- সুরঞ্জন ঘোষ
- ২৩ মার্চ ২০২২, ২০:৩৪
মার্চেই প্রথম দিকেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু। ইউক্রেন সঙ্কট স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় নতুন পুনর্বিন্যাসের পালা। নিজের অদ্বিতীয় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে ইউক্রেন তথাকথিত ‘বাটারফ্লাই ইফেক্টকে (ক্ষুদ্র ঘটনার বিস্তৃত আকার) মেনে নিয়েই বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি শত্রæতা লালন-পালন করেছে। ইউক্রেনের বর্তমান সঙ্ঘাতের পেছনে শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার দ্ব›দ্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয় নয়, পেছনে বিশ্বের প্রধান দুই পরাশক্তি রুশ-মার্কিন বিরোধও জড়িত। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। ‘কমলা বিপ্লব’ নামে পরিচিত ওই আন্দোলনে বৈধভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টের উৎখাত শুধুই অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ফলে ঘটেনি, অন্তরালে ছিল রুশ-মার্কিন ছায়াযুদ্ধ। ইউক্রেন সঙ্কটর পেছনে রয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক জটিলতা। নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ইউক্রেনের যুদ্ধ মূলত ঠাণ্ডা যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি।
১৯৯০ সালে কুয়েত দখলের মধ্য দিয়ে সাদ্দাম হোসেন নিজের পরিণতি ডেকে আনেন। একই পরিণতি হওয়ার কথা ভ্লাদিমির পুতিনের। তবে বিষয়টি এত সহজ নয়। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। সংখ্যা ও ভয়াবহতার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। পুতিন ও সাদ্দাম হোসেনের তফাতটা এখানেই। অনেকটা হাঁকডাক করেই পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শুরুতে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে নানা হুমকি-ধমকি থাকলেও এখন বসে বসে যুদ্ধ দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইউক্রেনের সমর্থনে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের বাইরেও অর্থ, যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। ন্যাটোর সদস্য না হওয়া সত্যেও এমন দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডও অস্ত্র ও অর্থ পাঠিয়েছে। রাশিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে ইউক্রেন লড়লেও যুদ্ধে ন্যাটো ও ইউরোপীয় দেশগুলো পরোক্ষভাবে কম করছে না। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে আরো অস্ত্র কিনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা সমন্বয়ের কাজ করছেন। ‘ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটি’ তহবিল থেকে অস্ত্র কেনার ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তহবিল আরো সমৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ অস্ত্র, অর্থ ও সামরিক সরঞ্জাম কিনতে নিজ নিজ দেশে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে অতিরিক্ত ১৫ হাজার সেনা পাঠিয়েছে। তবে এ সব কিছু শুধু ইউক্রেনের সাথে যে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে চাওয়া তা নয়, আসল উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশে সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার সামর্থ্যরে যদি সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রস্তুতি যেন কাজে লাগে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও জুয়া খেলায় নেমেছেন। ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে নিজ দেশের নিরপেক্ষ অবস্থান বা মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নে সম্মত হয়ে তার যুদ্ধ এড়ানোর সুযোগ ছিল; কিন্তু তা না করে তিনি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিগগিরই জানা যাবে তার কাজটি ঠিক ছিল কি না। তবে একথা বলতে হয়, জেলেনস্কি সম্ভবত নিজেকে সত্যিকারের শক্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থাপনের তাগিদ অনুভব করেছিলেন। ক্রেমলিন এবং নিজ দেশের বিরোধীদল উভয়ই তাকে স্রেফ কৌতুক অভিনেতা ও মেরুদহীন রাজনৈতিক অপেশাদার হিসেবে চিত্রিত করেছিল। বিপরীতে নিজেকে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হিসেবে তুলে ধরতে তাকে একটি ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করে। ভবিষ্যতে যখন গোপন নথি প্রকাশ পাবে; তখন আমরা হয়তো এটা জানতে পারব যে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
৩০ বছর ধরে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্ট অংশ সম্পর্কে পশ্চিমা; বিশেষ করে আমেরিকান নীতির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইউক্রেনে চলমান ঘটনায় ওই আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করা উচিত। পশ্চিমারা রুশ সীমান্তের দিকে ন্যাটো এবং ইইউকে প্রসারিত করছে। একই সাথে রাশিয়াকে নিকটতম প্রতিবেশীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং কঠোর সীমান্তনীতি ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সোভিয়েত-পরবর্তী সমাজের মৌলিক ধারা ভেঙে ফেলা পশ্চিমাদের কতটা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল? এ নীতির লক্ষ্য ছিল- সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত হওয়া রাশিয়াকে ইউএসএসআর ২.০ নামে একটি নতুন আগ্রাসী দৈত্য রাষ্ট্র হওয়া থেকে বিরত রাখা। কিন্তু এখন কী ঘটছে? বরং বিশাল পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়াকে পশ্চিমে একীভূত করাকে অগ্রাধিকার দেয়াই কী বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না? বড় কথা, এ জন্য দেশটির প্রস্তুতও ছিল। অথচ ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার অনেক কর্মকর্তাই পশ্চিমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন; এমনটি করা না হলে দেশটিতে জাতীয়তাবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান ঘটবে। প্রকৃতপক্ষে পুতিন নিজেও তার সর্বশেষ এক ভাষণে স্মরণ করেছিলেন যে, তিনি একবার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- রাশিয়াও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারে কি না; কিন্তু কোনো উত্তর পাননি। ২০০০ সালে পুতিন যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন তার রক্ষণশীল প্রতিদ্ব›দ্বীদের তুলনায় উদার ব্যক্তিত্ব হিসেবে পশ্চিমা সমর্থন পেয়েছিলেন। সুতরাং রাশিয়ার প্রতি নিজেদের চিরন্তন ভয় নিয়ে পাশ্চাত্য কি নিজের ফ্রাংকেনস্টাইন জন্ম দেয়নি? আসলে একটি যুদ্ধবাজ চক্রের কাছে ‘আগ্রাসী ও বিচ্ছিন্ন রাশিয়া’ হচ্ছে একটি দুধের গাভী, যা তাদের আকর্ষণীয় বেতন এবং লাভজনক চুক্তিগুলোর উৎস। নিশ্চিতভাবেই একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিচালিত অযৌক্তিক আগ্রাসন প্রত্যাহার করা গর্বিত শাসকগোষ্ঠীর জন্য কতটা কঠিন এবং তাতে যুদ্ধের অজুহাতগুলো কতটা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী, বিশেষ করে ব্রিটেন ভালো জানে। গত সপ্তাহে ইউক্রেন আক্রমণে পুতিন যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আফগানিন্তান যুদ্ধের সময় পশ্চিমাদের করা প্রতিধ্বনিই শুনতে পাওয়া যায়। ওই শাসকরা বলেছিলেন, ব্রিটেনের রাস্তায় নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে আফগানিস্তানের হেলমান্দে পশতুনদের হত্যা করছে ব্রিটিশ বাহিনী। এরপর পরাজয় স্বীকার করে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে ব্রিটেনের বহু বছর লেগেছিল। এ মুহূর্তে বাস্তবতার নীতি বলছে, যেভাবেই হোক পুতিনকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ইউক্রেন থেকে রুশ বাহিনীকে প্রত্যাহারকে সুন্দর মোড়কে দেখাতে মধ্যস্থতার উপযুক্ত শব্দ খুঁজে বের করতে হবে। মোট কথা, ইউক্রেন ও রাশিয়াকে অবশ্যই আবার প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে হবে, তাদের ভূগোল-ইতিহাসজুড়ে যা করতে বাধ্য করেছে। না হলে এর বিকল্প হচ্ছে কিয়েভে বছরের পর বছর দখলদারি ও পতুল সরকারের ক্ষমতায় থাকা। যতক্ষণ না রাশিয়ার অভ্যন্তরে উদারপন্থী কণ্ঠস্বর ক্রেমলিনে পরিবর্তন আনার আওয়াজ তোলে।
ইউক্রেন, রাশিয়া ও ইউরোপের বাকি অংশের প্রত্যেক মানুষের কাছে এ কণ্ঠস্বরই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাদের জন্য পশ্চিমাদের কাছ থেকে বহিষ্কার ও শত্রæতা নয়, বরং যোগাযোগ, বন্ধুত্ব ও উৎসাহ দেয়া দরকার। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া বন্ধ করতে হবে। অর্থপূর্ণ ক‚টনীতি আবার শুরু করতে হবে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি বলছেন, চীনের কর্মকাণ্ড থেকে বাইডেন প্রশাসনের মনোযোগ পুতিন নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে যে নতুন ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তা-ও চীন খুব একটা স্বাগত জানাবে না। এর মধ্যে চীন-রাশিয়ার বাণিজ্যও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে; গত বছর এটি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে ১৪ হাজার ৬৯০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে, এ বাণিজ্যের অঙ্কটি ইইউয়ের সাথে চীনের বাণিজ্যের অর্ধেক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। সুতরাং এ বাণিজ্য বৃদ্ধি কৌশলগত লক্ষ্য অনুসরণ করে হচ্ছে। সন্দেহের বিষয় হচ্ছে, বেইজিং মধ্যস্থতায় নিজেকে উন্মুক্ত রেখেছে বলে যে মন্তব্য করা হচ্ছে, তা রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থনের সমালোচনাকে হালকা করার কৌশল মাত্র। এটা স্পষ্ট, চীনকেও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এ আগ্রাসনের মূল্য দিতে হবে। ইউরোপীয় নেতাদের এটাই বারবার বলা উচিত। যদিও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে চীনের সক্ষমতা ও ইচ্ছা নিয়ে কম প্রত্যাশা থাকা উচিত, তবু বেইজিংকে চাপ দেয়ার একটা সুফল আছে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে সহায়তা করতে আরো বেশি কিছু করা থেকে চীনকে বিরত রাখা। আসলে পৃথিবীজুড়ে এখন মানবতাবাদ লুণ্ঠিত। সভ্যতার আলো প্রায় নির্বাপিত। সভ্যতার আলোকবর্তিকা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও পারস্পরিক বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে।
লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐকের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা ও সভাপতি, সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম।