ইতিহাস থেকে সাক্ষ্য

  • রাযী-উদ-দীন কুরেশী
  •  ১৫ মে ২০২৩, ২০:২১
ইতিহাস থেকে সাক্ষ্য। – ছবি : সংগৃহীত

আমি একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ, বয়স এখন ৯৫। সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে এখনো যে কিছু লিখতে পারছি তার জন্য অজস্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

রাজনীতিতে পরনিন্দার চর্চা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাউকে কখনো কোনো চালাকির আশ্রয় নিতে দেখলেও অসত্যের আশ্রয় নেয়া চোখে পড়ত না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি- কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর মেয়ে বিজয়ল্ক্ষ্মী পণ্ডিতের নাকি বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার প্রেমিক এক মুসলিম যুবকের সাথে। মহাত্মা গান্ধী নাকি তখন এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, তোমরা যদি এই হিন্দু ব্রাহ্মণ মেয়েটিকে একজন মুসলমান যুবকের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও, তাহলে ভারতের হিন্দুরা বিক্ষুব্ধ হবে, আর আমাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থন কমে গিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাহত হবে। সেই বিয়ে আর হয়নি দেশের স্বার্থে। আর পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর বোন সেই মহিলা বাকি জীবন নাকি অবিবাহিতই থেকে যান।

অতীতের আরেকটি চালাকির, যা আমার বিবেচনায় রাজনৈতিক চালাকিই ছিল- উল্লেখ করছি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে যখন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতারা সম্মিলিতভাবে স্থির করলেন বাংলা ভাগ না করে একটি অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রেখে দিতে, তখন দুই দলের নেতারা দিল্লি গেলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সমর্থন আদায়ে। তখন কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নাকি বাংলার কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুকে বলেছিলেন, ‘শরৎবাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই’ (বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৭৪)। দৃশ্যত কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের সমর্থনের অভাবে বাংলা অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারেনি। কিন্তু আমার, এই সন্দেহপ্রবণ লেখকের ধারণা হয়তো প্যাটেলজি শরৎবাবুকে বলেছিলেন, ‘বাংলা অখণ্ড রাখতে কেন চাইছেন, আপনারা, হিন্দুরা তো ওখানে সংখ্যালঘু, চিরদিনই কি এভাবে থাকতে চান। যান, গিয়ে আমাদের কলকাতার প্রয়োজনীয়তার দোহাই দিয়ে খণ্ডনটাই মেনে নিন।’

এখন আমি আমাদের এই বাংলাদেশের অনেকের মধ্যে যত সব অজ্ঞতার, মানসিক দৈন্যতার প্রমাণ পেয়েছি কালক্রমে, তার কিছু উল্লেখ করছি। ৬ মার্চ ২০২১, সম্ভবত সকাল ১০টায় আমাদের কোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় একজন আবু সাইদ সাগরের (?) বক্তব্য শুনছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, তিনি বলছিলেন- পাকিস্তান সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বৈষম্য করেছে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে পূর্বপাকিস্তানের চন্দ্রঘোনায় স্থাপিত কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজ পূর্বপাকিস্তানের মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি করা হতো। এমন একটি বক্তব্য আমার চৈতন্যে আঘাত করে। কারণ আমি কর্ণফুলী পেপার মিল চালু হওয়ার কিছু দিন আগে ৫ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে সেই মিলের হিসাব বিভাগে কাজে যোগ দেই, আর তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে চন্দ্রঘোনা থেকে বদলি হয়ে ১ জানুয়ারি ’৫৭ মিলের চট্টগ্রাম অফিসে ‘সেলস অ্যাকাউন্টেন্ট’ পদে যোগ দিই। আমার কর্তব্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে যত সব কাগজ জাহাজে প্রেরণ করা হতো, সেসব চালানের বিল করে ‘লেটার অব ক্রেডিট’ সূত্রে ব্যাংক থেকে টাকা আদায় করা। আমি এই দেশেরই একজন বাঙালি, আর মূল্যে এমন কোনো বৈষম্য থাকলে তা কি আমার বিবেকে আঘাত করত না? ষাট-সত্তর বছর আগের কথা, তবুও আশা করি কোনো ভুল করছি না।

যখন শুরু করলাম কর্ণফুলী পেপার মিলের ব্যাপার নিয়ে, তখন এসব মিলের ব্যাপারে আরো কথা আছে। যখন কর্ণফুলী পেপার মিল স্থাপন করেছিল পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্র্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (সংক্ষেপে পিআইডিসি), তখন এই পূর্ববাংলায় কোনো বাঙালি মুসলমানের কোনো শিল্প-কারখানা ছিল না। হিন্দু বাঙালিদের স্থাপিত কিছু মিল-কারখানা অবশ্যই ছিল। যেমন সূর্যকুমার বসু স্থাপিত ঢাকেশ্বরী কটন মিল ১ ও ২, আদর্শ কটন মিল, বসুজ গ্লাস ওয়ার্কস, মোহিনী মোহন চক্রবর্তী স্থাপিত মোহিনী মিলস। আরো ছিল লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিল, আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানির ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। এই সব মিল-কারখানার কয়েকটিতে আমি বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি হিসাব বিভাগের প্রধান হিসেবে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কালে ভারতে নিবন্ধনকৃত বেশ কয়েকটি কোম্পানির এতদঅঞ্চলের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি নির্ধারণ করে সরকার অধিগ্রহণ করে আমাদের করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ন্যস্ত করে। এগুলোর মধ্যে ঢাকেশ্বরী গ্রুপ অব মিলস, আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি আর মোহিনী মিলও ছিল, যেগুলোতে আমি কাজ করেছি। শুনেছি সূর্যকুমার বসু, মোহিনী মোহন চক্রবর্তী গয়রহ নাকি সেই দেশাত্মবোধক সঙ্গীত-
মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তোলে নে রে ভাই ,
দ্বীন দুখিনী মা যে তোদের এর বেশি আর সাধ্য নাই;
শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েই নাকি কাপড়ের কলসমূহ স্থাপনে এগিয়ে এসেছিলেন, দখলদার ইংরেজরা যাতে তাদের বিলেতি কাপড় এ দেশে বিক্রি করে এ দেশের সম্পদ নিয়ে যেতে না পারে। প্রথম প্রচেষ্টা অবশ্য শুরু হয়েছিল খদ্দর পরিধান দিয়ে।

এতদঅঞ্চলের মুসলমানদের বিপুলাংশই ছিলেন গরিব, নিরক্ষর। পাকিস্তান আন্দোলনের আগে তাদের মধ্যে আর্থিক উন্নয়নের কোনো আগ্রহই হয়তো ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ উন্নয়নের চেষ্টা করলেও সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে হয়তো অগ্রসর হতে পারেননি। উদাহরণ- চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক, নাম ছিল সম্ভবত নূরুল ইসলাম, ‘কমরেড ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের অনেক আগে। এই উদ্যোক্তা কিন্তু সফল হতে পারেননি, বেশি দিন টিকেনি এই ব্যাংক। মুসলমানের হাতে টাকা কোথায় যে ব্যাংকে রাখবে? পার্শ্ববর্তী সমাজের লোক যখন ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ বাণীর বাস্তবায়ন করছিল, তখন মুসলমানদের কারো হাতে কিছু টাকা থাকলে তারা কোরমা, কালিয়া, মোগলাই পরোটা নিয়ে ‘খান্দানি’তে ব্যস্ত। আমার সংগ্রহে ১৯৪০ সালের একটি প্রচার পুস্তিকা রয়েছে যেখানে এই ব্যাংকের সিলেট শাখার একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পাই।

পূর্ববাংলায় আধুনিক শিল্প-কারখানা স্থাপন শুরু করে পিআইডিসি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন-চার বছর পর থেকে। কর্নফুলী পেপার মিলের পর চট্টগ্রামে স্টিল মিল, বারবকুণ্ডে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, খুলনায় নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, শিপইয়ার্ড, ফেঞ্চুগঞ্জে সার কারখানা ইত্যাদি। পিআইডিসি যখন পূর্ববাংলায় শিল্প স্থাপন শুরু করে তখন এই প্রদেশে এমন একজন উপযুক্ত বাঙালি মুসলমান ছিলেন না যাকে করপোরেশনের একজন স্থানীয় পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া যায়। একজন অবাঙালি মুসলমান খ্যাতনামা ব্যবসায়ী মির্জা আহমদ ইস্পাহানীকে, যিনি ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন, পিআইডিসির একমাত্র পূর্বপাকিস্তানি পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই পদ সরকারি, বেতনভুক চাকরির পদ, তাই ইস্পাহানী সাহেব নাকি এই শর্তে পদ গ্রহণ করেছিলেন যে, বেতন যদি তাকে দিতেই হয় তবে তা হবে মাসে নামমাত্র এক টাকা!

আমার চাকরিকালে পিআইডিসিতে কোনো বাঙালি-অবাঙালি প্রভেদ দেখতে পাইনি। এমনকি চন্দ্রঘোনায় চাকরিকালে বাঙালি হিন্দু কয়েকজনকে গুরুত্বপূর্ণ অফিসার পদেও দেখতে পাই। এদের মধ্যে একজন ছিলেন চট্টগ্রামের দিলিপ কুমার দত্ত, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, আরেকজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রঞ্জিত কুমার বসু।
অন্যান্য ক্ষেত্রে কয়েকজন উচ্চপদস্থ অবাঙালি কর্মকর্তার এই বাংলার উন্নয়নে অবদানের উল্লেখ করছি। এদের কেউই কিন্তু পূর্ববাংলায় থাকতে আসেননি, আর থাকেনওনি। একজন ছিলেন আব্বাস খলিলী নামে একজন আইসিএস অফিসার। যিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বদলি হয়ে ঢাকা এসেছিলেন প্রাদেশিক সরকারের সচিব পদে। তখন ঢাকা ইলেকট্রিক কোম্পানির অবস্থা সঙ্গীন, প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু উদ্যোক্তাদের অনেকে ভারত চলে গেছেন। আব্বাস খলিলী নবপ্রতিষ্ঠিত রাজধানী ঢাকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা ইলেকট্রিসিটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড আর বিজ্ঞাপন দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে উন্নয়ন সম্পন্ন করলেন। আমি নিজে চন্দ্রঘোনায় চাকরিকালে ৫০০ টাকার শেয়ার কিনেছিলাম। বেশ কয়েক বছর বাৎসরিক লাভও পেয়েছি। আরেকজন, জি এ মাদানী ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট গঠন করে ঢাকার উন্নয়নে হাত দিয়েছিলেন। ঢাকার বাণিজ্যিক রাজধানী মতিঝিল তারই স্থাপিত। আমি যে উত্তরায় বাস করি তা তারই কীর্তি। মনে আছে- ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে ডিআইটির চেয়ারম্যান জি এ মাদানী পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ব্যক্ত করেন যে, ‘সারা পাকিস্তানের মধ্যে বৃহত্তম উপশহর উত্তরায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ হাজার প্লট উন্নয়ন করা হচ্ছে।’
এই কথাগুলো উদ্ধৃত করলাম আমার অনেক বছর আগের একটি লেখা থেকে যা প্রকাশিত হয়েছিল উত্তরা কল্যাণ সমিতির একটি মুখপত্রে। তারপর উল্লেখ করছি এমন একজন অবাঙালি অফিসারের কথা যিনি ছিলেন আমার কাছে উন্নয়নের একজন আদর্শ পথপ্রদর্শক, পিআইডিসির চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক। আমার চন্দ্রঘোনায় চাকরিকালে তিনি একবার সেখানে মিল পরিদর্শনে এসে মিলের অফিসারদের এক সভায় ডেকে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে আমি এই কর্ণফুলী পেপার মিলে এত ইঞ্জিনিয়ার, কেমিস্ট, অ্যাকাউন্টেন্ট, ইত্যাদি পদে লোক নিয়োগ দিয়ে বাহুল্য করছি কেন? আপনারা মনে রাখবেন, এই অত্যাধুনিক শিল্পে কাজ করে আপনারা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন তা কাজে লাগিয়ে আমি এই দেশটিকে শিল্পায়িত করব।’ আমি সেই সভায় ছিলাম আর আমার মনে গেঁথে যাওয়া তার কথাগুলো উল্লেখ করলাম। এসব কথা আমি ইতঃপূর্বে আমার নিজের লেখা ও ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি বই ‘আমার শিল্পজগতের দিনগুলো’তে (পৃষ্ঠা-৪৮) উল্লেখ করেছি (ওঝইঘ ৯৭৮ ৯৮৪ ৯১৬৫৯ ৬৫ ). উপস্থিত অফিসারদের মধ্যে প্রায় সবাই আমরা ছিলাম বাঙালি আর তিনি আমাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পায়ন করার উদ্দেশ্যে তৈরি করছিলেন তা কি ভাবা যায়? কর্ণফুলীর পর পিআইডিসি পূর্ববাংলায় অন্যান্য শিল্প স্থাপনে হাত দেয়।

প্রসঙ্গত, ভারতের মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী আর পাকিস্তানের মহান নেতা কায়দে আজম জিন্নাহ দু’জনেই ছিলেন ভারতের গুজরাট রাজ্যের লোক। গান্ধীজি প্রাণ হারিয়েছিলেন নাথুরাম গডসের গুলিতে, যখন তিনি গাইছিলেন তার ‘রামধুন’ প্রার্থনা, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরি নাম, সবকো সুমতি দে ভগবান’। আর জিন্নাহ সাহেবও নাকি তার শেষ দিনক্ষণে ছিলেন কিছুটা অবহেলিত, যদিও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি!

আমরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি বিভিন্ন বিষয়ে বনাবনি না হওয়ায়, পশ্চিমাদের নানা অনাচারে। আমাদের এই দেশের এককালের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক, গ্রন্থকার, রাজনৈতিক নেতা মরহুম আবুল মনসুর আহমদ তার ‘শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ লিখিত ভূমিকায় লিখেছেন- ‘পশ্চিমা ভাইরা বাঙালিদের একরূপ পিটাইয়া-খেদাইয়া স্বাধীন করিয়াছেন। কোনো বাঙালিই পাকিস্তান ভাংগিতে চায় নাই।… বাংলার সব জাতীয় নেতাই শেষ পর্যন্ত মনেপ্রাণে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক ফেডারেশন হিসেবে পাকিস্তানকে বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টাই করিয়াছেন’ (সব জাতীয় নেতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নামও আছে, পৃষ্ঠা-৩)।

এককালে রাজনৈতিক নেতারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতে দেখিনি, কিন্তু এখন তা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছে। আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির খবর মানসিক পীড়ার উদ্রেক ঘটায়।

লেখাটি শেষ করার আগে ঐতিহাসিক গল্প-কাহিনীর আরো একটি রাজনৈতিক কাহিনীর উল্লেখ করছি। অবিভক্ত ভারতের আমলে ঘটিত একটি রাজনৈতিক চালাকির কথা এককালে বেশ কিছু চর্চা হয়েছে, সত্য-মিথ্যা যদিও কখনো উদঘাটিত হয়নি। ব্যাপারটি হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় ঘটার পর ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতা অধিপতি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু যখন জাপান থেকে ভারতে ফিরে আসতে চাইলেন, তার ফেরা হলো না। বলা হয়, জাপান ত্যাগ করে ফরমোজা (বর্তমান তাইওয়ান) হয়ে রাশিয়া যাওয়ার পথে তার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই বিমান দুর্ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সন্দেহ করা হয়, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর ভারত-প্রধানের অবস্থান নিশ্চিত করতেই নাকি রাশিয়ার চক্রান্তে নেতাজীর আর ভারত প্রত্যাবর্তন ঘটেনি।

এমন একটি চক্রান্তের খবর প্রথম জানতে পারলাম ২০০৬ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘এখন সময়’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার ৭-১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সংখ্যায় জনৈক কেশব ভট্টাচার্যের ‘নেহরুর নেতাজী বিরোধিতা : ইতিহাস ক্ষমাহীন’ শিরোনামের লেখাটি পড়ে।

ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে আজাদ হিন্দ ফৌজ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) গঠন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের চরম জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং তিনি দেশে ফিরতে পারলে স্বাধীন ভারতের নেতৃত্ব তার হাতে চলে যাবে এই ভয়ে নাকি জওয়াহেরলাল নেহরু এমন একটি চক্রান্ত করেছিলেন।

‘এখন সময়’ পত্রিকায় কেশব ভট্টাচার্যের লেখা পড়ার পর কলকাতার ‘আকাশ বার্তা’ টিভি চ্যানেলে ৪ মে, ২০০৬ ‘খোজ খবর’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানও দেখা হয়। এগুলোর ওপর ভর করে আমিও একটি লেখা ‘পণ্ডিত নেহরুর নেতাজী বিরোধিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ পত্রিকায় পাঠাই, যা দৈনিক ইনকিলাবের ৪ জুন ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

অভিযোগটি কোনো প্রমাণিত সত্য নয়, তাই জওয়াহেরলাল নেহরু তেমন কিছু করেছিলেন কি না তা অনিশ্চিত!