ম্যাগডেলিনা ব্রাহা
একটা যুদ্ধ চলছে, যেখানে ছয় লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই যুদ্ধের ভুক্তভোগী যারা, তাদের হৃদয়বিদারক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনা হচ্ছে, এই যুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই বিভীষিকা দুই বছর স্থায়ী হয়েছে; আর আজও তা চলছে। রূঢ় সত্য হচ্ছে, এই ভয়াবহ প্রাণঘাতী যুদ্ধ কোথায় চলছে, সে খবর বিশ্ব এখন পর্যন্ত জানে না। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে বহুগুণ বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তারপরও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম অনেকটাই এটিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।
২০২০ সালের ৪ নভেম্বর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ দেশটির বিরোধপূর্ণ এলাকা টিগ্রেতে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন। কতটা বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, কেউ ধারণাও করতে পারেনি সে সময়। ৬০ লাখের বেশি জনসংখ্যার পুরো অঞ্চল সরকারের তরফে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পুরো জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। তীব্র পুষ্টিহীনতায় অসংখ্য শিশু মারা যাচ্ছে। ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে টিগ্রে।
ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে টিগ্রের অধিবাসীদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমাদের মতো অনেককেই তাদের প্রিয়জনের খবরাখবর জানার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর আগে টিগ্রেতে ৪৭টি হাসপাতাল, ২২৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও রোগী পরিবহনে ২৬৯টি অ্যাম্বুলেন্স ছিল। বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার সেনারা সেটা করেছে। অ্যাম্বুলেন্স সেবার অস্তিত্ব আর সেখানে নেই।
এসব পরিসংখ্যান আর মানবীয় ভোগান্তির চিত্র বলছে, সারা বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্র হওয়া উচিত টিগ্রে। কিন্তু বিভীষিকা শুরুর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের অনুভূতি হলো কেউই সেই মনোযোগ দিচ্ছে না। সবচেয়ে বিয়োগান্ত বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যম টিগ্রের মানবিক বিপর্যয়ে সাড়া না দেওয়ার পেছনে তাদের জনবল ও সম্পদবলের সংকট দায়ী নয়। এ বছরেই আমরা দেখেছি সংঘাত ও মানবীয় অবচয়ের ঘটনায় (ইউক্রেন যুদ্ধ) বিশ্ব কীভাবে যত্নের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এ বছরের ২ নভেম্বর যুধ্যমান দুই পক্ষের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হলে টিগ্রের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল এবং নীরব উদ্যাপনে শামিল হয়েছিল। অনেকে আশা করেছিল, এ চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু এক সপ্তাহ না পেরোতেই জানা গেল, ইরিত্রিয়ার সেনারা টিগ্রের শহরগুলোয় লুটতরাজ চালাচ্ছে এবং বেসামরিক বাসিন্দাদের ঘরবাড়িছাড়া করছে। তাদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করছে।
আমার পরিবারের লোকজন টিগ্রেতে থাকে, যুদ্ধ শুরুর পর আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে আমি আমার খালার একটি সংক্ষিপ্ত কণ্ঠবার্তা পেয়েছিলাম। তিনি বলছিলেন, টাকাপয়সা ও ওষুধপথ্য ফুরিয়ে গেছে, বাজারে কিছুই আর মিলছে না। এগুলো খুব জরুরি দরকার। এরপর আর তাঁর কোনো খোঁজখবর পাইনি। টিগ্রের কিছু এলাকায় সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট সংযোগ আবার চালু হয়েছে। টিগ্রের যেসব লোক বিদেশে থাকেন, তাঁরা এখন একের পর এক শোক সংবাদ শুনতে পাচ্ছেন। অভিবাসী টিগ্রেরিয়ানরা এখন এই বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে ফেলেছে যে যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হওয়ার পর আরও অনেক শোক, দুঃসহ ভোগান্তির খবর তাঁদের শুনতে হবে।
এ বছরের ২ নভেম্বর যুধ্যমান দুই পক্ষের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হলে টিগ্রের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল এবং নীরব উদ্যাপনে শামিল হয়েছিল। অনেকে আশা করেছিল, এ চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু এক সপ্তাহ না পেরোতেই জানা গেল, ইরিত্রিয়ার সেনারা টিগ্রের শহরগুলোয় লুটতরাজ চালাচ্ছে এবং বেসামরিক বাসিন্দাদের ঘরবাড়িছাড়া করছে। তাদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করছে। এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যখন অব্যাহত থাকে, তখন কী করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো কার্যকর তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যাবে।
এ যুদ্ধ (বেশির ভাগই অন্ধকারে সংঘটিত) পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেটা হলো সংঘাত ও মানবিক সংকটের সংবাদ সংবাদমাধ্যমে কীভাবে প্রকাশিত হবে? এ যুদ্ধ আমাদের একটা অন্ধকার বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর তা হলো সব মানবিক সংকট (মানবীয় অপচয় যতই হোক না কেন) সমান নয়।
টিগ্রের এ বিপর্যয় বিশ্ব বেমালুম ভুলে বসে আছে। আমি এই লেখা যখন লিখছি, তখন টিগ্রের বেশির ভাগ অঞ্চল যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বেসামরিক নাগরিকদের হাতে আর টাকা নেই, তারা না খেয়ে আছে, স্বাস্থ্যসংকট তীব্র। আর সংবাদমাধ্যম ও সেনাবাহিনী তাদের সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে চলেছে।
প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের কারণে যখন লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে চোখ বন্ধ করে আছে? এর অর্থ কি সেখানে যেটা ঘটছে, সেটা ঘটতে দেওয়া হবে? যখন সবাই টিগ্রের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বলতে শুরু করবে, তখন কেবল আমাদের বিশ্বজনীন বোধ জাগ্রত হবে এবং আমরা সবাই জানতে পারব টিগ্রের এই রক্তস্নানের পেছনে কারণ আসলে কী। তখন নিশ্চয়ই সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
● ম্যাগডেলিনা ব্রাহা ইথিওপিয়ান বংশোদ্ভূত লেখক