ইউয়ানে বাণিজ্যে নানা জটিলতা, আপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের

logo

mzamin

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৭ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা কিছুতেই কাটছে না। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলার-রুবলে পেমেন্ট করা যাচ্ছে না। বিকল্প হিসাবে চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির মুদ্রা ইউয়ানে তা শোধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ সংক্রান্ত সমঝোতাও সই হয়েছে। কিন্তু না, এখন তা-ও আটকে যাচ্ছে। কারণ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় বাংলাদেশের হাতে পর্যাপ্ত ইউয়ান নেই। সামনের দিনে ইউয়ানের বড় সরবরাহেরও সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া এই পেমেন্টের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। রূপপুরের পরবর্তী পেমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস একটি নোটভারবাল পাঠিয়েছে। ঢাকার তরফে অবশ্য এখনো সেই নোটভারবালের জবাব দেয়া হয়নি।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির পর বিষয়টি নিয়ে স্থিতাবস্তা বিরাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছে সেগুনবাগিচা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে রাশিয়ার কাছ থেকে ৯০ শতাংশ ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে ডলার ও রুবলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ চীনের মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ পরিশোধে সম্মতি দিয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু তাতেও আপত্তি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বাধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর মধ্যে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা। এরই ধারাবাহিকতায় অব্যাহত ডলার সংকটের মুখে গত বছর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ঋণ চীনা ইউয়ানে পরিশোধে সম্মতি দিয়েছে রাশিয়া। এর আগে ডলারে নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে ঋণের অর্থ চেয়েছিল রুবলে। তবে রুবলে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না জানিয়ে চীনা মুদ্রায় সম্মতি দেয় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় ইউএস ডলার, ইউরো, জাপানি ইয়েন, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড ও কানাডিয়ান ডলারের পাশাপাশি ইউয়ানে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়েছিল।

তবে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাংকগুলো এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। এরপর গত বছর কয়েকটি ব্যাংক চীনা মুদ্রায় ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর অথরাইজড ডিলার শাখা চীনের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। চীন হচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ প্রতিবছর চীন থেকে আমদানি করে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। কিন্তু এর বিপরীতে চীনে এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। আর আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় ডলার ব্যবহার করে আসছে। তাই চাইলেই ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে কিনা সেটি নিয়েও সংশয় ছিল। ইউয়ানের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আসে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স থেকে। দুটোই আসে ডলারে। তাছাড়া চীনে যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম, তাই ইউয়ানের যোগান খুবই কম। এমন অবস্থায় আবার রূপপুর প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে চীনা মুদ্রা ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের বাধার ফলে সেটি আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইউয়ানে লেনদেন কার্যকর করা আগে থেকেই অনেকটা অসম্ভব ছিল। এখন নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা আসছে। ইউয়ান নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে বিকল্প পথ খোঁজার পরামর্শ তাদের। কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে ইউয়ানের যোগান নেই। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য একেবারেই কম। ব্যাংকগুলোর কাছে যদি পর্যাপ্ত ইউয়ান না থাকে তাহলে ডলার দিয়েই ইউয়ান কিনতে হবে। সেখানেও লাভ-ক্ষতির একটা হিসাব আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব আমার আসলে জানা নেই। আপনার যদি বেশি রপ্তানি আয় থাকতো সেদেশ থেকে, তাহলে হয়তো এটি আপনি করতে পারতেন। আমরাতো আমদানিনির্ভর। আপনি কয়টা ইউয়ান আয় করেন? আমাদের যদি ইউয়ান থাকতো তাহলে একটা কথা ছিল। আপনি ইউয়ান কোত্থেকে পাবেন? এখন ডাবল ট্রানজ্যাকশন করলে লস হবে না? সেটা যদি করেনই তাহলে বাংলাদেশি মুদ্রায় দিতে পারেন সবকিছু। সেটাতে নিশ্চয়ই তারা আবার রাজি হবে না। এটা আসলে আমি জানি না যে হয়তো ছোটখাটো কোনো ট্রেডবিল হতে পারে। কিন্তু বড় বড় পার্টনারের সঙ্গে কীভাবে এটা করবে? অতীতে এমন উদ্যোগ নেয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন তখনো তা সফল হয়নি।

উল্লেখ করা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগ গত ১২ই এপ্রিল রাশিয়ার জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের কয়েকটি সহযোগী সংস্থাসহ মোট ১২০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস পরদিনই এক কূটনৈতিক পত্রে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের টাকা লেনদেনে আপত্তি জানায়। চলতি মাসের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, চীনা মুদ্রা ইউয়ানে রূপপুরের ঋণের টাকা পরিশোধে সিদ্ধান্ত হয়েছে। চীনের তৈরি ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমে (সিআইপিএস) ইউয়ান ব্যবহার করে এই ঋণ শোধ করা হবে বলে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ব্যবহার কমাতে চীন ২০১৫ সালে এই সিআইপিএস চালু করে।

রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান রোসাটমের সহযোগিতায় পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বাংলাদেশ সরকার নিজেই জোগান দিচ্ছে। আগামী ২০২৪ সাল থেকে ২৮ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে।