ইউনূসকে নেতৃত্ব দিতে দিন

logo
গোলাম এম সোহরাওয়ার্দী
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ১১

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ প্রকৃত নেতৃত্ব পায়নি। শহীদ জিয়া কঠোর পরিশ্রম, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এরপর থেকে অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত কোনো নেতার কাছ থেকে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেখা যায়নি। এদিকে, রাজনীতিবিদরা প্রকৃত সংস্কারকে গুরুত্ব না দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিরামহীন বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েই যাচ্ছেন।

বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মির্জা আব্বাস সম্প্রতি জেন-জি যোদ্ধাদের ‘শিশু’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, তাদের উচিত বড়দের অনুসরণ করা। অথচ তার উচিত নিজ দলের ১৫ বছরের রেকর্ডের দিকে নজর দেওয়া। তারা তাদের কারাবন্দি নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেননি এবং লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা অর্থপূর্ণ বিক্ষোভ করতে পারেননি; মাঠে দৃঢ় নেতৃত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

জনগণ রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ। তারা বুঝতে পারেন আসল নেতৃত্ব কে। অনেকে মনে করেন, তারেক জিয়া এবং খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির অন্য নেতারা প্রকৃত সংস্কারের চেয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতার ভিত্তি শক্ত করতে বেশি আগ্রহী। তৃণমূলের কর্মীরা দলের মঙ্গলের জন্য কাজ করার পরিবর্তে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। জনগণের সেবার পরিবর্তে তারা এখন নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত।

অধ্যাপক ইউনূসকে নম্র স্বভাবের মনে হলেও আসল কাজে তিনি দৃঢ় এবং নীতিবান। ক্ষমতার জন্য তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তিনি জনগণের প্রতি নিবেদিত। তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। চারপাশে যোগ্য ব্যক্তিদের রাখেন। সর্বোপরি, তিনি দুর্নীতি থেকে মুক্ত। পেশাদার রাজনীতিকরা যখন ক্ষমতা দখলের জন্য নির্বাচন-নির্বাচন করছেন, তিনি তখন পচে যাওয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পদ্ধতিগত সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনার প্রতি দীর্ঘদিন ধরে অনুগত আমলাতন্ত্র এই পরিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগ গভীর রাজনীতিকীকরণের শিকার হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো। এ জন্য ধৈর্য, অটল নিষ্ঠা ও নিরলস অঙ্গীকার প্রয়োজন। তবু অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার হচ্ছে। গোপন ডিটেনশন সেন্টারগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বচ্ছ অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

দুর্নীতিতে জর্জরিত একটি জাতির জন্য দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রয়োজন। জেন-জি-র ছাত্ররা ইউনূসের প্রতি তাদের আস্থা রেখেছেন এবং তাদের দৃঢ়তায় সংস্কারের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। পুরো বিশ্ব ইউনূসকে একজন সৎ ও বিশুদ্ধ চরিত্রের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশের ভেতরকার দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা তার সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। এদিকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া প্রতিবেশী একটি দেশ ইউনূসের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইউনূস এবং জাতির অগ্রযাত্রাকে দুর্বল করতে লাগাতার ভুল তথ্য ছড়াচ্ছেন তারা। কিন্তু এ কাজে তারা সাফল্য পাননি।

এই জটিল রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কিছু বিএনপি নেতা বাইরের শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে গোপনে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন চাইছেন। জেন-জি-র নেতারা এই বিশ্বাসঘাতকদের চেনেন এবং এ ধরনের গোপন লেনদেন প্রতিহত করতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশের প্রকৃত শান্তি ও সার্বভৌমত্ব তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন প্রতিবেশীরা বাংলাদেশকে সম্মান করবে এবং একে পুতুল রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং সমান অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করবে।

বছরের পর বছর ধরে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে একটি আজ্ঞাবহ জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছে, যাতে সহজেই তারা এ দেশকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কখনো তা হতে দেবে না। জেন-জি-ই এখন আশার আলো, যারা পরিবর্তনের দাবিতে অটল। সংগত কারণেই, মির্জা আব্বাসের মতো নেতারা, যারা অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তারা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।

অধ্যাপক ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপ্লব এনেছেন; আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ‘দ্য মুসলিম ফাইভ হানড্রেড’-এ তার অন্তর্ভুক্তি দারিদ্র্যবিমোচন এবং সামাজিক উদ্ভাবনে তার প্রভাবের প্রমাণ।

ইউনূসের দর্শন সহজ কিন্তু গভীর। তার ভাষায়Ñ ‘টাকায় টাকা বানায়। যদি তোমার কাছে তা না থাকে, তাহলে তুমি অন্যের করুণায় নিয়োগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করো। যদি তোমার হাতে সেই টাকা থাকে, তাহলে তুমি মরিয়া হয়ে এর সর্বোত্তম ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো। আর এতেই তোমার আয় আসতে থাকবে।’

ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। মাত্র আট মাসের মধ্যে তার প্রশাসন হাসিনার দমন-পীড়নের যন্ত্র ভেঙে দিয়েছে; দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় এনেছে এবং মৌলিক মানবাধিকার পুনরুদ্ধার করেছে। তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরপর তিনি সরে দাঁড়াবেন।

ইউনূস বাংলাদেশের দুর্দশাগুলোকে হাসিনার শাসনের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হাসিনার সময় কোনো সরকার ছিল না। এটি ছিল দস্যুদের পরিবার। বসের আদেশ এলেই তা বাস্তবায়িত হতো। কেউ এতে বাধা দিয়েছে? ব্যস, আমরা তাদের গুম করে দেব। নির্বাচন করতে চান? আমরা নিশ্চিত করব যে আপনি সব আসনে জিতেছেন। আপনি টাকা চান? ব্যাংকে আছে; এক মিলিয়ন ডলার নিয়ে যান; এটা কখনো ফেরত দিতে হবে না।’

হাসিনার শাসনামলে পদ্ধতিগত দুর্নীতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এমনকি, তার ভাগনি, যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিকও বাংলাদেশের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন। অবশেষে, ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তাকে। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই দুর্নীতি যে বিশাল ক্ষত তৈরি করেছে, তা অনস্বীকার্য।

ইউনূস একজন পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব; ক্ষমতা বা সম্পদের চেয়ে জনগণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। বাংলাদেশকে যদি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অতীত থেকে মুক্ত করতে হয়, ভবিষ্যতের নেতাদের অবশ্যই এ রকম সেবা, সততা ও সংস্কারের আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। জাতির রাজনৈতিক আত্মা দশকের পর দশক ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে; প্রকৃত রূপান্তরে সময় লাগবে। ভুলভ্রান্তি থাকবে, তবে এ সময়টাতে জেন-জিকে নিন্দা করার পরিবর্তে আমাদের অবশ্যই তাদের সমর্থন করতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে শিখতে হবে।

মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘ওরা শিশু, ওদের উচিত আমাদের ফলো করা।’ কিন্তু সত্য হলো, পুরোনা রাজনৈতিক শ্রেণিকে তাদের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এমন সব বয়স্ক ব্যক্তিরা আছেন, যারা দুর্নীতিবাজ; নিজের স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য। কেউ তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করলে এর বিনিময়ে তারা দেশের সার্বভৌমত্বও বিক্রি করে দেবেন। তাদের তথাকথিত অভিজ্ঞতা শুধু দুঃশাসনের ইতিহাস। ভবিষ্যতে আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাদের ওপর কি আমরা ভরসা রাখতে পারি?

তারা নির্বাচনকে এমন একটি প্রদর্শনী বা উৎসব হিসেবে দেখেন, যেখানে ভোটারদের কাজ শুধু ভোট দেওয়া, এরপর ভোটাররা দৃশ্যপটে থাকবেন না। কিন্তু নির্বাচন এ রকম কোনো উদযাপন নয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ তাদের নেতা নির্বাচন করবেন এবং শাসনব্যবস্থায় তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করবেন। বাংলাদেশের মানুষ নির্বোধ নন; তারা বোঝেন যে রাজনৈতিক উৎসব শেষ হয়ে গেলেও তাদের সংগ্রাম একই থাকবে অথবা আরো তীব্র হবে।

এখন আমরা যদি ইউনূসের সরকারকে অর্থবহ সংস্কার বাস্তবায়ন করতে না দিই, তাহলে আমরা এই সুযোগ আর কখনো পাব না। শুধু একটি নির্বাচন বাংলাদেশের গভীর সমস্যার সমাধান করবে না। আমাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক চশমার মোহ থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত পদ্ধতিগত পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে হবে। এমন সংস্কার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব না ঘটে। এমন সংস্কার করতে হবে, যার মাধ্যমে শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, জনগণের ক্ষমতায়ন হবে। বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবগুলোয় অগ্রগতি থাকলেও এতে প্রকৃত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা নেই। রাজনীতিবিদরা নির্বাচনকে জনগণের সেবা করার দায়িত্বের চেয়ে ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই বেশি দেখেন; এখনো তা দেখছেন। এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

অধ্যাপক ইউনূস আমাদের কনফুসিয়াস, আমাদের নেলসন ম্যান্ডেলা, আমাদের মার্টিন লুথার কিং এবং আমাদের গান্ধী। একের ভেতর সব। আমাদের তাকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু, তাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। জেন-জি তার ওপর আস্থা রেখেছে; আমাদেরও একই কাজ করা উচিত। আসুন, আমরা তাকে নেতৃত্বের সুযোগ দিই। যদি সুযোগ পান, বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা তার আছে।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘সাউথ এশিয়া জার্নাল’-এর প্রকাশক; ‘বাংলাদেশ মেরিটাইম হিস্ট্রি’ এবং অন্যান্য নটিক্যাল প্রকাশনার লেখক; বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট [email protected]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here