাতে সর্বশেষ হেফাজত ও চরমোনাইয়ের পীর আটকা পড়েছেন। চরমোনাই পীরের দাদা যে রাজাকার ছিলেন এতদিন পর সেটাও জানা গেল। অথচ জেনে এসেছি যে ইনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ইসলাম পন্থী দল। চরমোনাইয়ের পীর এবং তার দল বিশেষ হেকমতে উদ্ধার পেলেও আটকে গেছেন সম্ভবত হেফাজতের অন্যতম নেতা মাওলানা মামুনুল হক। উনি কতটুকু টিকে থাকতে পারবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। জামায়াতের সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক আবিস্কার করে ফেলা হয়েছে। কাজেই দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত !
মাওলানা মামুনুল হক ও চরমোনাইয়ের পীর তাদের কেউই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভাঙতে চান না কিংবা তা বলার আপাতত সাহস রাখেন না। ধর্মীয় দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্য নয় বিধায় উনারা শুধু মূর্তি ভাঙতে চান। তবে হেফাজতে ইসলামের এই দাবিটি মানা এবার কঠিন হবে বৈকি। কারণ হেফাজতে ইসলামের বিপরীতে মাঠে নেমেছে শাহরিয়ার কবিরদের নেতৃত্বে ষাটটির মত ‘হেফাজতে মূর্তি’র দল।
অর্থাৎ ইসলামের হেফাজতের বিপরীতে মূর্তি বা ভাস্কর্যের হেফাজতে রাস্তায় নেমেছে ঘাদানিক সহ প্রায় অর্ধ শতাধিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠণ। গত বারো বছরে এদেশের মানুষ অনেক ইস্যুতে ক্ষুদ্ধ হয়েছে, তখন রাস্তায় এদের টিকিটিরও দেখা মেলে নি। যদিও এরা নিজেদেরকে স্রেফ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠণ বলে দাবি করে। এই সব ব্যানার ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাছিল ই এদের মূল লক্ষ্য। এই সুশীল গ্রুপটি আবার ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের চরম বিরোধী। কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে এদের বিবেকে একটুও বাজে না। যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই মেওয়াটি ব্যবহার করেন তারাও এটি ধরতে পারেন না।
এই ঘরানার সুশীল আলী জাকেরের মৃত্যুর পর বিএনপির জেনারেল সেক্রেটারী উচ্ছসিত ভাষায় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন । অথচ জীবিত থাকতে নিজের সকল শক্তি ও সামর্থ বিএনপির বিনাশে ক্ষয় করে গেছেন এই আলী জাকের। সৌভাগ্য আলী জাকেরদের, দুর্ভাগ্য এদেশবাসীর !
এই গ্রুপটি কখনোই একা নামে না। এদের সামনে থাকে লীগ, পেছনে থাকে মিডিয়া। হুক্কা হুয়া রবে এরা যে সুর তুলে-অতি সহজেই তাকে একটা সার্বজনীনতার রূপ দিয়ে ফেলে ।
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল নাগাদ বিএনপি আন্দোলন করতে গেলেই রব তুলতো, যুদ্ধপরাধীদের বিচার বন্ধ করতেই বিএনপি আন্দোলন করতে চাচ্ছে। এই কথাটি শোনার পর বিএনপি থমকে যেত। আগের লেখায় একটি গল্প বর্ণনা করেছিলাম। তিন বাটপারের কথা শুনে ব্রাহ্মণ যেমন তার মাথার ছাগল ছানাকে ছুড়ে মেরেছিল, বিএনপিও এদের কথা শুনে তেমনি ভড়কে যেত। তার ফলাফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
উক্ত খাজেগানে মজলিসে এখন প্রশ্ন ছোড়া হচ্ছে, হেফাজতে মূর্তির এই আন্দোলনে বিএনপি নীরব কেন ?
জানি না, এই প্রশ্নটি বিএনপি কীভাবে মোকাবিলা করে !
মূর্তি আর ভাস্কর্য নিয়ে দেশের মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে । তা দেখে মনের মধ্যে আগ্রহ জন্মে যে বাঙালীর সাংস্কৃতিক গুরুরা শব্দ দুটিকে কীভাবে দেখেন। তজ্জন্যে গুগল সার্চ করে বেশ কিছু শিরোনাম পেয়ে যাই । কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সহ সেখানকার গণমাধ্যম দিব্যি বিদ্যাসাগরের মূর্তি, গান্ধীর মূর্তি লিখে যাচ্ছে। এমনকি বিবিসি বাংলাও তা অনুসরন করছে। কিন্তু আমাদের দেশে শেখ মুজিবের মূর্তিকে ভাস্কর্য বলার তাগিদটি কৌতুহলোদ্দীপক। এরা শাক দিয়ে মাছটি কেন ঢাকতে চাচ্ছেন তা সহজেই বোধগম্য !
বিবিসি নিউজ বাংলা ২০১৯ সালের ১৫ ই মে সংখ্যায় শিরোনাম করে , কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পেছনে কোন রাজনীতি। এখানে বিদ্যাসাগরের একটি মূর্তি বা ভাস্কর্যের ছবিও ছাপে। আনন্দ বাজার পত্রিকাও ‘৩৭৫ কেজির বিদ্যাসাগর মূর্তি, বোলপুর থেকে যাবে শিলং ‘শিরোণামে একটি সংবাদ ছাপায় তাদের অনলাইন সংস্করণে গত ২৩শে নভেম্বর ২০২০ সালে। সংবাদ শিরোনামটিতে বিদ্যাসাগরের একটি আবক্ষ মূর্তি এবং তার কারিগরের ছবিও ছাপে। বিবিসি নিউজ বাংলা ১৯শে অক্টোবর ২০১৯ অনলাইনে শিরোনাম করে -‘বর্ণবাদী’ গান্ধীর মূর্তি প্রত্যাখ্যান করল ম্যানচেষ্টারের শিক্ষার্থীরা। এরকম গুগল করলে অনেক সংবাদ শিরোনাম বেরিয়ে আসবে ।
শেখ মুজিবের মূর্তি বানানো জায়েজ কি না আমি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছি না । আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য এই সব বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা বা হিপোক্রেসি নিয়ে। সকল অপকর্ম করার আগে জায়েজ বানিয়ে করার এই প্রবণতাটি অত্যন্ত মর্মদায়ক ।
শেখ মুজিবের মূর্তি বানানো প্রয়োজন মনে করলে তা সরাসরি বলুন । এখানে রাখঢাকের কী প্রয়োজন রয়েছে ? চিত্র নায়ক এবং বিনা ভোটের এমপি ফারুক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সংসদে আসেন, আমাদের দেখেন ও কথা শুনেন। এই সংসদেরই এক এমপি জানিয়েছিলেন, তার পুত্রবধূ কলকাতায় গেলে পূজা করেন এবং ঢাকায় এলে নামাজ পড়েন।
দেশের মানুষের (সংখ্যা গুরুদের ছাড়া) ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। কাজেই যা বলার, স্বাধীন ভাবেই বলুন, ভয়হীন চিত্তে বলুন ।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জিয়ার মূর্তি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলে মুজিবের মূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন ?
যারা মূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের কাছে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দুটোই আপত্তিকর। তবে জিয়ার মূর্তি ছোট্ট পরিসরে দুয়েকটি জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে স্থানীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক আবেগ ধারণ করে। সমাজের যে অংশটি জিয়ার মূর্তি স্থাপন করেছেন তারা কিন্তু মুজিবের মূর্তি নিয়ে আপত্তি তুলছেন না।
তাছাড়া জিয়ার মূর্তি স্থাপনে রাষ্ট্রীয় ভাবনা বা তাগিদ কাজ করে নাই। মুজিবের বেলায় তা করেছে এবং এটার ব্যাপকতা সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। প্রতিবাদের তীব্রতাও তাই এখন বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। তাছাড়া চিত্র নায়ক ফারুকের মত অনেক ভক্ত সংসদ ভবনে মুজিবকে আসতে দেখেন, সংসদ ভবনে জিয়ার আত্মার আগমণ নিয়ে এরকম কিছু এখনও শোনা যায় নি। দুয়েক প্রজন্মের পরের ফারুকেরা এই সব নিস্পাপ ভাস্কর্যের ভেতরে মুজিবের স্পিরিট ঢুকে পড়েছে বলে মনে করে পুজা শুরু করতে পারেন পারেন ।
মুজিব বর্ষের এক অনুষ্ঠানে লেজার রশ্মি দিয়ে শেখ মুজিবের স্পিরিটকে উড়োজাহাজ থেকে নামানো হয়েছে এবং সেখানে উপস্থিত এয়ার ফোর্সের কয়েকজন অফিসার রীতিমত স্যালুট ঠুকে বসেছেন !
আলেম সমাজ এবং দেশবাসীর ভয়টি সম্ভবত সেখানেই।
দেশের মানুষ দেখছে, তাদের ইহকাল শেষ ! এখন পরকালও ডুবতে বসেছে !!