ইউনূস সরকারকে ডান্ডাবেড়ি পরাতে চান দেবপ্রিয়

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৩: ৩৯
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৩: ৫৩

ইউনূস সরকারকে ডান্ডাবেড়ি পরাতে চান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সম্প্রতি দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশপ্রাপ্ত জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির নেতা সারোয়ার তুষার এ মন্তব্য করেন।

মঙ্গলবার রাতে সারোয়ার তুষার তার নিজের ফেসবুক আইডিতে লেখেন- দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মহাশয় হচ্ছেন বর্তমান ইন্টেরিম সরকারের ঘরের শত্রু বিভীষণ। তিনি তার বিভ্রান্তিকর ‘তত্ত্ব’ দিয়ে এই সরকারকে ডান্ডাবেড়ি পরাতে চান যেন ইন্টেরিম সরকার সংস্কার থেকে দূরে থাকে। এই সরকার যেন মৌলিক সংস্কার করতে না পারে, বা সেই পথে না যায়, এজন্যই মূলত দেবপ্রিয় সাহেব বৈধতার বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন তুলে সরকারকে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন।

তার বার্তা পরিষ্কার। এই সরকারের উপদেষ্টাদের তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছেন, সংস্কার সংস্কার না করে তোমরা এক্সিট প্ল্যান কর। বেশি এম্বিশাস হয়ো না, তোমাদের পদক্ষেপগুলো কিন্তু বৈধতা পাবে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার করবে কিংবা এই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পরের সরকার বৈধতা দেবে না— ইত্যাদি চিন্তা ও বয়ান মূলত সংস্কারে ঠুলি এঁটে দিয়েছে। ফলে এই সরকারও অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। এটা এক ধরনের আত্মসমর্পণ।

এই আত্মসমর্পণের পেছনে মূলত ‘বৈধতা’ সংক্রান্ত দেবপ্রিয়দের বিভ্রান্তিকর ও মতলবি বয়ান মারাত্মক ভূমিকা রেখেছে।

৮ আগস্ট থেকে পরবর্তী সংসদ গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপদসমূহের বৈধতা কীভাবে অর্জন করা যাবে? বিএনপিসহ ‘মূলধারা’র (পড়ুন এস্টাবলিস্টপন্থী) বিদ্বৎসমাজকে বলতে শোনা যাচ্ছে, পরবর্তী পার্লামেন্টেই তো আপনাদেরকে নিজেদের কর্মকাণ্ডগুলো অনুমোদন করে নিতে হবে।

আমার ধারণা, এই চিন্তাপ্রণালী সংস্কারের একটা সীমা টেনে দিয়েছে। “কী আর সংস্কার করবেন, আমরা যদি পার্লামেন্টে গিয়ে অনুমোদন না দেই?” কিংবা “আপনাদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা তো আমাদের (নির্বাচিত সংসদ) কাছ থেকেই নিতে হবে!”

এ ধরনের বক্তব্যে এই সরকার নিজেও খানিকটা বিচলিত। আসলেই তো, পরের পার্লামেন্টে যারা যাবে তাদের সাথে নেগোসিয়েশন না করে সংস্কার করলে তো লাভ নাই, নিজেদের সেইফ এক্সিটের জন্যও তো তাদের দাবিগুলো মানতে হবে! — এ ধরনের পশ্চাৎপদ ও রক্ষণশীল চিন্তায় বর্তমান সরকার জর্জরিত বলে মালুম হয়।

বলা বাহুল্য, গত ৮ আগস্ট থেকে পরবর্তী সংসদ গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বৈধতার জন্য পরবর্তী সরকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কোনো দরকার নাই। বর্তমান সরকার চাইলেই নিজের বৈধতা নিজে আদায় করে নিতে পারত/পারে।

আইনশাস্ত্রবিদ ও দার্শনিক হ্যান্স কেলসেনের (Hans Kelsen) কথা বাংলাদেশে অনেকেই জানেন। তার একটা প্রধান যুক্তিই হচ্ছে ক্ষমতাই ক্ষমতার ভিত্তি ও বৈধতা। কেউ যদি ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে— সেটা গণঅভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান বা অন্য কোনো পন্থায়— সে তার নিজের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা নিজেই তৈরি করতে পারে।

এ কারণেই কোনো সামরিক শক্তি ক্ষমতা দখল করার সাথে সাথে ফরমান জারি করে তথা নিজেদের ক্ষমতাকে নিজেরাই বিধৃত করে। ইহাকেই প্রোক্লেমেশন বলে। মিলিটারিরা দিলে সেটা মিলিটারি প্রোক্লেমেশন। গণঅভ্যুত্থানের সরকার/শক্তি দিলে সেটা গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন। পরবর্তী ‘নির্বাচিত’ সরকার এসে সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘বৈধতা’ দেবে— এ ধরনের ছেলেমানুষি ও হাস্যকর কথা তারা প্রোক্লেম করে না।

সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখল করে ফরমান জারি করে বলা হয়েছে, ফরমান মোতাবেক রাষ্ট্র চলবে, তবে সংবিধানও বহাল থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই এমন নজির দেখানো সম্ভব।

এখন, চিন্তা করেন, সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখল করে মিলিটারি প্রোক্লেমশন জারি করতে পারবে তথা নিজেদের ক্ষমতা আরোহণকে নিজেরা বৈধতা দিতে পারবে অথচ গণঅভ্যুত্থানের পরে জারিকৃত প্রোক্লেমেশন নাকি পরের নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে! অদ্ভুত ব্যাপার!

বাংলাদেশের মৌলিক ও গভীর গণতান্ত্রিক সংস্কার ঠেকিয়ে দেয়াই দেবপ্রিয় সাহেবদের মূল এজেন্ডা। তারা যখন নির্বাচনের কথা বলেন, তখন মূলত প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রকে রুখে দেয়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনকে মতাদর্শ আকারে হাজির করেন।

তারা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধীনে নির্বাচন চান না; তারা মূলত চান বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র— যার সরাসরি বেনিফিশিয়ারি তারা— বহাল থাকুক, কিছু লোক দেখানো কসমেটিকস ও উপরি ‘সংস্কার’ হোক। এর মধ্য দিয়ে স্ট্যাটাস-কো অক্ষুণ্ন থাকুক, জাস্ট ক্ষমতার পালাবদল হোক।

এ কারণে ‘পটপরিবর্তন’ তাদের প্রিয় শব্দ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে তারা সাইজ করে একে স্রেফ রেজিম চেইঞ্জে সংকুচিত কর‍তে চান। এ কারণে বর্তমান সরকারকে ‘বৈধতা’র জুজুবুড়ি দেখিয়ে থামিয়ে দিতে চান দেবপ্রিয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here