এবার জঙ্গী নাটকের পর্দা উঠুক

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

ভারত, আমেরিকা, মইন-ফখরুদ্দিনের এক এগারো সরকার, ডিজিএফআই, এবং সামশুল হুদা- ব্রি:সাখাওয়াত-ছহুলদের নির্বাচন কমিশনের যোগসাজসে ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে অবিশ্বাস্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার আত্মজীবনীতে সেইসব ষড়যন্ত্রের ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন। দিল্লির অধীনস্ত: দানব সরকারকে অনন্তকাল ক্ষমতায় রাখার অভিপ্রায়েই উল্লিখিত শক্তিসমূহ তখন একজোট হয়ে কাজ করেছে। সেই বিতর্কিত নির্বাচনের কুশিলবদের একজন ব্রি: সাখাওয়াত বিপ্লবী সরকারের মহা প্রতাপশালী উপদেষ্টা হয়েছেন দেখে বিস্মিত হই। এভাবেই সুবিধাবাদিরা পুনর্বাসিত হয়ে থাকে। আশা করতে চাই যে, তার চরিত্র এতদিনে শুধরে গেছে।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ৫ আগস্টের এক মহান বিপ্লবে উৎখাত হওয়া পর্যন্ত মূলত: জঙ্গীতত্ত্ব ফেরি করেই প্রায় ১৬ বছর শেখ হাসিনা তার অবৈধ ফ্যাসিস্ট শাসন বজায় রাখতে পেরেছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হা “র” (RAW) এর বুদ্ধিপরামর্শেই কিছুদিন পরপর দানবে রূপান্তরিত র‍্যাব এবং পুলিশ জঙ্গী নাটক মঞ্চস্হ করেছে এবং প্রধানত: গ্রামের দরিদ্র, অসহায় মানুষদের ধরে এনে নারী-শিশুসহ বোমা মেরে উড়িয়ে হত্যা করেছে। দশ মাসেরও অধিক সময় ধরে চলমান গাজার গণহত্যা থেকে সারা বিশ্বের মানুষ দেখছে যে, পশ্চিমা শাসকদের কাছে মুসলমানের জীবনের কোন মূল্য নাই। ষোল হাজারের উপর শিশু হত্যাতেও তাদের বিবেক বিন্দুমাত্র জাগ্রত হয় না।

তাই ভুয়া ইসলামী জঙ্গী দমনের অজুহাতে বাংলাদেশে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যা করেও নরপিশাচ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত তাবৎ পশ্চিমা সরকারসমূহের বাহবা কুড়াতে পেরেছিল। শাপলা চত্বরে আলেমদের উপর হাসিনার পদলেহি খুনী বেনজির, আজিজ, জিয়ারা গণহত্যা চালিয়েছে। একাত্তরের পাকিস্তানী গণহত্যার বিচারের নামে জামাত এবং বিএনপির ইসলামপন্থী নেতাদের “বিচারিক হত্যাকান্ডের” শিকার হতে হয়েছে। হাসিনার এই সব ঘৃন্য কর্মকান্ডে দিল্লি তো মহা আনন্দিত হয়েছেই, পশ্চিমা বিশ্বও অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে রেখে মুসলমান নিধনে উৎসাহ জুগিয়েছে। কথিত ইসলামী জঙ্গী এবং ইসলামপন্থিদের নির্মমভাবে দমনের পুরস্কারস্বরূপ ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে ক্রমেই একবিংশ শতকের সবচেয়ে অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠতে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মুসলমান বিশ্বে ঐতিহাসিকভাবে হাসিনার মত ভয়ংকর স্বৈরশাসকদেরই আশকারা দিয়েছে। এই কারণেই মুসলমান বিশ্বের ৫৭টি দেশের মধ্যে আধা ডজন গণতান্ত্রিক সরকারও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বিকশিত গণতন্ত্রকেও ২০০৭ সালে এক এগারোর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিনাশ করা হয়েছিল।

আবু সাইদ, মুগ্ধ এবং হাজারো শহীদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। মহান বিপ্লবীর উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ কিউবা বিপ্লবের নায়ক চে গুয়েভারাকে চেনে। অনেক তরুণ তার ছবি অঙ্কিত টি শার্ট গায়ে দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। আমরাও তরুন বয়সে চে গুয়েভারার জীবনী পড়েছি। কিন্তু, এখন থেকে আমাদের কাছে পুলিশের উদ্যত রাইফেলের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শহীদ আবু সাইদই সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। বাংলাদেশের তরুনরা আমাদের আবারও এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, যেখানে মানবাধিকার রক্ষিত হবে, কোন নাগরিককে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের শিকার হতে হবে না। কিন্তু, সেই গণআকাঙ্খার বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে আমাদের গত ষোল বছরে জঙ্গীবাদ দমনের নামে যত বিচারবহির্ভুত হত্যা এবং গুম হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত এবং সীমাহীন বর্বরতার হলি আর্টিজানের কথা বলা যেতে পারে। ইসলামী জঙ্গীবাদের নামে ২০১৬ সালে গুলশানের অত্যন্ত ব্যয়বহুল রেস্তোরায় যে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল তার প্রকৃত সত্য আমরা কি জানতে পেরেছি? অনেকে হয়তো বলবেন আদালতে বিচার তো হয়েছে। হাসিনার আমলে সকল আদালতে বিচারের নামে যে কেবলই নিষ্ঠুর অবিচার হয়েছে সেটা কি আমাদের অজানা? হলি আর্টিজানের ঘটনার আমরা তো এ যাবৎ কেবল চরম অত্যাচারী এবং সর্বৈব মিথ্যাবাদী এক ফ্যাসিস্ট সরকারের একতরফা বয়ান শুনেছি। আমি এই প্রসঙ্গে এখানে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছি:

১। কথিত ইসলামী জঙ্গীদের একজনকেও জীবিত রাখা হয় নাই কেন যার কাছ থেকে আমরা সেই রাত্রের ঘটনার ভিন্ন এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে পেতাম?

২। প্রকৃত ঘটনার তদন্তের জন্য কেন জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক অন্য কোন সংস্থার সাহায্য নেওয়া হয় নাই?

৩। সে রাতে রেস্তোরায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ আজ পর্যন্ত কোন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ জনসমক্ষে কেন তুলে ধরেন নাই?

৪। ভারতে হলি আর্টিজান নিয়ে হিন্দি ভাষায় যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেখানে প্রধানত: প্রথম আলো গ্রুপের মালিকপক্ষের সন্তানকে নায়ক সাজানোর বয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। সে রাতের নৃশংসতার অন্য আর এক তরুন ভিক্টিমের মা প্রথম আলোর সেই একতরফা বয়ানকে বানোয়াট দাবী করেছেন। তিনি ভারতে এবং বাংলাদেশে সেই বয়ানের বিরুদ্ধে সাধ্যমত লড়াই করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ অবগত আছেন যে, এ দেশে ইসলামবিদ্বেষী এবং হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতি ও বয়ান প্রসারে প্রথম আলো, ডেইলী স্টার গ্রুপ সর্বদাই গৃহশত্রু বিভীষণের ভুমিকা পালন করেছে। এই জাতীয় মিডিয়ার কর্মকান্ডের ফলেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় হেজেমনি শিকড় গাড়তে পেরেছিল। এই পত্রিকা সব সময় চোখ বুজে শেখ হাসিনার বানোয়াট ইসলামী জঙ্গী বয়ানকে সমর্থন দিয়েছে। ইসলামবিদ্বেষের মাপকাঠিতে শেখ হাসিনা, ভারতের মোদি সরকার এবং প্রথম আলো গ্রুপের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রথম আলো শাপলা চত্বরে মাদ্রাসার দরিদ্র ছাত্র এবং আলেমদের উপর নির্মম গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেই গণহত্যাকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এবং বর্তমান উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সকল নিপীড়নকেও ডেইলী স্টার এবং প্রথম আলো সমর্থন করেছে, বৈধতা দিয়েছে। সুতরাং, ইসলাম এবং মুসলমানের যে কোন বিষয়ে প্রথম আলোর বয়ান আমাদের বিনা বাক্যে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।

নৃশংসতার বিবেচনায় হলি আর্টিজান সবচেয়ে বীভৎস হলেও বিভিন্ন সময়ে আরও অনেক জঙ্গীর গল্প ফাঁদা হয়েছে। যখনই সরকার কোন বিপদে পড়েছে তখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য নতুন নতুন জঙ্গী আবিষ্কার করেছে শেখ হাসিনার দানব পুলিশ। সবগুলো ঘটনা এখন মনেও করতে পারছি না। স্মৃতি থেকে কয়েকটির উল্লেখ করছি মাত্র।

২০১৬ সালের ২৬ জুলাই খোদ ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গী বানিয়ে “জাহাজবাড়িতে” ৯ জন নিরাপরাধকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময় আমি কারাগারে ছিলাম। সেখানেই আমাকে এক সোর্স জানিয়েছিল যে, হতভাগ্যদের সবাইকে ডিবি থেকে এনে হাসিনার নির্দেশে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়েছিল।

২০১৭ সালের ২০ মার্চ চট্টগ্রামে জঙ্গী আস্তানা নামে দুই বাড়ীতে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। একই বছর ৩১ আগস্ট যশোরে একই রকম নাটক সাজিয়েছিল। ৯ জুন ২০২৪ নেত্রকোণায় কথিত জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। ২০২৪ এর ২ জুলাই নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ জঙ্গী নাটক মঞ্চস্থ হয়। বর্তমান বছরের নাটকদুটি করা হয়েছিল ৭ জানুয়ারীর “ডামি নির্বাচন” থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য। অবশ্য এতে কোন কাজ হয় নাই কারণ অতি ব্যবহারে জীর্ণ স্ক্রীপ্ট আর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।

বিগত ষোল বছরে অন্তত: শ’খানেক এমন নাটক করা হয়েছে যাতে বহু নিরাপরাধ, দরিদ্র মানুষকে হত্যা করেছে স্যাডিস্ট আওয়ামী সরকার। এখন সময় হয়েছে সব হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে শেখ হাসিনাসহ সকল অপরাধীদের সাজা দেয়ার। ড: ইউনুস এবং তার উপদেষ্টা পরিষদের কাছে সকল জঙ্গী নাটকের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করবার জন্য জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবী জানাচ্ছি। বর্তমান সরকারে আদিলুর রহমান খানের মত মানবাধিকার কর্মী থাকায় আমরা আশা করছি যে, কোনরকম কালক্ষেপন ব্যতিরেকে এই বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ