ভিডিও ফুটেজ প্রায় দুই বছর আগের। ২০২২ সালের এই ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, হামাস যোদ্ধারা একটি প্রশিক্ষণ এলাকায় নিবিড়ভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁরা রকেট হামলা চালাচ্ছেন, নকল শত্রুদের ধরছেন। চারপাশে ইসরায়েলিদের আদলে বানানো ভবন।
ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সদ্যনির্মিত প্রশিক্ষণ শিবির। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রশিক্ষণ শিবির বানানো হয়েছে গাজা–ইসরায়েল সীমান্তবর্তী ইরেজ ক্রসিংয়ে। ওই পথে মানুষজনকে চলাচল করতে দেখা যায়। গত সপ্তাহে সেই প্রশিক্ষণ শিবির থেকেই হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন।
আরেকটি ভিডিও এক বছর আগে ধারণ করা। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হামাস যোদ্ধারা প্যারাগ্লিডারে করে উড্ডয়ন–অবতরণ করছেন। ৭ সেপ্টেম্বর হামলায় ইসরায়েলে ঢুকতে এই কৌশল ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন হামাস যোদ্ধারা।
গত দুই বছরের হামাসের প্রশিক্ষণের ভিডিও বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, গাজার অন্তত ছয়টি স্থানে হামাস যোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, ছয়টি স্থানের মধ্যে অন্তত দুটি শিবির গাজা–ইসরায়েল সীমান্ত থেকে এক মাইলের কম দূরত্বে। এই সীমান্ত খুবই সুরক্ষিত এবং সব সময় ইসরায়েলি সেনাদের টহল থাকে। বাকি স্থানগুলোর মধ্যে একটি মধ্য গাজায় এবং বাকি তিনটি দক্ষিণ গাজায়।
দুই বছরের স্যাটেলাইট ছবিও বিশ্লেষণ করেছে সিএনএন। এই ছয় স্থানের কোথাও সেনাবাহিনীর কোনো অভিযানের উদ্যোগ দেখা যায়নি। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে কেবল এসব প্রশিক্ষণ শিবিরে হামাসের তৎপরতা ছিল—এমন নয়। এগুলোর বাইরে দুই বছর ধরে কৃষিজমিকে প্রশিক্ষণ শিবির বানিয়ে তারা কাজ চালিয়ে গেছে।
ইসরায়েলে হামাস যোদ্ধাদের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী ব্যর্থতা ও অভিযানের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সত্য কথা হচ্ছে, হামাস সমতল ভূমিতে দুই বছর ধরে প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছে। তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী কেন এসব প্রশিক্ষণ শিবিরের খোঁজ পেল না এবং ৭ অক্টোবরের হামলা রুখতে পারল না।
সিএনএন এ বিষয়ে জানতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মন্তব্য জানতে চেয়েছিল। জবাবে আইডিএফের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র লে. কর্নেল জোনাথন কনরিকাস বলেন, এসব তথ্য ‘নতুন কিছু নয়’।
জোনাথন বলেন, হামাসের ‘অনেক প্রশিক্ষণ এলাকা’ রয়েছে। গত কয়েক বছরে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের অনেক প্রশিক্ষণ এলাকা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কোথায় হামাস প্রশিক্ষণ নিয়েছে
হামাস যে ছয়টি এলাকায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তার অন্তত দুটি গাজা–ইসরায়েল সীমান্তের সুরক্ষিত এলাকায় ছিল। গাজা–ইসরায়েল সীমান্ত থেকে এক মাইলের কম দূরত্বে এসব প্রশিক্ষণ শিবিরের অবস্থান।
জোনাথন বলছেন, গত দুই বছরে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর বড় কোনো সংঘাত হয়নি। সর্বশেষ হয়েছিল ২০২১ সালে। এ সুযোগে ‘বেসামরিক স্থাপনার’ আদলে হামাস হয়তো প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলেছে।
ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা যা–ই বলুন, ছয়টি স্থাপনার মধ্যে পাঁচটিই আদতে কোনো বেসামরিক স্থাপনার মতো ছিল না। কেবল উড্ডয়ন–অবতরণের প্রশিক্ষণ শিবিরটি দেখে কিছু বোঝার উপায় ছিল না।
সব শিবিরে মাটি দিয়ে এমনভাবে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে, প্রশিক্ষণ শিবিরের ভবনের চেয়ে তার উচ্চতা ছিল বেশি। ব্লক আর সিমেন্ট দিয়ে এসব ভবন বানানো হয়েছে। বেশির ভাগ ভবনের ছাদও ছিল না।
কিছু প্রশিক্ষণ শিবিরে ফটক ও কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। আশপাশের সড়ক আঁকাবাঁকা এবং বেশির ভাগ সড়কই মসৃণ নয়।
এসব বিষয়ে সিএনএনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে জোনাথন কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি কেবল বলেন, ‘এসব গোয়েন্দাদের জটিল বিশ্লেষণের বিষয়। একই সময়ে আমরা একটা যুদ্বের মধ্যে রয়েছি। যুদ্ধ শেষে আইডিএফ এসব নিয়ে তদন্ত করবে।’
সমতলে দৃষ্টিসীমায় প্রশিক্ষণ
লেবাননভিত্তিক হামাসের ন্যাশনাল রিলেশন অ্যাব্রডের প্রধান আলি বারাকা আরটিকে বলেন, দুই বছর ধরে হামাস এই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সিএনএন মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়, হামাস সামাজিক মাধ্যমে তাদের ভিডিও প্রকাশের আগে মাসের পর মাস, কখনো কখনো বছরজুড়ে প্রশিক্ষণ চালিয়েছে। ভিডিওতে ৭ অক্টোবর হামলার পূর্বাভাসও কিছুটা ছিল।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হামাস যোদ্ধারা প্রশিক্ষণে প্যারাগ্লিডার নিয়ে উড্ডয়ন, অবতরণ এবং হামলা চালাচ্ছেন। মেটাডেটায় দেখা যায়, এই ভিডিও এক বছর আগের। সূর্যের আলো–ছায়া দেখে বোঝা যায়, ভিডিওতে ধারণ করা এই প্রশিক্ষণ দিনের কয়েক ঘণ্টা ধরে বা কয়েক দিন ধরে চলছিল।
গাজা–ইসরায়েল সীমান্তবর্তী প্রশিক্ষণ শিবির থেকে ৭ অক্টোবর হামলার দিন ভোরে প্যারাগ্লিডারে করে হামাস যোদ্ধারা উড্ডয়ন করেছেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, যে প্রশিক্ষণ শিবিরে উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়েছিল, সেখানে হামাসের নিজেদের তৈরি ড্রোনও ব্যবহৃত হয়েছিল। মেটাডেটার বিশ্লেষণ বলছে, প্যারাগ্লিডিং পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ার পর এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছে, যা হামলার কয়েক মাস আগে ধারণ করা।
হামাসের একটি প্রোপাগান্ডা ভিডিওতে দেখা যায়, এতে তারা ৭ অক্টোবর এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তারা ইসরায়েলের আদলে ভবন ও নকল সড়ক বানিয়েছিল। সেই ভবন আর সড়ক ধরে তাদের হামলার প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যায়।
স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রশিক্ষণ শিবির গত এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বানানো হয়েছে।
ছয় প্রশিক্ষণ শিবিরের তিনটিতে নকল ইসরায়েলি ট্যাংক বানিয়ে বসানো হয়েছে। হামাস যোদ্ধাদের আরপিজি ও অন্যান্য বিস্ফোরক নিয়ে এসব ট্যাংককে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে দেখা যায়।