বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ধ্বংস করে হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ভারত আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়েছিল। অবশ্য ২০১৭ সালে ‘দি কোয়ালিশন ইয়ার্স’ নামের বই লিখে আড়ালের কলকাঠিকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং শেখ হাসিনার বিশেষ মুরব্বী শ্রীযুক্ত প্রণব মুখার্জি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সব করলাম আমরা আর ক্রেডিট নিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং জাতিসংঘ। থলের বিড়াল বের করে দিয়ে উচিত কাজই করেছিলেন বাইরে সেক্যুলার, ভেতরে কট্টর ইসলামবিদ্বেষী বাঙালি হিন্দু প্রণব বাবু। তবে ২০০৭ সালে ভারতের ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি নির্মানে প্রত্যক্ষে কামলাগিরি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং জাতিসংঘ। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া আর জাপান ছিল জোগালির ভূমিকায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র সেই সময় বিশ্বের তাবৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধ চালাচ্ছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সাজানো নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন হাসিনাকে তথাকথিত ‘ভুমিধস বিজয়ের’ বন্দোবস্ত করে দিলো, তখনও বুশ জুনিয়র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন কাঠখোট্টা চেহারার মার্কিন রাষ্ট্রদূত, জেমস মরিয়ার্টি গণভবনে হাসিনার প্রত্যাবর্তনে এতই পুলকিত হয়েছিলেন যে, ঢাকায় তিন বছরের দায়িত্ব সমাপ্ত করে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত তার দাঁত আর ঠোটের আড়ালে নিতে পারেন নাই। সর্বক্ষন দন্ত বিকশিত করেই থেকেছেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন ডেমোক্রেট দলের বারাক ওবামা। তিনি দুই দফায় আট বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার প্রথম দফায় সেক্রেটারি অব স্টেট হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। জনশ্রুতি রয়েছে হিলারির সাথে শেখ হাসিনার তেমন একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। বিশেষ করে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রফেসর ইউনুসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের দুর্ব্যবহারে হিলারি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা সাধ্যমত হিলারির ওপর শোধ নিয়েছিলেন। সেক্রেটারি অফ স্টেট থাকা অবস্থায় হিলারির বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ তুলে হাসিনা প্রায়ই অশ্লীল ইংগিত দিয়ে প্রফেসর ইউনুসের সাথে ক্লিনটন পরিবারের সম্পর্ককে রাধাকৃষ্ণ সমগোত্রীয় বলে ঠাট্টামশকরা করতেন। হাসিনার মার্কিন প্রবাসী উদ্ধত ও অমার্জিত পুত্র সজীব জয় তার টুইটার অথবা ফেসবুক অথবা উভয় সামাজিক মাধ্যমে হিলারির পরাজয় নিয়ে সেই সময় অবমাননাকর সব স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন।
২০১৩ সালের একদলীয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা [আওয়ামী লীগের ভাষায় ‘কাজের বেটি মর্জিনা’] ঢাকা-দিল্লি-ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রচুর ছোটাছুটি করেও সফল হতে পারেন নাই। উপরি হিসেবে দিল্লীতে বেচারা মোজেনাকে যথেষ্ট অপমান সইতে হয়েছিলো। তখন দিল্লীতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার তাকে ‘ফোপরদালালি’ করতে নিষেধ করেছিল। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে হিলারি ক্লিনটন আর সেক্রেটারি অব স্টেট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে জন কেরি হিলারির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়া ভারতকে বর্গা দেয়ার মার্কিন নীতির একজন কট্টর সমর্থক ছিলেন এই কেরি। ওবামা-কেরি টিম বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনকে সমর্থনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলে হাসিনার পক্ষে বাংলাদেশে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিলো। শেখ হাসিনা এতটাই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিলেন যে, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে তিনি ব্যক্তিগত খুনি বাহিনী [Death Squad] পর্যন্ত তৈরি করে নিয়েছিলেন। আইজিপি বেনজির, ব্রিগেডিয়ার জিয়া, লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সায়িদ, ওসি সালাহউদ্দিন, ইত্যাদি ভয়ংকর রকমের স্যাডিস্ট খুনিরা সেই সময়েরই সৃষ্টি। ফিবছর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শোচনীয় মানবাধিকার পরিস্থিতির কমিয়ে দেখানো যৎকিঞ্চিত কাহিনি থাকলেও, সেক্রেটারি অব স্টেট সেগুলো দিল্লীর প্রভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা বাংলাদেশের জনগণের দুর্গতি এবং গণতন্ত্রহীনতার দিকে ফিরেও তাকান নাই।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভে বিশ্বের যে তিন ইসলামবিদ্বেষী নেতা সর্বাধিক আনন্দিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনা একজন। বাকী দুজন হলেন ভারতের নরেন্দ্র মোদী এবং ইসরায়েলের বেনইয়ামিন নেতানইয়াহু। গত চার বছরের ট্রাম্প জামানায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশে তার ফ্যাসিবাদি শাসনকে আরও সুদৃঢ় এবং সর্বব্যাপী করতে সমর্থ হয়েছেন। শেখ হাসিনা বিশ্বকে এমন একটি ধারনা দিতেও সক্ষম হয়েছেন যে, বাংলাদেশ নামক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই ঠেঙ্গিয়ে পদানত করে রাখতে এই নির্মম ও বেপরোয়া মহিলার কোন বিকল্প নাই। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় যাদেরই যাতায়াত আছে তারা অবধারিতভাবেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন যে, হাসিনার বিকল্প বাংলাদেশে কে আছে? আরও শুনবেন, ‘হাসিনা গেলে তো আবার হাওয়া ভবন আসবে’ জাতীয় বায়বীয় দুশ্চিন্তার ভড়ং। এখন যে এক গণভবন হাজার হাওয়া ভবনকে হজম করে ফেলেছে সেটা নিয়ে কারো যেন কোন মাথাব্যথা নাই। এ জাতীয় প্রশ্ন যে শুধু ভারতীয় বা পশ্চিমা দূতাবাসগুলোতে শোনা যায় তা কিন্তু, মোটেও ভাববেন না। চীনা দূতাবাসে যান, একই প্রশ্ন শুনবেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল, আওয়ামী লীগের ভাষায় ‘অচ্ছুত পাকিরাও’ আজকাল বেশরমের মত একই প্রশ্ন করে। উল্লেখ্য ভারতেও ‘গুজরাটের কসাই’ মোদীর বিকল্প কেউ নাই এমন একটি বেশ কার্যকর এবং জনপ্রিয় প্রচারণা রয়েছে। এই জাতীয় প্রচারণার একটাই অর্থ হয়। আর তা হোল, হাসিনা এবং মোদীকে আজীবন ক্ষমতায় রেখে দিতে হবে। বাংলা প্রবাদ অনুযায়ী চোরে চোরে তো মাসতুতো ভাই হয়। পাঠক, খুনিতে খুনিতে কি হয় জানেন নাকি? আমার অবশ্য জানা নাই। কারো জানা থাকলে একটু কষ্ট করে মন্তব্য কলামে জানালে বাধিত হব। অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রি বলেছেন সেই সম্পর্ক নাকি স্বামীস্ত্রীর। হতেও পারে।
যাই হোক, ৩ নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কদিন আগে বাংলাদেশে এক যুগ ধরে চলমান পাইকারি গুমখুন এবং বিচার বহির্ভূত হত্যার বিষয়ে বিস্ময়করভাবে মার্কিন সিনেটের ঘুম ভেঙ্গেছে। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অবিলম্বে খুনি বাহিনী র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য দ্বিদলীয় আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবসম্বলিত পত্র পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে গুমখুনের অন্যতম প্রধান হোতা ব্রিগেডিয়ার জিয়া এই র্যাবে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই ভারতের বলিউডের সিনেমার ইতিহাসের কিংবদন্তীতুল্য খলনায়ক ‘গব্বর সিংয়ের’ মত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গব্বরের নামে ভয় দেখিয়ে ভারতে একসময় শিশুদের যেভাবে ঘুম পাড়ান হতো, বাংলাদেশে জিয়াউল আহ্সান ঠিক তেমন একটি দানবের নাম। সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের টেলিআলাপেও বাংলাদেশের এক নম্বর সরকারি, পেশাদার খুনি হিসেবে জিয়ার নাম বারে বারে এসেছে। যদি কোনদিন মার্কিন প্রশাসন সত্য সত্যই নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে জিয়াউল আহ্সানের নাম এক অথবা দুই নম্বরে থাকবে বলেই আমার ধারনা। অপরজন হবেন বর্তমান আইজিপি বেনজির। মার্কিন সিনেটের ঐ চিঠিতে বাংলাদেশের মতো ভারতের এক তুচ্ছ করদ রাজ্যের সরকারের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, খানিক আগেই বললাম না, শেখ হাসিনা এমন এক মায়াজাল বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন যাতে সকলের কাছেই মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এই ফ্যাসিস্ট শাসকের তো কোন বিকল্প নেই। এই পর্বতপ্রমাণ আস্থা থেকেই তিনি দশ দশজন মার্কিন সিনেটরের [ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান] গালে রীতিমতো চড় মেরেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরের দিন ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর ১১৬ জন সদস্যকে ‘বীরত্বপূর্ণ/সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদক এবং নগদ অর্থ দিয়েছেন। পদকপ্রাপ্তদের প্রথমজনই হলেন বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। আজব কাণ্ড। আরে বাবা, বীরত্ব, পেশাদারিত্ব, মেধা, ইত্যাদি বিবেচনা করেই তো এক সেনা অফিসারকে বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে বসান হয়। তারই তো অধস্তন অফিসারদের সন্মানিত করার কথা। তিনি আবার নিজেই পদক নেবেন কেন? সরকার যদি সত্যিই মনে করে সেনাপ্রধান আমাদের অজান্তে কোন শত্রুদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছেন তাহলে তাকে ভারতের মত ফিল্ড মার্শাল উপাধি দিলেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাপ্রধান নিরস্ত্র দেশবাসী ছাড়া আর কার সংগে কবে যুদ্ধ করলেন? মিয়ানমারও তো বাংলাদেশকে পাত্তা দেয় না। তারাও ভারতের দেখাদেখি সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি করে মারতে শুরু করেছে। তাহলে কী জেনারেল আজিজ বিজিবি প্রধান থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত আলেমদের উপর গণহত্যা চালানোর ‘বীরত্ব’ দেখানোর পুরস্কার এতদিনে পেলেন? সেক্ষেত্রে দেশের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিবারের আজিজ সাহেব সেনাপ্রধান হয়েছিলেন অন্য কোন্ যোগ্যতায়?
এবার পুরস্কারপ্রাপ্তদের দুই নম্বর ‘মহাবীরের’ নামটার দিকে তাকাই। মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লেও এর চেয়ে বেশি অবাক হতাম না। বীরপুঙ্গবের নাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহ্সান। জী পাঠক। এই সেই ব্যক্তি যে কিনা হাসিনার নির্দেশে এবং মেজর জেনারেল[অবঃ] তারেক সিদ্দিকির তত্ত্বাবধানে দেশের অধিকাংশ গুমখুনের হোতা। স্বয়ং বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ সরাসরি জিয়াউল আহ্সান এবং জুবায়েরকে বাংলাদেশে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী করেছেন। হাসিনা যে কেন আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এক চরম বিতর্কিত ব্যক্তিকে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিতে গেলেন সেটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় হাসিনার এই বিস্ময়কর সিদ্ধান্তের নিম্নোক্ত তিনটি ব্যাখ্যা হতে পারেঃ
১। সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ফাঁস হওয়া বিস্ফোরক টেলিআলাপের প্রেক্ষিতে মাফিয়া নেত্রী হাসিনা একই মেডেল দুজনকে দিয়ে আজিজ এবং জিয়াকে বুঝিয়ে দিলেন যে, পিতলের চকচকে তারকাখচিত কাঁধ নিয়ে, বুকে এক সারি রিবনবাঁধা মেডেল ঝুলালেও তারা সকলে ফ্যাসিস্ট শাসকের ভৃত্যমাত্র। সত্যজিৎ রায়ের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশের’ ভিলেন রাজার মত হাসিনা বশংবদ সেনাবাহিনীর অফিসারদের বলছেন, ‘তোমরা যাদের আমি পুষি, তোমাদের কাজে আমি বড় খুশী’। হীরক রাজা চামচা মন্ত্রিদের দিকে হীরার হার ছুঁড়ে দিতেন আর হাসিনা ওদের বুকে আরও একটা করে মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন। সুতরাং, নিজেদের মধ্যে কোন বাদবিসম্বাদ না রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে মনিবের পা চেটে যাওয়াই এই সব নামসর্বস্ব জেনারেলদের একমাত্র কাজ। ফ্যাসিস্ট মহিলার পা চাটাতেই তাদের যা কিছু গৌরব।
২। হাসিনা ৪ তারিখে অন্য অনেকের মতই মনে করেছিলেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পই জিততে চলেছেন। আমিও কিন্তু, ঐ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত ফলাফলের আলোকে ট্রাম্পের দিকেই পাল্লা ভারী ভেবেছিলাম। ট্রাম্প জিততে পারলে শেখ হাসিনার মার্কিন সিনেটের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে হয়তো মাথা না ঘামালেও চলতো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত চার বছরে দেখিয়েছেন যে তিনি একনায়কদের অতীব পছন্দ করেন এবং মানবাধিকার তার কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে যে, সৌদি আরবের যিয়নপন্থী যুবরাজ এমবিএস একদল ব্যক্তিগত খুনি পাঠিয়ে ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক খাশোগিকে ইস্তানবুলের সৌদি কন্স্যুলেটের ভেতরে পৈশাচিকভাবে হত্যা করলে সাড়া বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমবিএসকে প্রকারান্তরে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এহেন বিকারগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন সিনেটের উদ্বেগকে যে কোনরকম পাত্তা দিতেন না সেটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অতএব, ৪ নভেম্বর খুনি জিয়াউল আহ্সানকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে ট্রাম্পের চেয়ে অধিকতর বিকারগ্রস্ত হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে এক ভয়াবহ পরিণতির শীতল বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
৩। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প নাই জাতীয় প্রচারণার সফলতার বিষয়ে ফ্যাসিস্ট শাসক অতি মাত্রায় আস্থাশীল। তিনি ধরেই নিয়েছেন, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন নীতিতে কোন অর্থবহ পরিবর্তন হবে না। এর আগে মুসলমান পিতার খ্রিষ্টান সন্তান বারাক ওবামা ডেমোক্রেট দলেরই মনোনীত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি তার শাসনকালে হিন্দুত্ববাদী মোদীকে কেবল কৌশলগত মিত্রেরই মর্যাদা দেননি, গুজরাটের কসাইকে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের ওপর জুলুম চালানোর একচ্ছত্র কর্তৃত্বও দিয়েছিলেন। দিল্লীর প্রতি দুর্বল সেই ওবামাই এখন ডেমোক্রেট দলের অন্যতম প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক। জিয়াউল আহসানকে পুরস্কার দিয়ে হাসিনা প্রকৃতপক্ষে সিনেটরদের গালে সপাটে চড় লাগিয়ে জানান দিলেন যে, দিল্লী পাশে থাকতে তিনি ওয়াশিংটনকে থোড়াই কেয়ার করেন। শেখ হাসিনা এর আগেও বহুবার হুমকি দিয়ে বলেছেন কাছের বন্ধু [অর্থাৎ ভারত], দূরের যে কোন বন্ধুর [অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র] চেয়ে অধিক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তার নির্দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের ওপর ঢাকায় আওয়ামী গুণ্ডারা হামলাও চালিয়েছিল। ওয়াশিংটন টু শব্দটিও করেনি। এবারও আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চিহ্নিত খুনিদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদান করে হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখালেন যে তিনিই গুমের আসল জননী।
সব শেষ কথা, জো বাইডেন পুরো আট বছর বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাই, নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে বাংলাদেশ নীতিতে কোন নাটকীয় পরিবর্তনের আশা করছি না। তবে ট্রাম্পের তুলনায় বাইডেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে অনেক সংবেদনশীল হবেন বলেই আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে, অন্তত সিনেটের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের জোর সম্ভাবনা রয়েছে। তাতেও কিন্তু হাসিনার গদি টলবে না। পুরনো কথা আবারও বলছি। গণঅভ্যুত্থান ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকার পরিবর্তনে মার্কিন প্রশাসনের কোন সহায়তার আশা আমি অন্তত রাখি না। তবে, ভবিষ্যৎ একমাত্র মহান আল্লাহ্তালাই জানেন।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ।