মুদ্রিত সংস্করণ

- এস আলমের সাথে দিল্লিতে হাসিনার একাধিক গোপন মিটিং
- প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা হস্তান্তর
দেশকে আবার অস্থির করে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরাতে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে শেখ হাসিনার সাথে মিলে ব্যাংকের তহবিল লুটের জন্য অভিযুক্ত, জনগণের টাকা পাচারকারী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের একাধিক বৈঠকে। এই উদ্দেশ্যে এস আলম সম্প্রতি দিল্লি গিয়ে পলাতক শেখ হাসিনার সাথে গোপন বৈঠক করে তাকে ২৫০০ কোটি টাকা হস্তান্তর করেছেন এবং আরো দুই হাজার কোটি টাকা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফেরানোর উদ্দেশ্যে।
উমরাহ সফরের আড়ালে রাজনৈতিক এজেন্ডা : গত ২ আগস্ট পবিত্র উমরাহ পালনকে সামনে রেখে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান দোসর সাইফুল আলম মাসুদ সিঙ্গাপুর থেকে একটি ফ্লাইটে সৌদি আরব যান। তার একদিন পর ৩ আগস্ট তিনি মক্কা ক্লক টাওয়ারের ফেয়ারমন্ট হোটেলে উঠেন।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, পবিত্র উমরাহ পালন করার দোহাই দিলেও সাইফুল আলম মাসুদের মক্কায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি সেখানে যান মূলত দেশ থেকে পালানো আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। মক্কার ফেয়ারমন্ট হোটেলে বসে তিনি পলাতক আওয়ামী নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
ওই সূত্রটির মাধ্যমে জানা গেছে যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ও জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী হিসেবে চিহ্নিত সাইফুল আলম মাসুদ দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের বিনিময়ে মক্কায় একটি বিলাসবহুল হোটেল কেনার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথেও জরুরি মিটিং করেন।
মক্কায় পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে দেশবিরোধী বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজানো শেষে ৪ আগস্ট এস আলম মদিনায় চলে যান এবং “ইলাফ আল তাকওয়া” হোটেলে উঠেন। সেখানে তিনি চট্টগ্রামের কিছু চিহ্নিত আওয়ামী ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। দুই দিন সেখানে অবস্থান শেষে ৬ আগস্ট তিনি দুবাইতে চলে যান।
দুবাই হয়ে দিল্লিতে আগমন : আরব আমিরাতের দুবাইতে কোনো রকম বিলম্ব না করে ৬ আগস্ট বিশেষ ফ্লাইটে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পৌঁছান এস আলম। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, দিল্লি সফরে তার সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ তাদের ছোট ছেলে ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক একজন চেয়ারম্যান। দিল্লিতে নেমে তারা উঠেন ভারতের বিখ্যাত পাঁচ তারকা হোটেল দি ওবেরেই নিউ দিল্লিতে আর সেখান থেকে শুরু হয় এস আলমের এই সফরের মূল এজেন্ডা।
এ সময় তার সাথে দেখা করেন পলাতক সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মোহাম্মদ আলী আরাফাতসহ অনেকে। মূলত দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা হয় তাদের মধ্যে।
হাসিনার সাথে গোপন বৈঠক : এস আলমের দিল্লি সফরের সবচেয়ে বড় এজেন্ডা ছিল স্বয়ং শেখ হাসিনার সাথে গোপন মিটিং। ৮ আগস্ট দুপুরে হোটেলে এস আলম তার সব ফোন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইজ রেখে একটি নম্বরপ্লেটহীন গাড়িতে রওনা করেন, আর পথে দুই-দুইবার পরিবর্তন করা হয় তাকে বহন করা গাড়ি। অবশেষে তাকে বহনকারী গাড়িটি পৌঁছায় Lutyens Bungalwo Zone-LBZ-এ অবস্থিত হাসিনার বাসভবনে। সেখানে এস আলম বেলা ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করেন।
এই দীর্ঘ সময়ে শেখ হাসিনার সাথে একান্ত আলাপ হয় এস আলমের। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই সময়ে ভারতের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা ও ক্ষমতায় ফিরে আসতে তার দীর্ঘদীনের সহযোগী এস আলমের কাছে চার হাজার পাঁচশত কোটি টাকা চান এবং এস আলম এই পরিমাণ টাকা তাকে দিতে সম্মত হন। এই অর্থ নির্দিষ্ট কিছু খাতে ব্যয় করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে- প্রথমত. ইন্ট্যারন্যাশনাল লবি ও বিভিন্ন দেশের পলিসি মেকারদের আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করার জন্য ম্যানেজ করা; দ্বিতীয়ত. আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেশজুড়ে নাশকতা সৃষ্টি করে এমন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাতে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়; তৃতীয়ত. সরকারি আমলা, পুলিশ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিনে ফেলা; চতুর্থত. আওয়ামী নেতাকর্মীদের জামিনের লক্ষ্যে খরচ করা এবং পঞ্চমত. এস আলমের সুগার রিফাইনারিসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগঠন করা।
আর এ অর্থ গ্রহণ, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত তিনজনের কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
পরবর্তী বৈঠক ও কার্যক্রম : শেখ হাসিনার অবস্থানস্থল থেকে ফিরে এসে এস আলম তার হোটেল দি ওবেরেই, নিউ দিল্লিতে উঠেন। ৮ ও ৯ আগস্ট টানা দুই দিন তিনি ওই হোটেলে অবস্থান করে ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সিরিজ মিটিং করেন। এরপর ১০ আগস্ট এস আলম ফের শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে তার বাসভবনে যান। সেদিন এস আলম বেলা ৩টা থেকে প্রায় রাত ১১টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।
এই মিটিংয়ে শেখ হাসিনাকে এস আলম আড়াই হাজার কোটি টাকা প্রদান করেন। এই টাকা এস আলম তার আদানি গ্রুপে থাকা তিন বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট থেকে উঠিয়ে দেন। এর বাইরে বাকি দুই হাজার কোটি টাকা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
পরদিন অর্থাৎ ১১ আগস্ট এস আলম নয়াদিল্লি থেকে বিমানে মুম্বাইতে যান এবং সেখানে অবস্থিত Kokilaben Dhirubhai Ambani Hospital and Medical Research Institute হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তিনি দিল্লিতে ফিরে আসেন। এরপর ১৬ আগস্ট শেষবারের মতো শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং দেশবিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেন। সবশেষে ১৭ আগস্ট দিল্লি সফর শেষ করে এস আলম সিঙ্গাপুরে ফিরে যান।
এ দিকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের এই সফর ও শেখ হাসিনার সাথে একাধিক গোপন বৈঠক দেশকে আবার রাজনৈতিক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেন এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার এবং তা আবার দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি। এই বিষয়ে দেশবাসীর সতর্ক দৃষ্টি ও সচেতনতা এখন অতীব জরুরি এবং একই সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এই ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে কেউ দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ না পায়।
এক নজরে এস আলমের সফরসূচি
* ২ আগস্ট ২০২৫-সৌদি আরব (মক্কা)
* উমরাহ পালনের অজুহাতে যাত্রা
* মক্কা ক্লক টাওয়ারে অবস্থান
* পলাতক আওয়ামী নেতাদের সাথে বৈঠক
* পাচারকৃত অর্থ দিয়ে হোটেল কেনার পরিকল্পনা
৪-৫ আগস্ট ২০২৫-মদিনা
* Elaf Al Taqwa হোটেলে ওঠা
* চট্টগ্রামের আওয়ামী ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা
* দেশবিরোধী পরিকল্পনা
৬ আগস্ট ২০২৫-দুবাই- দিল্লি
* দুবাই থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লি আগমন
* সফরসঙ্গী: স্ত্রী, সন্তান ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম
* The Oberoi, Nwe Delhi হোটেলে ওঠা
* আওয়ামী নেতাদের (নওফেল, নানক, আরাফাত) সাথে বৈঠক
৮ আগস্ট ২০২৫-দিল্লি, লুটিয়েন্স বাঙলো জোন
* শেখ হাসিনার সাথে ৫ ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠক
* ৪,৫০০ কোটি টাকা দেয়ার অঙ্গীকার
* অর্থ ব্যয়ের খাত:
১. আন্তর্জাতিক লবিং
২. দেশে অরাজকতা সৃষ্টি
৩. প্রশাসন/পুলিশ কেনা
৪. জামিন খরচ
৫. শ্রমিক নেটওয়ার্কে আন্দোলন
১০ আগস্ট ২০২৫-শেখ হাসিনার বাসভবন
* দ্বিতীয় দফায় বৈঠক
* ২,৫০০ কোটি টাকা সরবরাহ
* বাকি ২,০০০ কোটি নভেম্বর মাসে দেয়ার প্রতিশ্রুতি
১১-১৫ আগস্ট ২০২৫-মুম্বাই
* Kokilaben Ambani Hospital-এ স্বাস্থ্য পরীক্ষা
১৬ আগস্ট ২০২৫-দিল্লি
* শেখ হাসিনার সাথে শেষ বৈঠক
* নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিকল্পনা
১৭ আগস্ট ২০২৫-সিঙ্গাপুর প্রত্যাবর্তন
* সফর সমাপ্তি
* বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেন ও ষড়যন্ত্র নিশ্চিত