ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার ভিন্নতায় সুবিধা ভারতের

ইলিশ মাছ

বাংলাদেশে সাগরে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সুবিধা পাচ্ছেন ভারতের মৎস্যজীবীরা। এক মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলা নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতে ইলিশ ধরা চলে। এতে বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে—দুই দেশের মৎস্যজীবী, বিশেষজ্ঞরা এমনটাই বলছেন। আর এতে বাংলাদেশে ভরা মৌসুমে ইলিশ কম ধরা পড়ছে বলে মনে করছেন এ দেশের মৎস্যজীবীরা।

দেশে ইলিশের উৎপাদন সংকট কাটাতে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে একটি অভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কথা বলছেন উভয় দেশের মৎস্যজীবীরা। কিন্তু এ নিয়ে এখনো ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি বাংলাদেশ।

মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো কথা হয়নি। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি।’

এমন পরিস্থিতিতে দিন দিন ইলিশ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। চার বছরে বার্ষিক উৎপাদন ৬ লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ৩ বছরে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম।

 ইলিশ সুরক্ষায় বাংলাদেশে তিন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা থাকে

বাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষায় তিন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর মধ্যে অক্টোবরে ২২ দিন। এ সময় মা মাছের ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বাচ্চা হলে তার সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে। মাছের বৃদ্ধির জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই আবার এক দফায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকে।

মাৎস্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা যে সাফল্য পাচ্ছি, তা এই নিষেধাজ্ঞার ফল। নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। এখানে একটা সমস্যা আছে। আমাদের এখানে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা থাকে। ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। ৫ জুন শুরু হয় তাদের মাছ ধরা।’

বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞায় সাফল্য দেখে ভারতেও মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিষয় চালু হয়। এটি ২০১৮ সাল থেকে চলে আসছে বলে জানান পশ্চিমবঙ্গের ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস।

এবার নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় অন্তত তিন হাজার মাছ ধরার ট্রলার ইলিশ ধরতে সমুদ্রে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে ইলিশ ধরা পড়ছে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে। এর মধ্যে দেড় থেকে দুই কেজির ইলিশও আছে। মৎস্য ব্যবসায়ী অতুল দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মৎস্যজীবীদের মাছের উৎস তো একই, সেই বঙ্গোপসাগর। তাই এখানে এক অংশে যদি মাছ ধরা বন্ধ থাকে, অন্য অংশে তো মাছ ধরা বেশি পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে মাছ ধরা শুরু হলে আমাদের এখানে কমে যাবে।’

দুই দেশে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে একই নিয়ম মেনে চলা উচিত বলেও মনে করেন অতুল দাস।

বাংলাদেশে সাগরে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার ফলে আরও এক মাস ইলিশ ধরা চলবে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনছে বলে মনে করেন চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একই সাগর থেকে উভয় দেশের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরেন। মাছের তো সীমান্ত নেই। তাই এ সময়টায় বাংলাদেশে ইলিশ বন্ধ থাকায় ভারতে বিপুল পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে। আমাদের দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় যদি মেলানো না যায়, তবে আমাদের ইলিশের উৎপাদনে ধস নামবে। ইতিমধ্যে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেছে।’

তবে মৎস্য গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিষেধাজ্ঞার যে মেয়াদ নির্ধারণ করেছি, তা দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ভিত্তিতে। আমাদের জলসীমায় ৮০ ভাগ ইলিশ বিচরণ করে। তাই আমাদের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদই ভারতের মানা উচিত।’

তবে মৎস্য ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাইয়ের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কান্ট্রি ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন, ‘জুন মাসের পর থেকেই বাড়ন্ত ইলিশগুলো বড় হয়ে যায়। ভারতে ধরা পড়া ইলিশগুলো দেখেই তা বোঝা যায়। এ সময় আমাদের এখানে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় আমরা অকারণে ক্ষতির মুখে পড়ি। আমাদের জেলেরা এ সময় অনেকেই পেশাও ছেড়ে দেন।’

সময়সীমাটি কাছাকাছি হওয়া দরকার

বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায় থেকেই দাবি উঠেছে সাগরে মাছ ধরার বিষয়ে অভিন্ন সময় নির্ধারণ নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে কথা বলার। মৎস্য অধিদপ্তরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার মন্ত্রণালয়ে এলে মন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন।

সাগর একই হলেও বাস্তুতন্ত্রের ভিন্নতা, ইলিশের পরিযায়ী চরিত্র—এসবের কারণে দুই দেশের একেবারে অভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় বলেও মনে করেন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। তবে তিনি মনে করেন, সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর বাস্তবতা মেনে বাংলাদেশে চালু থাকা নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এর সঙ্গে ভারতের সময় একদম এক না হলেও সময়সীমাটি কাছাকাছি হওয়া দরকার।

prothom alo