ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বশির ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ

ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বশির ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবি) সাবেক পরিচালক বশির আহমেদ ও তার স্ত্রী তারানা আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এতে অর্থ পাচার, বিদেশি নাগরিকত্ব গোপন করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগে তাদের কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, বশির এবং তারানা অ্যান্টিগুয়া এবং বারবুডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। কিন্তু তারা এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করেননি। দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং আর্থিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এই ধরনের কর্মকাণ্ড জাতীয় বিধিমালার লঙ্ঘন।

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট অনুসারে, মোহাম্মদ আব্দুল বারীর ছেলে বশির আহমেদ চট্টগ্রামের কোতোয়ালির জুবলি রোডে থাকেন। বশিরের স্ত্রী তারানা আহমেদও একই ঠিকানায় থাকেন।

পরিচালক হওয়ার আগে বশির ইউসিবি পিএলসির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এয়ারমেট গুডি ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গুডি অ্যাকসেসরিজ প্রাইভেট লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কো. বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালকসহ একাধিক পদে আছেন।

অন্যদিকে, বশির আহমেদের স্ত্রী তারানা আহমেদ দেশের একজন নারী উদ্যোক্তা। তারানা মেঘনা ব্যাংক পিএলসির একজন পরিচালক। এ ছাড়া তিনি নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক, গুডি অ্যাকসেসরিজ (প্রা.) লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং এয়ারমেট গুডি ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন।

তাছাড়া, অভিযুক্ত এই দুইজন যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হিসেবে প্যানমার্ক ইমপেক্স মেগা ট্রেডিং লিমিটেডকে (ইউকে) তালিকাভুক্ত করার সময় নিজেদেরকে অ্যান্টিগুয়ান নাগরিক হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দেন। যা তাদের উদ্দেশ্য এবং আর্থিক লেনদেনের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করেছিল।

অ্যান্টিগুয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। তাই অ্যান্টিগুয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহৃত তহবিলের উৎস এবং সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য অর্থ পাচারের সংযোগ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

ইউসিবিতে ক্ষমতার অপব্যবহার

২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ইউসিবির বোর্ড পুনর্গঠন করে। বোর্ড পুনর্গঠনের আগে বশির ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য আর্থিক লেনদেন সহজতর করতে নিজের পরিচালক পদের অপব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তদন্তে দেখা যায়, বশির আহমেদের একক মালিকানাধীন কোম্পানি প্যানমার্ক ইমপেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসির (দুবাই) অনুকূলে ইউসিবি থেকে ২৪ লাখ ৬৪ হাজার ২৯৪ মার্কিন ডলার মূল্যের ৫১টি লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ইস্যু করা হয়েছিল। এই এলসিগুলি মূলত তার সঙ্গে গভীর সংযোগ থাকা চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্যালেক্স্ট্রা লিমিটেড, নাজ ইন্টারন্যাশনাল, জি.এইচ.এম ট্রেডার্স এবং আলোক ট্রেডার্সের মাধ্যমে করা হয়েছিল।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে প্রমাণ মেলে—এই লেনদেনগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত চালান দেখানো হয়। আর এর মাধ্যমে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘন করে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়।

ভুয়া কোম্পানি এবং অঘোষিত সম্পদ

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ তহবিল পাচার এবং তার তথ্য গোপনের জন্য প্যানমার্ক ইমপেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসি (দুবাই) এবং প্যানমার্ক ইমপেক্স মেগা ট্রেডিং লিমিটেড (ইউকে) নামে দুটি ভুয়া (অফশোর) কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বশির আহমেদ।

সরকারি নথি থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের কোম্পানিটি ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর খোলা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে বশির এবং তার পরিবারের সদস্যরা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে ২০২১ এবং ২০২৪ সালে তারা পদত্যাগ করেন।

ব্যবসায়িক লেনদেনের পাশাপাশি অভিযুক্তদের নামে বিদেশে মূল্যবান সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে যুক্তরাজ্যের ডব্লিউ২ ১বিডব্লিউ লন্ডনের ১ নিউক্যাসল প্লেসের ওয়েস্টমার্ক টাওয়ারের ২৮০৩ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টটিও (Apartment 2803, Westmark Tower, 1 Newcastle Place, London, W2 1BW) রয়েছে। আর্থিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, এই অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গে স্থায়ী এবং অস্থায়ী চার্জের বিষয়টি জড়িত, যা সম্ভাব্য আর্থিক লেনদেনের তথ্য গোপনের কৌশল হিসেবে সতর্কতা তৈরি করে।

অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট নাগরিকরা দুদককে অ্যান্টিগুয়ার নাগরিকত্ব এবং বিদেশে সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে বশির আহমেদের অর্থের উৎস খতিয়ে দেখতে, অতিরিক্ত চালান শনাক্ত এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ৫১টি এলসির বিশদ পর্যালোচনা করতে, বিদেশে সম্পদের খোঁজ করতে এবং আত্মসাৎকৃত তহবিল পুনরুদ্ধারে অ্যান্টিগুয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্যের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করা এবং অভিযুক্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বশির আহমেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি বিশ্বাসের গুরুতর লঙ্ঘন এবং নীতিগত অসদাচরণের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। ইউসিবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউসিবির একজন সাবেক পরিচালক হিসেবে বশির আহমেদের কর্মকাণ্ড কেবল ব্যাংকিং ব্যবস্থার অখণ্ডতাকেই ক্ষুণ্ন করেনি বরং তা বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতিও করেছে।

Bangla Outlook

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here