২০২২-০৮-১৯
১. পাখিদের সভা নামে ফরিদউদ্দীন আত্তারের একটা সুফি কাহিনী আছে, যেখানে আয়নাঘর হলো একটা বাস্তব অতিক্রমী একাকার দশার রূপক। পাখিরা দলবেঁধে যাত্রা করে পাখীদের রাজা সীমোর্গের সাথে দেখা করার আশায়, রূপকার্থে এটা পরমের সন্ধানে যাত্রা। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩০টি পাখি একে একে অন্বেষণ, প্রেম, প্রজ্ঞা, বিসর্জন, ঐক্য, বিস্ময় প্রভৃতি নতুন নতুন ধাপ পেরিয়ে পরবর্তী স্তরে উন্নীত হতে হতে শেষে বিলয়ের স্তরে উপনীত হয়ে তাদের মার্গীয় পরিভ্রমণ সম্পন্ন করে। বিলয়ের এই পরমমার্গে তারা অবশেষে এক আয়নাঘরে প্রবেশ করে এবং পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখতে পায় সেই আয়নায় তার নিজের ছবিই প্রতিফলিত হচ্ছে। এই পাখিরা তখন উপলদ্ধি করে যে তারা নিজেরা প্রত্যেকেই সেই কাঙ্খিত পক্ষীরাজ বা সিমোর্গ। যে সব পাখি সেই পরম মার্গে পৌঁছাতে পারেনি; লোভ, অহঙ্কার, আত্মম্ভরিতা, এমন কী যুক্তিবোধ ইত্যাদি জাগতিক বাস্তব সীমাবদ্ধতা তাদের এক একজনকে বাস্তবতার এক একটা পর্বে থামিয়ে দিয়েছিল। আধ্যাত্মিক বাস্তবতার সেই ‘আয়নাঘর’ এ তারা তাই কখনো পৌঁছাতে পারেনি। তাদের তাই কখনো জানা হয়নি তারা নিজেরাও সেই মহান পক্ষীরাজের প্রতিভূ।
হালের ঢাকাই ‘আয়নাঘর’ এর বিস্তারিত কিছুই এখনও আমরা জানতে পারিনি। সেখান থেকে ফেরা দু’জনের সাক্ষ্য থেকে শুধু আন্দাজ করতে পারছি, রাষ্ট্রগত অবনমনের এক একটা স্তর পেরিয়ে আমরা আর এক আয়নাঘরের অতিবাস্তবতায় এসেছি, যা আছে আমাদের আশেপাশে একদম “বাড়ির পাশের আরশীনগরের” মতোই, যদিও তাকে ছুঁতে কিংবা বুঝতে, এমন কী স্বীকার করতেও আমরা সর্বদাই আতঙ্কিত। অল্প কটি কামরা বিশিষ্ট এই আয়নাঘরই আসলে বাকি বিশাল বাংলাদেশটাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে, তার গতিবিধিকে নির্ধারণ করে। ওই অর্থেই বলা, এই আয়নাঘরই হয়তো সত্য, আমাদের চারদিকের হাসি-গান-অভিমান এই সব মায়া বা কুহক মাত্র।
নতুন এই আয়নাঘরটি তৈরি হওয়াটা সম্ভব হতে দিতে রাষ্ট্রগত অবনমনের কোন্ কোন্ স্তর আমাদের পার হতে হয়েছে, যেগুলো পাড়ি দিয়ে আমরা এমন অতিবাস্তবতার জগতে চলে আসলাম? হয়তো সেগুলো এমন: এক এক করে দেশ থেকে আইন অদৃশ্য হয়ে গেছে, যুক্তিবোধ খসে গেছে, লোভের বাধাহীন রাজত্ব শুরু হয়েছে, সমাজ শক্তিহীন হয়ে গেছে, বিরোধিতাকে পিষে দেয়া হয়েছে, স্বাধীন সংস্থাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এই সব প্রস্তুতি শেষে একটাপর্যায়ে আবির্ভূত হয়েছে নৃশংস ক্ষমতার অতিবাস্তব আয়নাঘর। কৃষ্ণবিবরের মতোই যেন সে সব কিছুকে গ্রাস করে নেয় এবং কোনো আলো, কোনো সত্য, কোনো তথ্য সেই জায়গা থেকে ছিটকে আসতে পারে না। সেখানে সব কৃত্রিম যান্ত্রিক পাখার শব্দগুলো অল্প সময়ের জন্য থামলে কেবল কান্নার শব্দই ভেসে আসে।
২. ‘নেত্রনিউজ’ এ আয়নাঘর নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথমটি দেখতে দেখতে যা মনে আসছিল, সেখান থেকে প্রথম কথাটাই আবার বলি। আমাদের গণমাধ্যম নিরব। প্রথম আলোর অনলাইনে যেমন কয়েকটা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির উল্লেখ করে তার সূত্রেই কেবল আয়নাঘর বিষয়ে যথাযথ তদন্তের দাবি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আয়নাঘর বিষয়ে গণমাধ্যমের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান, কোনো সক্রিয়তা, কোন সম্পাদকীয়, কোনো উদ্যোগ এখনো আমাদের চোখে পড়েনি। গণমাধ্যমের এই নিরবতা, কিংবা গণমাধ্যমকে নিরব করার এই ক্ষমতা যেন যেন ‘আয়নাঘর’ এর অদৃশ্য কিন্তু অতিবাস্তব উপস্থিতিরই পরিপূরক একটি অতিবাস্তবতা।
আমরা তাদের নাড়ানোর সাহস পাইনি। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি। সেটা করতে পারি তখনই, যখন ঘটনার মূল হোতাকে সামনে না আনা হয়, কিংবা আসল অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকে কিংবা আমাদের প্রতিবেদন তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়
গণমাধ্যমকে সত্যি আমি দোষ দেই না। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কাজটা করতে কেন পারছে না, তার ব্যাখ্যা আলজাজিরার “অল দা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” শীর্ষক প্রতিবেদনের সময়ে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম দিয়েছিলেন, গত বছরই। তাকে উদ্ধৃত করাই একভাবে যথেষ্ট হবে। আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনটির সীমাবদ্ধতা নিয়ে নানান সমালোচনাকারীদের প্রতি মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন:
“আমরা যদি আরও ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারতাম, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতাম এই প্রতিবেদনের দুর্বল দিকগুলো। আমরা কি সেটা করতে পারি? আমরা কি জনগণের কাছে নীতি নির্ধারকদের জবাবদিহি করাতে পারি? আমরা কি এটা প্রকাশ করতে পারি যে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে কেন এত দেরি হয়? সেগুলোর খরচ কেন প্রাক্কলিক বাজেটের চেয়ে তিন-চার গুণ বেড়ে যায়? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে? এমনকী ‘পানামা পেপারস’এ যখন আমাদের দেশের কিছু মানুষের নাম প্রকাশ পেল তখনও কি আমরা বিষয়টি অনুসন্ধান করেছি? বছরের পর বছর যাদের কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের কি আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে, কেন ঋণখেলাপিদের টাকা পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সুদ মওকুফ হচ্ছে? টরেন্টোর ‘বেগম পাড়া’য় যাদের বাড়ি আছে বা মালয়েশিয়ায় অবৈধ ‘সেকেন্ড হোম’ যারা করেছেন, তাদের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? না, তাদের কারও বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করিনি। কারণ, তারা সবাই আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। আমরা তাদের নাড়ানোর সাহস পাইনি। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি। সেটা করতে পারি তখনই, যখন ঘটনার মূল হোতাকে সামনে না আনা হয়, কিংবা আসল অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকে কিংবা আমাদের প্রতিবেদন তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়।“
[আল জাজিরার প্রতিবেদন, সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের সাংবাদিকতা; মাহফুজ আনাম; শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১]
“অল দা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” নিয়ে তাও আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা হয়েছিল, আয়নাঘর নিয়ে প্রায় শুনশান নিরবতা। দুটো সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। এক হচ্ছে আল-জাজিরার প্রতিবেদনটার সমালোচকরা নিজের ঘরেও এত উপহাসের শিকার হযেছিলেন যে এবার আর নিজেকে হাস্যস্পদ বানাতে চাইছেন না। দুই, এই প্রতিবেদন এমনই এক সংস্থাকে নিয়ে, যা প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সমালোচনার চাইতেও অনেক, অনেক বেশি নিষিদ্ধ। মাহফুজ আনামের ওই লেখায় তো বলেই দেওয়া ছিল, “আমরা তাদের নাড়ানোর সাহস পাইনি। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি। সেটা করতে পারি তখনই, যখন ঘটনার মূল হোতাকে সামনে না আনা হয়, কিংবা আসল অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকে কিংবা আমাদের প্রতিবেদন তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়।“
আমি মাহফুজ আনামের এই লেখাটিকে কেবল সাফাই বা অজুহাত হিসেবে নেইনি। বরং বলা যায় যে বাস্তবতার কথা তিনি এভাবে অকপটে লিখেছেন, তা পরিস্থিতির সরল ও অকপট স্বীকৃতি। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ ওই লক্ষণরেখা ডিঙানো, যার ওপাড়ে গেলে অনেকগুলো বিপর্যয় ঘটতে পারে, তার মাঝে গৌণ একটি হলো আয়নাঘরের দর্শন ঘটে যাবার সম্ভাবনা।
নানান স্বার্থে তাদেরকে বিভক্ত করে রাখা সম্ভব হয়েছে বলেই সেই পাড়াতো পর্যায়ের ইউএনওদের হাতে হেনস্তা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে নানান আতঙ্ক গণমাধ্যমর্কীদেরও তাড়া করে ফেরে। গণমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যক্তির প্রধান কাজ এখন ক্ষমতাকাঠামোর কাছে গণমাধ্যমকমীদের বশ্যতা ও অধস্তনতা নিশ্চিত করা। মোটামুটি নির্লজ্জভাবেই তারা কাজটা করে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক সংবাদ ও ভাষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে শূন্যবিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে চলে গেছে, গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতার যে প্রায় বিলোপ ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এই তথাকথিত সাংবাদিক নেতারাই। স্বাধীন গণমাধ্যম জনগণের ক্ষমতার একটা বহিঃপ্রকাশ। এই শূন্যস্থানই পূরণ করেছে আয়নাঘর। ফলে এই দূর্বলতা গণমাধ্যমের নিজেরই
৩. আয়নাঘরের দর্শন ঘটে যাবার সম্ভাবনার উল্লেখ করে কি আমিও আতঙ্ক ছড়ালাম? আসলে বিষয়টা ভিন্ন। বরং খেয়াল করুন, আয়নাঘরের দর্শন ঘটে যাওয়াকে গৌণ কারণ বলছি, মুখ্য কারণগুলো আসলে এই দেশে কম আলোচিত। আলাদা আলাদা করে বিচ্ছিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের নানান স্থানে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন একটা মাত্র কারণে, সেটা হলো গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো পেশাগত ঐক্য দেশে আপাতত নাই। নানান স্বার্থে তাদেরকে বিভক্ত করে রাখা সম্ভব হয়েছে বলেই সেই পাড়াতো পর্যায়ের ইউএনওদের হাতে হেনস্তা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে নানান আতঙ্ক গণমাধ্যমর্কীদেরও তাড়া করে ফেরে। গণমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যক্তির প্রধান কাজ এখন ক্ষমতা কাঠামোর সামনে নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বশ্যতা ও অধস্তনতা নিশ্চিত করা। মোটামুটি নির্লজ্জভাবেই তারা কাজটা করে যাচ্ছেন। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন লোকজন গণমাধ্যমে টিকতে পারছেন না। রাজনৈতিক সংবাদ ও ভাষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে শূন্য-বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে চলে গেছে, গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতার যে প্রায় বিলোপ ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এই তথাকথিত সাংবাদিক নেতারাই। স্বাধীন গণমাধ্যম জনগণের ক্ষমতার একটা বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাহীনত জনতার এই শূন্যস্থানই পূরণ করেছে আয়নাঘর। ফলে এই দুর্বলতা গণমাধ্যমের নিজেরই, এবং অনেকটা রাজনীতিরও।
বরং মাহফুজ আনামের ওই স্বীকারোক্তিটিকে ইতিবাচক ভাবে দেখেই সেটার একটা পর্যালোচনা কিংবা সমালোচনা সেটা হাজির করা যায়। যে বাস্তবতার স্বীকৃতি গত বছরের ওই লেখায় মাহফুজ আনাম দিয়েছেন, সেটার শেষভাগে তিনি একটা আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছেন: “আল জাজিরার প্রতিবেদনটি আমাদের গণমাধ্যমের মাঝে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভাবার বোধ তৈরি করুক, আমাদের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করুক, আমাদেরকে আমাদের ভুলগুলো মোকাবিলা করতে বাধ্য করুক এবং আমাদের এই মহৎ পেশার মূল্যবোধগুলো সঙ্গে নিয়ে সংশোধনের পথে যাত্রা শুরু করার ক্ষেত্রে আলোর দিশারি হোক।” কিন্তু এই “হোক” সমূহ কীভাবে হয়ে উঠবে বা উঠতে পারে, তার কোনো দিকনির্দেশনা সেখানে নাই।
ওই লেখাতেই মাহফুজ আনাম আরও উল্লেখ করেছেন যে “একটি সংস্থার পছন্দ নয়” এমন শব্দ ব্যবহার করে দ্য ডেইলি স্টারকে “ভুগতে হয়েছে এবং ভুগতে হচ্ছে”। এই ভুগতে থাকাটা কিন্তু আয়নাঘরের হাজির করবার ভীতি প্রদর্শন না। বরং আয়নাঘর যারা চালান, তাদের হাতে দেশের আরও বহু কিছুকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে বলেই ভোগান্তিটা ঘটানো যায়। তারা স্রেফ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের উৎসটা বন্ধ করে দেন, সেই একটি অপছন্দের শব্দ ব্যবহার করে সংস্থাটির শিকার হয়েছিল দ্য ডেইলি স্টার।
আসলে সারাদেশে অত আয়নাঘর নাই যা দিয়ে অজস্র গণমাধ্যমকর্মীকে গুম করা সম্ভব। কিন্তু যা আছে সেটা হলো অর্থের স্রোতের ওপর নিয়ন্ত্রণ, যা দিয়ে সম্পাদক ও প্রকাশকদের দুঃশ্চিন্তায় ফেলা যায় তাদের প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব নিয়ে। অর্থপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণই যে আসল ভোগান্তি, তার স্বীকৃতি মাহফুজ আনামের ওই লেখায় নেই।
বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতার কারণেই আসল ভোগান্তিটা হয়, এটা না বলার একটা তাৎপর্য আছে। সেটা হলো এই যে আতঙ্কের মাঝে বাধ্য হয়ে লিখছি না, এটা একটা ব্যাখ্যা হিসেবে নিজের জন্য পুরোপুরি তৃপ্তির না হলেও, জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে বলে লিখতে পারছি না, এটা তো সেই তুলনাতেও রীতিমত আত্মঅবমাননা। হালের লেখক-সাহিত্যিক-উপন্যাসিক-কবি অনেকেই নিজেদের পেশা নিয়ে এই গুম-খুন-কারাবাস-তুলে নিয়ে যাবার আতঙ্ক ছড়াতে পছন্দ করেন: ভাই রে অমুক অমুক কারণে লিখতে পারি না! সেটা তাদের মহত্ব খানিকটা যদি কমায়ও, জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কার স্বীকৃতি তো নিজেদেরকে নিজেদের কাছে মিসকিনের পর্যায়ে নামিয়ে নেয়।
নিরাপত্তার আতঙ্কটা যদিও অমূলক নয় একদমই, ডেইলি স্টারের সাংবাদিক তাসনিম খলিলই শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আতঙ্কটা আসলে কল্পিত। বুদ্ধিবৃত্তিক নানান পেশার সাথে যুক্ত এবং মোটামুটি পরিচিত, এমন ব্যক্তিরা তাদের লেখা বা বলার জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো হাতে গোনা যাবে। এই নির্যাতনও সম্ভব হয়েছে বাকিরা নানান আতঙ্ক ও স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নির্যাতনের বিরোধিতা করেননি বলেই। এই আতঙ্কের সংস্কৃতিটাই আসলে আয়নাঘর তৈরি করতে চায়। তার উপস্থিতি যে ভীতির আবহ তৈরি করে, তার চৌম্বক প্রভাবটা তার গ্রাস করবার ক্ষমতার চাইতে বহুগুন বেশি
নিরাপত্তার আতঙ্কটা যদিও অমূলক নয় একদমই, ডেইলি স্টারের সাবেক সাংবাদিক তাসনীম খলীলই শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আতঙ্কটা আসলে কল্পিত। বুদ্ধিবৃত্তিক নানান পেশার সাথে যুক্ত এবং মোটামুটি পরিচিত, এমন ব্যক্তিরা তাদের লেখা বা বলার জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো হাতে গোণা যাবে। এই নির্যাতনও সম্ভব হয়েছে বাকিরা নানান আতঙ্ক ও স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নির্যাতনের বিরোধিতা করেননি বলেই। এই আতঙ্কের সংস্কৃতিটাই আসলে আয়নাঘর ছড়িয়ে দিতে চায়। আয়নাঘরের উপস্থিতিটিটাই যে ভীতির আবহ তৈরি করে, সেটার চৌম্বক প্রভাব আয়নাঘরের গ্রাস করবার ক্ষমতার চাইতে বহুগুন বেশি।
তাছাড়া, গণমাধ্যমের জন্য খারাপ বাস্তবতা আছে, এটা যেমন সত্যি, বাস্তবতা বদলায়, সেটাও তো সত্যি। দার্শনিকরা যাকে বলেন “হয়ে ওঠা”র প্রক্রিয়া। আমাদের চারপাশে গণমাধ্যমের জগতে তেমন একটা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া আসলে নানান ভাঙন-গড়নের মধ্য দিয়ে চলমান। তরুণ গণমাধ্যম কর্মীরা যারা গণমাধ্যমের দিন বদল করতে চান, তাদেরকে তাই এই কর্পোরেট সাংবাদিকতার বাস্তবতাকেও নিজেদের বিবেচনায় নিতে হবে।
যেমন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আয়নাঘরই ছিল অন্যতম আলোচ্যবিষয়। দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট ছাপিয়েও ‘নেত্রনিউজ’ এ এক একটা প্রতিবেদন অজস্রবার দেখা হয়েছে, অজস্র মন্তব্য আছে সেখানে। এটা একটা বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়, যা থেকে বোঝা যায় অন্তত রাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশে মূলধারার গণমাধ্যম ক্রমাগত জনগণের নজর হারাতে থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালীভাবেই দৃশ্যমান হতে থাকবে করপোরেট নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছোট ছোট গণমাধ্যম। এর ফলে পুরনো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম রাতারাতি নাই হয়ে যাবে না। বরং ‘নেত্রনিউজ’ এর মতো সংস্থাগুলো তাদের চাপে ও তাপে যে স্বাধীনতার পরিসরটুকু তৈরি করবে, তারই সুবিধা নিয়ে বড় বড় গণমাধ্যমগুলোও হয়তো ভবিষ্যতে “নিষিদ্ধ” বস্তু নিয়ে কথা বলবার সাহস সঞ্চার করতে পারবে
যেমন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই সময়টাতে আয়নাঘরই ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়। দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট ছাপিয়েও ‘নেত্রনিউজ’ এর প্রতিবেদনটা অজস্রবার দেখা হয়েছে, অজস্র মন্তব্য আছে সেখানে। এটা একটা বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়, যা থেকে বোঝা যায় অন্তত রাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশে মূলধারার গণমাধ্যম ক্রমাগত জনগণের নজর হারাতে থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালীভাবেই দৃশ্যমান হতে থাকবে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছোট ছোট গণমাধ্যম। এর ফলে পুরনো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম রাতারাতি নাই হয়ে যাবে না। বরং ‘নেত্রনিউজ’ এর মতো সংস্থাগুলো তাদের চাপে ও তাপে যে স্বাধীনতার পরিসরটুকু তৈরি করবে, তারই সুবিধা নিয়ে বড় বড় গণমাধ্যমগুলোও হয়তো ভবিষ্যতে “নিষিদ্ধ” বস্তু নিয়ে কথা বলবার সাহস সঞ্চার করতে পারবে। সামগ্রিক স্বাধীনতার জন্য গণমাধ্যমকে সামষ্টিকভাবে শক্তি অর্জন করতে হবে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য, না হলে অচিরেই বিনোদন সাংবাদিকরাই প্রতিষ্ঠিত দৈনিকগুলোর চালকের আসনগুলোতে বসে পড়বেন।
৪. ‘আয়নাঘর’ এর যে বন্দিদের আমরা দেখলাম, তাদের মাঝে মালয়েশিয়া প্রবাসী মানুষটিকে নিতান্তই ভুল করে ধরে আনা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন সেই বন্দি। অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়া, দীর্ঘদিন গুম হয়ে থাকা, পরিজনের উদ্বেগ, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষয়ক্ষতির পর তিনি মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এ থেকে তাকে আটক করা ব্যক্তিদের যে পেশাগত দক্ষতার পরিচয় মেলে, তাও তো উদ্বেগজনক! শুধু মানবাধিকার না, রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপচয় বিবেচনাতেও তো কাদের হাতে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে, এই নিয়ে অনুসন্ধান হওয়াটা দরকার, অভিযোগ যেহেতু উঠেছে।
দ্বিতীয় বন্দি একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও নতুন একটি সাক্ষাতকারে দাবি করলেন তুচ্ছ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাকে গুম করা হয়েছিল। তাদের নির্দোষিতার দাবি সত্য অসত্য যাই হোক, কেন তাদের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ বা সন্দেহুলোর তদন্ত সাধারণ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করতে পারবে না, কেন সেটা এই্ রকম গোপন ও জবাবদিহতাহীন খুনখারাবি ও গুম করার অধিকার সম্পন্ন সংস্থা দিয়ে করতে হবে, বা আদৌ এমন কিছু হয় কি না, জাতীয় ভিত্তিক পর্ষদ গঠন করে সেই তদন্ত ও পর্যালোচনার দাবি তোলাটা তাই অত্যন্ত জরুরি একটা কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে
দ্বিতীয় বন্দি একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও অন্য একটি নতুন সাক্ষাতকারে দাবি করলেন তুচ্ছ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাকে গুম করা হয়েছিল। এই দুই ব্যক্তির নির্দোষিতার দাবি সত্য অসত্য যাই হোক, কেন তাদের বিরুদ্ধে আনা কথিত অভিযোগ বা সন্দেহগুলোর তদন্ত সাধারণ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন করতে পারবে না, কেন সেটা এই রকম গোপন ও জবাবদিহতাহীন খুনখারাবি ও গুম করার অধিকার সম্পন্ন সংস্থা দিয়েই করতে হবে, বা আদৌ এমন কিছু ঘটে কি না, সেটা জানতে জাতীয় ভিত্তিক পর্ষদ গঠন করে সেই তদন্ত ও পর্যালোচনার দাবি তোলাটা তাই অত্যন্ত জরুরি একটা কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।
আয়নাঘরে আটক থাকার দাবি করা সেনা কর্মকর্তা হাছিনুর রহমানের অন্য একটা সাক্ষাৎকার খুঁজে পেলাম ফেসবুকে। লন্ডন অনলাইন টিভি নামের একটা অনলাইনভিত্তিক চ্যানেলে সাক্ষাতে তিনি নিজে র্যাবে কর্মরত অবস্থায় যে সকল কাজের বিবরণ দিয়েছেন, সেগুলোও যথেষ্টই রোমহর্ষক। কোন প্রক্রিয়ায় আমরা আগে থেকেই দুর্বল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একে একে নির্মূল করলাম, আইনহীনতাকে কায়েম করলাম, তার গুরুত্বপূর্ণ নমুনা আছে সেই সাক্ষাৎকার। র্যাবের কর্মকর্তা থাকার সময়ে অনেকগুলো ক্রসফায়ারের অনুশোচনাহীন বিবরণ তিনি দিয়েছেন সেখানে।
নারায়ণগঞ্জের ডেভিড কিংবা পিচ্চি হান্নান যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তাদেরকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার সেই ক্ষমতাই ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে আজকের এই দানবের রূপ নিয়েছে। বাংলাভাষার অলিখিত অভিধানে নতুন একটা শব্দই যুক্ত হয়েছে: “ক্রছে দেয়া/ শব্দার্থ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিনাবিচারে হত্যা করা/ বুৎ: ইং ক্রসফায়ার/ উদাহরণ: কথা না শুনলে তোরে ক্রছে দিয়া দিবো”। অপরাধীরা পুলিশের তদন্তের গাফিলতিতে আদালতে ছাড়া পেয়ে যায়, এই কারণে সেই গাফিলতির ফুটোটা দূর না করে আরেকটা আলাদা বাহিনী বানানোর অর্থ হলো তদন্তের ফাঁকফোকর ঠিক আগের মতোই থাকবে, যেটার সুবিধা ক্ষমতাবানরা পাবেন, কিন্তু যাকে খরচের খাতায় তোলা দরকার, তাকে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই খতম করে দেয়া যাবে।
কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশের মাঝে এইভাবে হত্যাকরাটা যে রীতিমত যৌক্তিকতা পেয়েছে, এটা ভয়াবহ একটা বাস্তবতা। অবশেষে তারা কেউ কেউ নিজেরাও এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন, এই ভেবে নাগরিকদের তৃপ্তি বোধ করার কোনো সুযোগ নেই। বরং গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর এই আইনহীনতার পর্বত যেভাবে চেপে বসেছে, তা নিয়ে আমাদের গভীর দুঃশ্চিন্তার দরকার আছে।
একজন সেনাকর্মকর্তা হিসেবে হাছিনুর যেমন তার ক্রসফায়ারের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করছেন, তেমনি বেশ গর্ব করেই জানাচ্ছেন যে, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর তাকে একজন চেয়ারম্যানকে হত্যার নির্দেশনা দিলেও তিনি নিজে খোঁজ খবর নিয়ে যখন জানতে পারলেন যে চেয়ারম্যান নির্দোষ, তার জীবন রক্ষা করলেন! একটা নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে, সেই স্বস্তির পাশাপাশি ভয়াবহ উদ্বেগের একটা বিষয় আমরা না লক্ষ্য করে পারি না।
কোন সভ্য নাগরিকদের রাষ্ট্রে জীবন রক্ষা করা, কিংবা দোষী নির্দোষীতার নির্ধারণ বা এইভাবে খুনের নির্দেশনার সুযোগ কোন সেনা কর্মকর্তার থাকার কথা? নিজের সততা বিষয়ে হাছিনুরের ভাষ্য যদি সত্যিও হয়ে থাকে, জবাবদিহিতাহীন একটা শক্তির হাতে এই খুনের বা গুমের অধিকারের পরিণতি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ হতে বাধ্য। এর প্রমাণ আমরা অজস্র পেয়েছি। কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটা কাকতালীয়ভাবে ধরা না পরে গেলে খতমের তালিকার বাইরে থাকা একজন নিরীহ প্রত্যক্ষদর্শীরও খুন হয়ে যাবার বাস্তবতা চিরকাল শীতলক্ষ্যা নদীর পলির নিচেই চাপা পরে থাকত। সাম্প্রতিককালে লেখক মুশতাক ও কার্টুনিস্ট কিশোরের গুম, নির্যাতনের শিকার হবার ঘটনাটির কথাও যেমন বলা যায় । একজন ব্যাংক লুটপাটকারীর ক্রোধের শিকার হয়ে এই পরিণতি বহন করতে হয়েছিল তাদের। পিতার ক্রসফায়ারের মূহুর্তটাতে একরামুলের শিশু কন্যার আর্তনাদ হাছিনুর হয়তো শোনেনই নি। আরেকটা শিশুর কান্না ভরা চোখের ছবি আমরা দেখেছিলাম, যেখানে সে জানিয়েছিল সে যখন মায়ের গর্ভে, তার পিতা ক্রসফায়ারে খরচ হয়ে গিয়েছিলেন।
হাছিনুর দাবি করেছেন গোলাম আজমের পুত্র বা মীর কাশেম আলীর পুত্রকেও আয়নাঘরে গুম করে রাখা হয়েছে। তদন্ত না করে এর সত্যতা জানা মুশকিল। কেন তাদের গুম করে রাখতে হবে, তা বোঝাটাও আসলেই কঠিন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন, তাকে যদি রাজনৈতিক উপায়ে মোকাবেলা না করা যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কোনো অপরাধের উদঘাটন করতে না পারে, তাতে একটা বাস্তবতাই বোঝা যায়, সেটা হলো তেমন সরকারের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নাই, আইনগত ভিত্তিও নাই। আছে শুধু ক্ষমতার মদমত্ততা।
হাছিনুর আরও দাবি করেছেন, সর্বহারারা একেক রাতে একেক জায়গায় বলে র্যাব বানাতে হয়েছিল! এত প্রয়োজন পড়লে কেন সেই সক্ষমতা দিয়ে পুলিশকে তৈরি করা হয় না? আমি জবাবদিহিতাহীন পুলিশকেও যে কোনো ক্ষমতা দেয়ার বিরুদ্ধে। যে কোন বাহিনীকে জবাবদিহিতায় আনাটা ইতিহাসজুড়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক কোন সমাজে নিজের নাগরিকদের বেলায় এই রকম নিপীড়ন সহ্য করার কথা না। আবু গারিব বা গুয়ানতানামো বের মত কারাগারগুলো বিদেশী শত্রুদের জন্যই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু স্মর্তব্য, এখন প্রমাণিত হয়েছে যে ওই কারাগারগুলোতে আটকে থাকা অধিকাংশ মানুষই নিছক দেশপ্রেমিক, মার্কিন আধিপত্য বিরোধী কিংবা একদমই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন ছিলেন। প্রবল মিথ্যা প্রচারের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বজুড়ে মার্কিন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছিল বলেই অজস্র নিরাপরাধ মানুষ তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পাওয়া আয়নাঘরগুলোতে। দেশের নাগরিকদের জন্য এমন বন্দোবস্ত কিন্তু মার্কিন সমাজে খুব কঠিন। পাকিস্তানে বালুচ এবং ভারতে কাশ্মীরি বন্দিদের এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী অঞ্চলে এমন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার রেওয়াজ আছে। এইসব জায়গায় ওই মানুষগুলোকে তারা আসলে রাষ্ট্রবিরোধী “অনাগরিক” হিসেবেই ধরে নেয়। ৮০ দশকে যে ক্রসফায়ারগুলো ভারতে ঘটেছে, তার বহুগুলোতেই পরবর্তীকালে পুলিশ কর্মকর্তারা শাস্তি পেয়েছেন। গণতন্ত্রের লড়াই শক্তি পেলে এই শাস্তি ভবিষ্যতে সবগুলো দেশেই আরও সুনিশ্চিত হবে, হয়তো।
আয়নাঘরে যতগুলো কাহিনী আমরা দেখলাম, সবগুলো ঘটনারই বৈধপথে আইনানুগ বিচার হতে পারত। সরকার তো বহু মানুষকে এমনিতেও বিনা বিচারে আটকে রাখে। সেগুলোর সমর্থনে কিছু বলাটা আমার উদ্দেশ্য না। বলছি এটুকু যে, গুম হওয়া মানে ওই ব্যক্তিটির জন্য সকল আইনের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। গুম হয়ে যাওয়াটা তাই এমনকী বিনা বিচারে কারাবাসের চাইতেও অনেক বেশি ভয়াবহ নিপীড়ক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।
গুমের মানে শুধু প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা না। একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। যেখানে প্রতিবাদী মানুষ শুধু খুন হয় না, তাদের হাত পা ভাঙা হয় না, বছরের পর বছর তারা কারাগারে থাকে না—তারা দিব্যি অদৃশ্য হয়েও যেতে পারেন। এই অদৃশ্য হবার শাস্তি আর সকল নিপীড়নের চাইতে কখনো কখনো বেশি তীব্র হতে পারে। কেননা একটা প্রবল হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং প্রতীক্ষা সেই পরিবারগুলোকে ঘিরে থাকে। তারা জানেন না তার সন্তানের গায়েবানা জানাজা পড়বেন না তার জন্য আরও কিছু জায়গায় টাকা পয়সা খরচ করে তথ্য আনার চেষ্টা করবেন।
গুমের মানে শুধু প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা না। একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। যেখানে প্রতিবাদী মানুষ শুধু খুন হয় না, তাদের শুধু হাত পা ভাঙা হয় না, বছরের পর বছর তারা অস্তিত্বহীন কারাগারে থাকেন না–তারা প্রিয়জনদের থেকে অদৃশ্য হয়ে থাকেন। এই অদৃশ্য হবার শাস্তি আর সকল নিপীড়নের চাইতে কখনো কখনো বেশি তীব্র হতে পারে। কেননা একটা প্রবল হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং প্রতীক্ষা সেই পরিবারগুলোকে ঘিরে থাকে। তারা জানেন না তার সন্তানের গায়েবানা জানাজা পড়বেন নাকি নানান জায়গায় আরও কিছু জায়গায় টাকা পয়সা খরচ করে জীবিত কিংবা মৃত এই তথ্যটি আনার চেষ্টা করবেন।
৫. নিরবতা এবং উপেক্ষার ষড়যন্ত্র দিয়ে আয়নাঘর নামের গুমঘরের কাহিনীকে ধামাচাপা দিতে দেয়াটা খুব বিপদজনক হবে। মোসাহেবরা এই নিরব, একদম চুপচাপ। তবে দলদাসের তালিকায় নতুন নাম লেখানো কয়েকজনকে দেখলাম প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন করছেন, যদিও অবস্থানের বিবেচনায় তারা নিজেরাও গৌণ। কিন্তু বড়সড় রাঘববোয়াল মোসাহেবরা একদম চুপ, কারণ খুব সম্ভবত এই যে, এই প্রতিবেদনটিরর সাক্ষীদের সত্যতা অসত্যতা যাই থাকুক, আয়নাঘরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে গেলে তাদের নিজেদেরও হাসি পেয়ে যাবে।
আমরা সবাই জানবো এমন একটা কিছুর অস্তিত্ব আমাদের আশে পাশেই আছে, এবং যথাসম্ভব চুপ করে, উপেক্ষা করে যাবো, সেটা হবার না। বরং নেত্রনিউজ এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে। কথা হোক আয়ানাঘর নিয়ে। দাবি আসুক একটা জাতীয় তদন্ত পরিষদ গঠনের, সবগুলো সাক্ষীকে অভয় প্রদান করে ডাকার, তাদের কথা শোনার। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মসূচি দিক, সুস্পষ্ট ঘোষণা দিক: এই সরকার না করলেও নিজেরা ক্ষমতায় গেলে তারা আয়নাঘরের গহব্বর থেকে সত্য বের করে আনবেন, মানুষকে মুক্ত করবেন এই আতঙ্কের সংস্কৃতি থেকে। বিচার হবে এইভাবে মানুষকে নির্যাতনের কারবার যারা খুলে বসেছেন, তাদের প্রত্যেকের। মানুষের শরীর এবং আত্মমর্যাদার চাইতে অলঙ্ঘনীয় কিছু নাই, এই সত্য এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত না করে কিভাবে আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করি?
সীমোর্গের সেই আয়নাঘরের সাধন তখনই সম্ভব, যখন এই পৈশাচিক আয়নাঘরকে গোপনীয়তার আড়াল থেকে দিনের আলোতে নিয়ে আসা সম্ভব হবে; যখন আমরা আর কোন শিশুর কান্না শুনবো না: “আব্বু তুমি কান্না করতেছেো যে…”
৬. নিরবতার প্রসঙ্গেই আবারও ফিরে আসি। গুম-খুন এত বড় একটা প্রপঞ্চ আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই অজস্র গবেষণা হবে, হতে থাকবে। একজন সম্পাদকের জন্য, কিংবা একজন গণমাধ্যম কর্মীর জন্য অথবা একজন কবির জন্য এর চাইতে বড় অসম্মানের আর কী হবে, যখন ভবিষ্যতের কাঠগড়ায় দেখা যাবে তাদের বড় অংশই অজস্র বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু চুপ থেকেছেন তাদের নিজেদের সময়ের সবচাইতে বড় অন্যায়ের উদঘাটনটির বিষয়ে?
এগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আলোচনা কিংবা অমুক তমুক প্রতিনিধির দেনদরবারের চাইতে লজ্জারও আমাদের জন্য আর কিছু নাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রাজনীতির প্রশ্ন নিয়েও আলাপ করা যায়। কিন্তু বিদেশীরা কথা তুলেছে বলেই রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, বিষয়টা এমনও না। এবং এটাই এখন মোসাহেবকূলের প্রিয় অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর সাথে তারা কর্তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কোন জাতি “ক্রস জাতি”, কোন দেশে আমাদের চাইতেও বেশি গুম খুন হয়, সেগুলো তারা আওড়াচ্ছেন। মোসাহেবদেরও মাঝে একটু যাদের লজ্জাশরম আছে, তারা অবশ্য নিরবই।
কিন্তু এটা আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের দেশ। কোন বিদেশী প্রতিনিধির কথায় না, কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপেও না, বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিকের অধিকার আর আত্মমর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি আকারেই “আয়নাঘর” মুক্ত একটা বাংলাদেশ কিভাবে গড়ে তোলা যায়, সেই আলাপটা তুলতে হবে। যুক্তিবোধ, আইন, সমাজ, মানবিকতা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে পুনরুদ্ধদার করতে চাইলে এই নিষিদ্ধ বস্তু নিয়ে কথা বলার কোন বিকল্প আমাদের সামনে নেই।
ফিরোজ আহমেদ
লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।