ইসরায়েলি অন্ধ আক্রোশের সঙ্গী যখন অন্ধ মানবতা

ফারুক ওয়াসিফ : অবরুদ্ধ অবস্থায় গণহত্যার শিকার গাজাবাসীরা একবার উত্তর থেকে দক্ষিণে আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। যখন বুঝতে পেরেছে, কোথাও তারা নিরাপদ না, তখন সামাজিক মাধ্যমে ‘শেষ বিদায়’ জানাচ্ছে। পরে আর জানানো যাবে না, কারণ ইসরায়েল খাদ্য, পানি, বিদ্যুতের পর এবার ইন্টারনেট ও ফোন নেটওয়ার্কও বন্ধ করে দিচ্ছে। দুনিয়া দেখছে, দুনিয়া ভাবছে, তারপর বিশ্ববিবেক ঘুমিয়ে পড়ছে।

ইসরায়েল দুইভাবে ফিলিস্তিনি হত্যা করে: যুদ্ধে এবং শান্তিতে। হামাসের হামলার আগেই, ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত শুধু পশ্চিম তীরেই ১৭৫ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল। তখন তো যুদ্ধ ছিল না, পশ্চিম তীরে তো হামাসও নাই। আছে ইসরায়েলের পোষা ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাহমুদ আব্বাসের শাসন’। সেখানে প্রতি ১৬ জন ফিলিস্তিনির জন্য রয়েছে একজন ফিলিস্তিনি পুলিশ। রয়েছে ইসরায়েলি চেকপোস্ট, সেনা এবং সেটলার সন্ত্রাসী। ফিলিস্তিনিদের ২০ ভাগ মানুষই কখনও কখনও ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ছিল বা নির্যাতিত হয়েছে। এই অবস্থায় হামাসের হামলা বৃহত্তম কারা বিদ্রোহ।

এই বিদ্রোহ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলি প্রখ্যাত সাংবাদিক ইওসি ইয়েহোসুয়া লিখেছেন, ‘গাজা যুদ্ধের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।’ ওয়াশিংটন এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হিজবুল্লাহর ভয়ে দুটি রণতরী এবং ২ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে। চালাচ্ছে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা।

পশ্চিমা মানবতা পুবে আসতে আসতে দিনকানা হতে থাকে। একেবারে অন্ধ হয়ে পড়ে ফিলিস্তিনে এসে। তাই জো বাইডেন গাজার একটি হাসপাতালে ৫০০ ফিলিস্তিনিকে বীভৎসভাবে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দুষতে পারেন না; দোষ দেন হামাসকেই। এর আগে তিনি বলেছিলেন, হামাস নাকি ইসরায়েলি শিশুদের গলা কেটে হত্যা করছে। পরে হোয়াইট হাউস ওই কথা সংশোধন করে। ইসরায়েলি হলে বিবিসি লেখে ‘হত্যাকাণ্ড’ আর ফিলিস্তিনি হলে ‘মরেছে’– যেন তাদের কেউ হত্যা করেনি। গাজায় হাসপাতালে হামলার আগে বিবিসি শিরোনাম করে, ‘হাসপাতাল ও স্কুলের নিচে হামাসের টানেল’। গণহত্যায় মদদের দায় বিবিসি কি অস্বীকার করতে পারবে?

হাসপাতাল, স্কুল, জাতিসংঘের ভবন সবই ধ্বংসযোগ্য সামরিক নিশানা। এক ইসরায়েলি সৈন্য এভাবে জানাচ্ছে তাদের কমান্ডারদের নির্দেশনার কথা: ‘আমাদের বলা হয়েছে…আসলে কোনো বিধিনিষেধ নাই। ওখানে কোনো সিভিলিয়ান থাকার কথা না। যাকেই চোখে পড়বে তাকেই গুলি করবে। গুলি করতে ভয় পেও না।’

কিন্তু ভয় আছে ইসরায়েলের। সে জন্য গাজা সীমান্তে ১ লাখ ৩০ হাজার সেনাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। স্থলাভিযান শুরু হবার কথা গত ১৩ তারিখে। কিন্তু আবহাওয়ার দোহাই দিয়ে তা স্থগিত আছে। বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরবের মোড়ল রাষ্ট্রগুলি সফর করে তাদের বশে আনতে দৃশ্যত ব্যর্থ হয়েছেন। ইরান ও হিজবুল্লাহকে না জড়ানোর হুমকিও ভেস্তে গেছে। ফিলিস্তিনে হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ ডান ও বাম সব দল প্রস্তুত, প্রস্তুত লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বাহিনী, সিরিয়া এবং সেখানকার ইরানপন্থি যোদ্ধারা, লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী। প্রতিরোধের এই অক্ষশক্তির সমর্থনে আরবের রাজধানীগুলিতে চলছে জনতার বিক্ষোভের ঢল। গাজায় হামলা হলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইরানসহ আরও অনেকে। তুরস্কও নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। জনতার চাপে মিসর, জর্ডান ও সৌদি আরবের শাসকেরা সুর পাল্টাচ্ছেন। আমেরিকার ঘনিষ্ঠ জর্ডান তো বাইডেনের আম্মান সফরকে না করে দিয়েছে।

বলে দিয়েছে, হাসপাতালে গণহত্যার পর আলোচনার কী আছে। এদিকে চীনে হাজির রাশিয়ার পুতিন। ক’দিন আগে চীনেই হয়ে গেল আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। হামাসের অ্যাকশন ফিলিস্তিন আন্দোলনকে ধ্বংসের মুখ থেকে বৈশ্বিক সংকটের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। দেশে দেশে মার্কিন, ইসরায়েলি ও ইউরোপীয় দূতাবাসগুলি ঘেরাও হচ্ছে। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু করা পশ্চিমাদের পক্ষে কঠিন। বিশেষ করে ইউক্রেনে মার খাওয়া পশ্চিমা শক্তি আরেকটা যুদ্ধ চালাতে সক্ষম কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যুদ্ধের ফল চীন ও রাশিয়ার পক্ষে যেতে পারে, ইরান বেরিয়ে আসতে পারে মুসলিম ও আরববিশ্বের নেতা হিসেবে। এটা ২০০৬ বা ’১৪ সাল নয়, এটা ২০২৩। অনেক যুদ্ধবিশারদের ধারণা, গাজা ইসরায়েলিদের জন্য ফাঁদ হয়ে উঠবে। সেখানে স্থলাভিযান আরেকটি স্টালিনগ্রাদ যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর পরাজয় শুরু হয়েছিল রাশিয়ার স্টালিনগ্রাদ বা আজকের পিটার্সবার্গ থেকেই।

তারপরও ইসরায়েল আরও গণহত্যা চালানোর আগে থামবে না মনে হয়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভাষায়, ‘ফিলিস্তিনিরা হলো মনুষ্য জন্তু।’ ইঁদুর নিধনে মানুষের বিবেক কাঁপে না, বিচারও হয় না। ফিলিস্তিনিরা তাদের চোখে ইঁদুরেরই মতো বধযোগ্য। রোমান আইনে দাস, বন্দি, গরিব ধরনের মানুষকে হত্যায় কোনো অপরাধ হতো না। এদের আইনি উপাধি ছিল ‘হোমো সাকের’। ফিলিস্তিনি হোমো সাকেরদের গণহত্যায় শোক জাগে না পশ্চিমে। কারণ ফিলিস্তিনিরা বধযোগ্য, তাদের জমি দখলযোগ্য, তাদের স্বাধীনতার লড়াই হলো ‘সন্ত্রাস’।

হাসপাতালে বোমা মেরে নারী-শিশুসহ ৫০০ ফিলিস্তিনি হত্যার পরও ইসরায়েলের সমর্থনে তেল আবিব সফরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

১৯৩০ থেকে ৪০ দশকে ফিলিস্তিনের গুপ্ত ইহুদি সংগঠনকে বলা হতো ‘সন্ত্রাসবাদী’। তারপর ইউরোপে হিটলার ইহুদি গণহত্যা (হলোকস্ট) শুরু করেন। তা দেখে এই সন্ত্রাসবাদীদের জন্য ইউরোপে অনেকের সহানুভূতি জন্মে। ধীরে ধীরে তাদের নাম হয়ে যায় ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এই মুক্তিযোদ্ধারা লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের হাজার হাজার বছরের পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু করে, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, হোটেলে বোমা মারে ইত্যাদি। ব্রিটেন তাদের হাতে থাকা ফিলিস্তিনি উপনিবেশকে এই সন্ত্রাসবাদী/ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয় ১৯৪৮ সালে।

এভাবে খ্রিষ্টীয় ইউরোপ শত শত বছর ধরে ইহুদি নির্যাতন চালানোর দায়মুক্তি নিতে নিজেদের বোঝা আরবের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। ইহুদিদের বিতাড়ন করেছে তো খোদ ইউরোপ, ঠিক যেভাবে ষোলো শতকে তারা আন্দালুসিয়া থেকে একযোগে মুসলমান ও ইহুদিদের বিতাড়ন করেছিল। ইউরোপ কি কখনও ভিন্নতাকে সহ্য করেছে? প্রোটেস্ট্যান্টরা সহ্য করেনি ক্যাথলিকদের, খ্রিষ্টানরা সহ্য করেনি ইহুদিদের। তিন তিনটি ক্রুসেড চালিয়েছে তারা। তারা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে কোটি কোটি আদিবাসী হত্যা করেছে। খুব হতাশা নিয়ে বলতে হচ্ছে, গণহত্যার মাধ্যমে অন্যের জমি দখল করে ‘দেশ’ ও ‘রাষ্ট্র’ বানানোর পন্থা পাশ্চাত্যের মজ্জাগত। সে কারণেই সেটলার রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র সেটলার রাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ, গণমাধ্যমের মদদ দিয়ে টিকিয়ে রাখছে।

সুতরাং আজকে গাজায় যে যুদ্ধ চলছে, তা আদতে আরেকটি আমেরিকান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আমেরিকা, ইউরোপ, ন্যাটো ও তাদের আরব মিত্রদের যৌথ যুদ্ধ। হামাস হলো তাদের প্রতিপক্ষ। ভাবা যায়? একটা ছোট্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী বাইডেন-নেতানিয়াহুর মধ্যপ্রাচ্য ভাগবাটোয়ারা ঠেকিয়ে দিচ্ছে, ঠেকিয়ে দিচ্ছে আরব-ইসরায়েল মৈত্রী, ঠেকিয়ে দিচ্ছে ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। হামাসের ভূরাজনৈতিক আঘাত দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় আচরণ করছে হামাস, আর ইসরায়েল করছে সন্ত্রাসবাদী হামলা।

যারা ইসরায়েলের কাছ থেকে শান্তি আশা করেন, তারা রাষ্ট্রটিকে বোঝেননি। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি বলে কিছু নাই, তারা অস্তিত্বহীন।’ ফিলিস্তিনি থাকলে জায়নবাদী ইসরায়েল থাকতে পারে না। কারণ ইসরায়েল এক অস্বাভাবিক রাষ্ট্র, তার স্থায়ী সীমান্ত বলে কিছু নাই। ১৯৪৮ সাল থেকে এই সীমান্ত চলমান আছে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে বিরাট অঞ্চল, যার মধ্যে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনসহ মিসর ও সিরিয়ার বিরাট অংশও রয়েছে, সেটাই জায়নবাদীদের কাঙ্ক্ষিত ‘স্বদেশ’। ইসরায়েল রাষ্ট্র হলো সেই ল্যান্ড অব ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার যুদ্ধযন্ত্র। যুদ্ধযন্ত্র রাজনীতি বুঝবে না, ইতিহাস বুঝবে না, আইন বুঝবে না। বুঝবে ছলে-বলে-কৌশলে তার মিশন পূর্ণ করা।

ওল্ড টেস্টামেন্টে কথিত পবিত্র ভূমিতে ১২টি ইহুদি গোত্রের পুনর্বাসনের মিথ ছাড়া এই ল্যান্ড অব ইসরায়েলের আর কোনো ভিত্তি আছে? ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ স্লোমো স্যান্ড তাঁর ‘ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল’ এবং ‘ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ বইয়ে প্রমাণ করেছেন, ইউরোপীয় ইহুদিরা কোনো কালে আরব অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে যায়নি, কোনো কালে মিসর থেকে তারা এখানে হিজরত করেনি এবং আদি বনি ইসরায়েলের বংশধর হলো আজকের ফিলিস্তিনিরা। যিশুখ্রিষ্ট নিজেও ছিলেন একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত ফিলিস্তিনি এবং প্রথম কোনো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি হত্যাকাণ্ডটি তাঁর ওপরই ঘটানো হয়েছিল।

পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনকে রক্তপাতমুক্ত করার দায় পাশ্চাত্যের। আরবরা তো উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরায়েলকে স্বীকার করেই নিয়েছে। শান্তির জন্য তাদের তাই ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। বর্বরতা বন্ধ করতে হবে। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘পশ্চিমে প্রেতের মতো ইউরোপ, পূর্ব দিকে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা।’ এশিয়ার মাথা থেকে পাশ্চাত্যের প্রেতের আছর কাটানো এখন বিশ্বশান্তির শর্ত।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক 

1 COMMENT

  1. A wonderful and truly all-encompassing history-based explanation of the Israeli-Palestinian conflict. You should translate and publish this in English, French and other western laguages in the western media. The world is slowly coming around to the views and the truth you mention in this writeup. We need to keep driving more and more nails into the false Israeli-American narrative.

Comments are closed.