ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ঐতিহাসিক শুনানি শুরু হয়েছে। শুনানিতে অংশ নিয়ে অবিলম্বে এই দখলদারত্ব অবসানের দাবি জানিয়েছে ফিলিস্তিন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ওই আদালতে শুনানি শুরু হয়। বাংলাদেশসহ ৫২টি দেশ ও ৩টি সংগঠন শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে। শুনানি চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বাংলাদেশ, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ১১ দেশ আজ মঙ্গলবার শুনানিতে অংশ নেবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিজেতে এ শুনানি শুরু হলো। ইসরায়েলের দখলদারত্ব, অবৈধ বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করার অপতৎপরতা পর্যালোচনা করতে ২০২২ সালে আইসিজের প্রতি ওই আহ্বান জানিয়েছিল সাধারণ পরিষদ। তাতে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে আইসিজের নির্দেশনা ও মতামত চেয়েছে সাধারণ পরিষদ। তবে আইসিজে এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা বা মতামত দিলে তা মানার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
গতকাল আইসিজের শুনানির প্রথম দিনে শুধু ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। শুনানিতে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল বৈষম্য ও জাতিবিদ্বেষী অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এতে ফিলিস্তিনিরা পরাধীনতা, উদ্বাস্তু জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রিয়াদ আল-মালিকি বলেন, ‘অবৈধ দখলদারত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে একটাই সমাধানের কথা বলা রয়েছে। সেই সমাধান হলো অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে দখলদারত্বের সম্পূর্ণ অবসান।’
শুনানিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী পল রেকলার আদালতকে বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো ও সম্ভাব্য সর্বশেষ সমাধান দুই রাষ্ট্র গঠন, যা ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের জন্যই জরুরি। তবে এই সমাধানের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্ব।’
পল রেকলার আদালতে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ইসরায়েলের এই দখলদারত্বের মূল লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনের বেশির ভাগ ভূখণ্ড স্থায়ীভাবে দখল করে নেওয়া এবং এসব ভূখণ্ডে খুব কমসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে বসবাস করতে দেওয়া।
শুনানির সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের দূত রিয়াদ মনসুর, আইনবিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদেরা উপস্থিত ছিলেন।
৫২টি দেশ ও ৩টি সংগঠনের অংশগ্রহণে শুনানি শেষে একটি মতামত বা নির্দেশনা দেবেন আইসিজে। ধারণা করা হচ্ছে, আইসিজের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা আসতে আনুমানিক ছয় মাস সময় লাগতে পারে।
এর আগে ২০০৪ সালের জুলাইয়ে সাধারণ পরিষদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলি দখলদারত্ব বিষয়ে শুনানি নেয় আইসিজে। তখন জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এই আদালত বলেছিলেন, দখল করা পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যে দেয়াল নির্মাণ করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে আদালত সেই দেয়াল ভেঙে ফেলতে বলেছিলেন। কিন্তু দুই দশক পেরিয়ে গেলেও সেই দেয়াল ভাঙেনি ইসরায়েল।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান হামলায় ২৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার মধ্যেই আইসিজেতে এই শুনানি শুরু হলো। তবে গাজায় চলমান গণহত্যা বন্ধে একই আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলার সঙ্গে গতকাল শুরু শুনানির যোগসূত্র নেই।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে বসতি গড়ে তোলা শুরু করে। ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনের অন্য ভূখণ্ডেও বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি এসব ভূখণ্ডকে ‘দখলকৃত’ বলে আসছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। একই সঙ্গে এসব ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘের মতে, দখলদারত্বের অবসানই শান্তি ফেরানোর একমাত্র পথ।
আইসিজেতে শুনানির শুরু নিয়ে গতকাল একটি বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। লন্ডনভিত্তিক সংস্থাটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘জাতিবিদ্বেষী কার্যকলাপে উসকানি ও পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে ইসরায়েলকে অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর দখলদারত্ব বন্ধ করতে হবে।’
শুনানিতে কারা অংশ নিচ্ছে
ইসরায়েল আইসিজের এ শুনানিতে অংশ নিচ্ছে না। তবে লিখিত পর্যবেক্ষণ পাঠিয়েছে। সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে এই শুনানি হবে। আজ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে বাংলাদেশসহ ১১ দেশ।
পর্যায়ক্রমে ৫২টি দেশ এবং আরব লিগ, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও আফ্রিকান ইউনিয়ন যুক্তি উপস্থাপন করবে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিন, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, বেলিজ, বলিভিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, কমোরোস, কিউবা, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, গাম্বিয়া, গায়ানা, হাঙ্গেরি, চীন, ইরান, ইরাক, আয়ারল্যান্ড, জাপান, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, লুক্সেমবার্গ, মালয়েশিয়া, মরিশাস, নামিবিয়া, নরওয়ে, ওমান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, স্লোভেনিয়া, সুদান, সুইজারল্যান্ড, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, জাম্বিয়া, স্পেন, ফিজি ও মালদ্বীপ।