চীনের চিকন ফাঁদে বাংলাদেশ

চীনের চিকন ফাঁদে বাংলাদেশ – প্রতীকী ছবি

  • রিন্টু আনোয়ার

যুদ্ধ বা গণ্ডগোল মিয়ানমারের অভ্যন্তরে। সীমান্ত পেরিয়ে তাদের গোলায় লাশ পড়ছে বাংলাদেশে। এক সময় জান্তাদের তাড়ায় ছুটে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে নিরীহ-নিরস্ত্র রোহিঙ্গারা। এখন সেখানকার বিদ্রোহী বা স্বাধীনতাকামীদের ধাওয়ায় টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ-বিজিপি সদস্যসহ ওই জান্তা সম্প্রদায়ের সশস্ত্র-শক্তিমানরা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। বছর কয়েকের মধ্যে ঘটনার কী হেরফের! দৃশ্যায়নের কী ব্যবধান!

আগে মিয়ানমারের বিতাড়িত নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্তের কূটনীতি করেছে বাংলাদেশ। সেই রোহিঙ্গারা দিনে দিনে আপদ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জন্য। মিয়ানমার তাদের ফেরত নিচ্ছে না। প্রতিবেশী ভারত-বন্ধু চীনসহ বিভিন্ন দেশ নানান মিষ্টি কথা বললেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করার প্রশ্নে করছে কেবল চাতুরী। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের আর একজনকেও এখানে জায়গা না দেয়ার। কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। এবার আর নিরস্ত্র-নিরীহ নয়, একেবারে সশস্ত্রদেরই অনুপ্রবেশ ঘটছে। তাদেরকে চিকিৎসাসহ মানবতা দেখাতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা নিয়ে চাতুরী করা ভারতও এবার আচ্ছা রকমে আক্রান্ত। সেখানেও আছড়ে পড়ছে মিয়ানমারের অনেকে। কিছু সংখ্যককে পুশব্যাক করছে, কিছু সংখ্যক লুকিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। নিজেদের জন্য বোঝা হয়ে ওঠায় এখন ভারত এ প্রশ্নে গা ঝাড়া দিচ্ছে। এ রকম সময়ে ভারত সফরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ভারতের বিশেষ বিশ্বস্ত-পরীক্ষিত তিনি। নতুন সরকার গঠনের পর এটিই তার প্রথম ভারত সফর। সফরকালে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দু’জনই টেনে এনেছেন মিয়ানমারের সীমান্ত পরিস্থিতি। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ করবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, আন্তঃসীমান্ত কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পর্যালোচনা হয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই কমন প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। বেশ কিছু দিন ধরে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্ঘাতের পরিণাম ভুগতে হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশকেই। দুই দেশেই মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শত শত সদস্য পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামলাতে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ করার কথা বললেও ঠিক কিভাবে তারা কাজ করবে, তা এখনো অস্পষ্ট। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুদীর্ঘ মিয়ানমার সীমান্তের পুরোটা জুড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের মতো কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশকেও আগামী দিনে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে ভারত থেকে।

সমস্যা বেড়া থাকা না থাকায় নয়। কাঁটাতারের বেড়া কেন, উঁচু প্রাচীরের বেড়ায়ও এ ধরনের সমস্যার ফয়সালা আসে না, তা ইতিহাসে প্রমাণিত। পানি এরইমধ্যে অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রান্তের স্থানীয়দের ধারণা ওপারের ক্যাম্পগুলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীগোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। সে জন্যই সীমান্তের ওপাশে ক’দিন ধরে গোলাগুলি কমেছে। পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে। এটি এখানকার ধারণা। ওখানে আসলে কী হচ্ছে, সে সংক্রান্ত তথ্য কম। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মিসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান লড়াইয়ের কারণে যেন কারো কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য বিজিবি মহাপরিচালক স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। এও বলেছেন, ‘এটা একেবারে বর্ডার সংলগ্ন। আমাদের সাধারণ জনসাধারণের জন্য এই জায়গাটুকু নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যখন গোলাগুলি শুরু হয়, সেই সময়টুকুতে তো একেবারেই নয়।’ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকা আদৌ সুখকর নয়। তা বাংলাদেশের স্থানীয়দের বেলায়ও, মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্যও। সীমান্তরক্ষী বিজিবির জন্যও এটি বাড়তি কাজ। বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ বিজিবি জানিয়েছে, চলমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসাদের নিরাপত্তা, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে বিজিবি। আহতদের চিকিৎসাও দিতে হচ্ছে। সীমান্তে চলমান অস্থিরতার মধ্যে বিজিবিকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে। মিয়ানমারের নিজেদের গোলযোগের কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিজস্ব সীমানায় গোলা নিক্ষেপের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। দ্রুত তাদের নাগরিকদেরকে ফেরত নিতেও বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব বিবৃতিমূলক কূটনীতির নিউজ ভ্যালু আছে সত্য। কিন্তু এতে সমস্যা সমাধানের দাওয়াই নেই। বিপরীতে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে মিয়ানমার পরিস্থিতি। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সীমান্তবর্তী প্রদেশে সামরিক সরকারের লড়াই এখন চরমে।

রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। বছর তিনেক আগে মিয়ানমারে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে হটিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক সরকার। এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জান্তাবিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে। একই সাথে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন তাদের শক্তি আরো বাড়িয়ে তোলে। এসব গ্রুপও জান্তা সরকারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে। তিন বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির শান ও রাখাইন প্রদেশে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা এ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। গত তিন বছরে এসব গোষ্ঠী মিয়ানমারে ৩০০’র বেশি সামরিক চৌকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে।

পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই সঙ্ঘাত কিভাবে শেষ হবে তার কোনো সুস্পষ্ট নিশানা দেখা যাচ্ছে না। দেশটির এবং নাগরিকদের কী অবস্থা হবে, তাও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রতিবেশী ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই আক্রান্ত। প্রভাবশালী দেশ চীন কী করছে, এ প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। মিয়ানমারের ওপর একচেটিয়া প্রভাব রয়েছে চীনের।

মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর অবস্থা তাদেরই রয়েছে। উভয়ের হাতেই চীনের অস্ত্র। মাসখানেক আগেও চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল শুধু চীন সীমান্তসংলগ্ন শান প্রদেশের জন্য। এই প্রদেশটিতে ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সঙ্ঘাত চলছে। এই প্রদেশে বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছে। চীন সেখানে মধ্যস্থতা করেছে তার নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের কাছে গৌণ। যুদ্ধবিরতি নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও তা স্পষ্ট। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীন সীমান্তে তাদের অধিবাসীদের ক্ষতি না করা এবং মিয়ানমারের ভেতরে চীনের প্রকল্পে যারা কাজ করছে তাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে নিশ্চয়তা দিয়েছে উভয়পক্ষ। মোটকথা, মিয়ানমারের অস্থিরতা যাতে সীমান্ত ছাপিয়ে চীনের ভেতরে না যায় সেটাই তাদের উদ্বেগের বিষয়। কারণ, চীনের বিভিন্ন অপরাধী-চক্র শান প্রদেশে কিংবা মিয়ানমারের ভেতরে বসে নানা ধরনের সাইবার অপরাধ, মাদক, মানব-পাচারে জড়িত।

চীন চিকন বুদ্ধিতে তার হিসাব মেলাচ্ছে। ভারতও মেলাবে। বাংলাদেশ কী করবে? তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা বিষে নীল হওয়া বাংলাদেশ নিয়ে কম খেলছে না কেউই। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার নামে রাজনীতি-কূটনীতি হয়েছে প্রচুর। মানবতার স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক পদক-পুরস্কারের বুদ্ধি-টোপ-লোভ ছিল প্রচুর। সেটা ফলেনি। উপরন্তু আপদ চেপেছে। দিনে দিনে বিষফোঁড়া হয়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে কার্যকর সহায়তা মেলিনি। বরং তামাশা হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের আলাপও নেই। তারওপর নতুন করে বোঝা চাপছে। মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর যুদ্ধের ভয়াবহতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া আরো জটিল করে দিয়েছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে কথাবার্তা এখন কার সাথে হবে? মিয়ানমারের জান্তার সাথে না আরাকান আর্মির সাথে?

রাখাইনে আরাকান আর্মি একটি রাজনৈতিক শক্তি। রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় বসবাস করত এবং এখনো যেসব এলাকায় তারা বসবাস করে সেখানে আরাকান আর্মি আরো শক্তিমান। কিন্তু মিয়ানমারের কাছে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিদ্রোহী। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকে না। আবার আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা না করে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আলোচনাই বা কিভাবে সম্ভব? বড় রকমের একটা নতুন জটিলতার ঘুরপাকে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে সরকারের তরফে। বাস্তবে সহযোগিতা কদ্দুর মিলবে তা বোঝা যাবে পরে।

Nayadiganta