আমরা আর মামুরা মার্কা নির্বাচন কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না

আমরা আর মামুরা  মার্কা নির্বাচন কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে নারুহুল কবির রিজভী

নির্বাচন বর্জনও প্রতিহতের একটি অংশ বলে দাবি করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, মানুষ যদি ভোট দিতে কেন্দ্রে না যায়, ভোটদানে বিরত থাকে– সেটাই বড় প্রতিহত। আমি ও ডামি প্রার্থী, নৌকা, ঈগল ও ট্রাক প্রতীকে আমরা আর মামুরা ভাগাভাগির নির্বাচন কোনোভাবেই দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি চরম হাস্যকর ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণার নির্বাচন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিএনপির এই মুখপাত্র। তিনি বলেন, কোনো স্যাংশনের ভয়ে নয়, বিএনপি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচন প্রতিহত করতে মানুষের হাতে লাঠি তুলে দিতে পারে না। সাক্ষাৎকারে নির্বাচন, আন্দোলন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, আওয়ামী লীগকে ভারতের সমর্থনসহ বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দেন তিনি।

সমকাল: নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির দীর্ঘদিন ধরে টানা আন্দোলনে সরকার সাড়া দেয়নি– দু’দিন পর নির্বাচন। এখন আপনারা কী করবেন?

রুহুল কবির রিজভী: আওয়ামী লীগ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাৎসিবাদী, বাকশালী এবং ভয়ংকর স্বৈরতান্ত্রিক। গণতন্ত্রবোধ থাকলেও হয়তো তাদের জনগণের দাবির মুখে সাড়া দেওয়ার বিষয় থাকত। যেখানে দেশের সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায়, সেখানে তারা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে। তবে জনগণের আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আমরা কর্মসূচির মধ্যে আছি। অভীষ্ট লক্ষ্য বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। নতুন কর্মসূচি হিসেবে ৬ জানুয়ারি ভোটের আগের দিন ভোর ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার টানা হরতাল দিয়েছি।

সমকাল: আপনারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দাবি আদায়ে বাধ্য এবং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন প্রতিহতের পরিবর্তে বর্জনের সিদ্ধান্ত কেন?

রুহুল কবির রিজভী: এটা প্রতিহতের একটি অংশ। মানুষ যদি ভোট দিতে কেন্দ্রে না যায়, ভোট দানে বিরত থাকে– সেটাই বড় প্রতিহত। আমরা লিফলেট বিতরণকালে জনগণের মুখের যে ভাষা শুনেছি, তাতে মানুষ সম্পূর্ণরূপে ভোট বর্জন করেছে। তারা একে প্রহসনের ও মিথ্যাচারের নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

সমকাল: দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এ সিদ্ধান্ত, নাকি অন্য কোনো কৌশল আছে? বিএনপির নিজ দলের শক্তির চেয়ে বিদেশনির্ভরতা বেশি বলেও গুঞ্জন রয়েছে– কী বলবেন?

রুহুল কবির রিজভী: সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল– মানুষকে হাতে লাঠি নিয়ে প্রতিহত করার কর্মসূচি দেবে না। আমরা জনগণকে নিয়ে সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছি। ঢাকায় মহাসমাবেশসহ বছরজুড়ে বিভাগীয় পর্যায়ে সভা-সমাবেশগুলোসহ সারাদেশে বিএনপির কর্মসূচিতে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি অনেক শক্তিশালী, তারা বিদেশনির্ভর নয়। এমনকি আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিহত ও আহত এবং জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন।

সমকাল: নির্বাচনে বাধা দিলে মার্কিন স্যাংশনের মধ্যে পড়তে পারে বিএনপিও– এমন শঙ্কা থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে?

রুহুল কবির রিজভী: বিশ্বের গণতান্ত্রিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে জানি না। আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী দেশগুলো সংহতি ও সমর্থন জানিয়েছে। সবাই জানেন, জনগণের গণতন্ত্র ও বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপি লড়াই করছে। পৃথিবীর সব স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাংলাদেশে কারা গুম-খুন ও গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে তাও জানেন। বিএনপি কোনো সন্ত্রাসবাদী দল নয়– তাদের কর্মকাণ্ডে স্যাংশনের কোনো শঙ্কা নেই। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিও গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জনগণের শক্তির ওপর ভর করে চলছে। কর্তৃত্ববাদী ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসসহ পৃথিবীর অনেক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে। অহিংস আন্দোলনের মুখে তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আওয়ামী লীগও বাধ্য হবে।

সমকাল: সরকার পতনের আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও নাশকতার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হলো– বিএনপির অর্জনটা কী?

রুহুল কবির রিজভী: বিএনপির বড় অর্জন সারাদেশের মানুষকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। তাদের দাবির পক্ষে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে দেশি-বিদেশিদের সমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছে। সরকার মানুষকে যেভাবে গুপ্তহত্যা করছে, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তার বিরুদ্ধে মানুষকে এক কাতারে এনেছে বিএনপি।

সমকাল: জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ  ১৯৯৬ সালে একবার আন্দোলন করেই বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তিন মেয়াদে আন্দোলন করেও বিএনপি ব্যর্থ হচ্ছে কেন?

রুহুল কবির রিজভী: আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈশিষ্ট্য এক নয়। আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ একনায়কত্ব, কর্তৃত্ববাদী একটি ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দল। আর বিএনপি হলো উদার ও গণতন্ত্রমনা দল। দুই দলের মধ্যে সংস্কৃতিও ভিন্ন। তারা (আওয়ামী লীগ) যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলন জোরদার করেছে, বিএনপি তখন সেই দাবিটি মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো গদি রক্ষায় র‍্যাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আন্দোলন দমন করেনি বিএনপি। এটাই বড় দুর্বৃত্ত– সব দল যখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিয়েছে, তখন তারা সামান্যতম নীতি-নৈতিকতাবোধ না দেখিয়ে ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে দিয়েছে, যা তাদের ১৯৭২-১৯৭৫ সালের একদলীয় বাকশালীয় শাসনামলকেও হার মানিয়েছে।

সমকাল: আপনাদের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পৃক্ততা থাকলে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে সাড়া দেয়নি কেন? নাকি দলের নেতৃত্বে কোনো ভুল রয়েছে?

রুহুল কবির রিজভী: নিশ্চয় মানুষ সাড়া দিয়েছে। ভোট বর্জনে গণসংযোগ কর্মসূচিতে সাধারণ কাঁচাবাজারের দোকানদার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখেছি। মানুষের সম্পৃক্ততা শুরু হয়েছে, মানুষ প্রস্তুত। তবে মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ভয়ভীতি কাজ করছে। এটা সত্য– ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে জার্মানির হিটলারের নাৎসি বাহিনীও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি।  ১৯৭১  সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকার রাস্তায় কি কেউ কোনো মিছিল করতে পেরেছে? পারেনি। ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর সার্বিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশিরা।

সমকাল: জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আবার একই প্ল্যাটফর্ম থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে এক মঞ্চ থেকে আন্দোলনের চেষ্টা হলেও বিএনপির ভেতর ও সমমনাদের বিরোধিতার কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না– এটা কি ঠিক?

রুহুল কবির রিজভী: এক প্ল্যাটফর্মের বিষয় নয়। এখনকার সিদ্ধান্ত হচ্ছে– একই দাবিতে সমমনা দলগুলো একই কর্মসূচি নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুগপৎভাবে পালন করবে।

সমকাল: আপনিসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কারণে আওয়ামী লীগ বারবার একতরফা নির্বাচন করেও ক্ষমতায় টিকে থাকে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র তথা জনগণের বিরুদ্ধে ভারত অবস্থান নিয়েছে বলে আপনাদের অভিযোগের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলবেন?

রুহুল কবির রিজভী: এটা দৃশ্যমান। ভারতের কূটনৈতিক, ব্যুরোক্র্যাট ও ঢাকাস্থ হাইকমিশনার আওয়ামী লীগের সমর্থনে কথা বলছেন। সে দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকরাও প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার পক্ষে উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছেন। অতীতে সুজাতা সিংও বলে গেছেন এবং এখনও তারা বলছেন। ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের একটি দলের পক্ষে, জনগণের পক্ষে নয় বলেই প্রশ্ন উঠেছে। ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই গণতন্ত্র চর্চা করে আসা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। বিচার বিভাগসহ পলিসিগত অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে তারা। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতাও নেই। তাদের (ভারত) অবস্থান প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের বিরুদ্ধে যায় কীভাবে? বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে অবৈধভাবে সরকার গঠন ও একতরফা নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন দেয় কীভাবে? তারা কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না– প্রশ্ন উঠেছে এখানেই।

সমকাল: যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিলেও এখন চুপচাপ কেন?

রুহুল কবির রিজভী: আমরা যতটুকু জানি, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক– সেটাই তারা চায়। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের অবস্থানের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে, নাকি কমেছে– সেটা আমরা বলতে পারব না। সময়ই বলে দেবে।

সমকাল: দলীয় স্বতন্ত্র ও মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবে বলে দাবি করছে সরকার। আপনার বক্তব্য কী?

রুহুল কবির রিজভী: এতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। আমি ও ডামি প্রার্থী, নৌকা, ঈগল ও ট্রাক প্রতীকে– ‘আমরা আর মামুরা’ ভাগাভাগির নির্বাচন কোনোভাবেই দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি চরম হাস্যকর ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণার নির্বাচন।

সমকাল