আপসকামিতাই প্রকাশনার দুর্বল দিক: বই নিষিদ্ধ হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলি কি করে?

 

কাজল ঘোষ

৬ জুলাই ২০২৩

কাজল ঘোষ: দুই দশকের বেশি সময় প্রকাশনায় যুক্ত রেদওয়ানুর রহমান। দীর্ঘ সময়ে বেশকিছু ভালো বই প্রকাশ করেছেন। সৃজনশীল প্রকাশনায় যুক্ত তরুণ প্রকাশকের মধ্যে তিনি প্রথম কাতারে। দশবারের মতো অংশ নিচ্ছেন নিউ ইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলায়। গত বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার প্রকাশনা নালন্দা থেকে প্রকাশিত ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি নিষিদ্ধ করে বাংলা একাডেমি। এটি কোনো রাজনৈতিক রচনা না হওয়ার পরও কেন নিষিদ্ধ করা হলো- তার নির্দিষ্ট কারণও একাডেমি কর্র্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি। প্রকাশনা শিল্পের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন-

প্রশ্ন: প্রকাশনা কি বাংলাদেশে শিল্প হয়ে উঠেছে?
-প্রকাশনা অবশ্যই একটি শিল্প! দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরাও এটিকে শিল্প ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো সরকার এটাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়নি। এর প্রধান অন্তরায় সরকারের অবহেলা। বাংলাদেশে প্রায় ২ শতাধিক সৃজনশীল প্রকাশনা রয়েছে।

এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ৫ লক্ষাধিক শ্রমিক ও কর্মকর্তা। আমার কাছে মনে হয় হয়, সরকারের অবহেলা এবং প্রকাশনায় সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় প্রকাশনা এখনো শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না।

প্রশ্ন: এতকিছু থাকতে প্রকাশক হতে গেলেন কেন?
-প্রকাশনায় যুক্ত আজ প্রায় ২১ বছর। অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রকাশনায় যুক্ত হয়েছিলাম। এই লম্বা সময়ে ধীরে ধীরে এই পেশাকে নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নিয়েছি। পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে কিছুদিন সাংবাদিকতায় জড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু সেখানে অ্যাডজাস্ট করতে না পেরে অবশেষে বড় ভাই কে এম লিয়াকতের হাত ধরেই প্রকাশনায় আসা! তিনি তখন বর্ণায়ন প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী।  বলা যায়, অনেকটা পারিবারিক কারণেই প্রকাশনা ব্যবসায় আসা। প্রকাশনার সঙ্গে আমার তিন পুরুষের সংযোগ। আমার দাদা, বাবা এবং পরে বড় ভাই যুক্ত হয়েছেন। আর তাদের হাত ধরেই এই ব্যবসায় আসা।

প্রশ্ন: অনেকেই বলে থাকেন বর্তমান সময়ে মত প্রকাশ সংকুচিত। বই তো মত প্রকাশ করার একটি মাধ্যম। বই প্রকাশে বাধার সম্মুখীন হন কিনা?
-বাংলাদেশের প্রকাশনা স্বাধীন মত প্রকাশের একটা মাধ্যম, এই বিষয়টিকে এখন আমি স্বীকার করি না। গত বছর আমি একটি বই প্রকাশ করেছিলাম জান্নাতুন নাঈম প্রীতির। বইটির নাম ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’। বইটিতে তার ব্যক্তি জীবনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। অনেকটা তার আত্মজীবনীর মতো। বই প্রকাশের ৭ দিনের মাথায় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বইটি নিষিদ্ধ করেন। তাহলে কীভাবে বলি, বাংলাদেশে প্রকাশনার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলো।

প্রশ্ন: সবশেষ বইমেলায় ৪টি বই নিষিদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে আপনার প্রকাশনার একটি। অন্য তিনটির চেয়ে আপনারটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বলবেন কি?
-বইমেলায় নালন্দা প্রকাশিত ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি কি কারণে নিষিদ্ধ করলো, তা এখনো আমার বোধগম্য নয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এখনো এর যথাযথ উত্তর দেয়নি। অন্য যে তিনটি বই নিষিদ্ধ করেছে, শুনেছি সেখানে সরকার এবং রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইটি তো লেখকের আত্মজীবনী। তার আত্মজীবনীতে সে যেকোনো কথা লিখতে পারে। সেখানে বই নিষিদ্ধ হওয়ার মতো কি হলো?

প্রশ্ন: লেখক ও প্রকাশক সমান তালে চলে- কিন্তু উভয়ের একে অপরের প্রতি ব্যাপক অভিযোগ? লেখক সম্মানী না দেয়া অন্যদিকে প্রকাশক লেখার মান ভালো না বলে থাকে- এমনটি কেন?
-লেখক ও প্রকাশকের সম্পর্ক হওয়া উচিত বন্ধুসুলভ এবং সেই সঙ্গে প্রফেশনাল।
আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগেও এমনটা বলা হতো যে, প্রকাশকরা লেখকের প্রাপ্য সম্মানীটুকু দেন না। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখনকার প্রায় সব তরুণ প্রকাশকই লেখকের লেখক সম্মানী দিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, তবে অনেকক্ষেত্রে আমিও অনেকের যথাযথ সম্মানী দিতে পারিনি। তার কারণ বই তো অর্থলগ্নী করে প্রকাশ করেছি। কিন্তু ঐ লেখকের ৫০ কপি বইও আমি বিক্রি করতে পারিনি। তাহলে আমি রয়্যালিটি  দেব কীভাবে? এমনিতেই তো বই প্রকাশ করে আমার সম্পূর্ণ টাকা আটকে আছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে লেখকদের নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করেন?
-বাংলাদেশের লেখকদের নিয়ে আমার বেশ মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে। লেখকরা কিন্তু জন্ম  থেকে কেউ লেখক হয়ে উঠে না। প্রথমে লিটলম্যাগ, তারপর জাতীয় দৈনিক অতঃপর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা। এগুলোর মাধ্যমেই মূলত একজন মানুষ ক্রমশ লেখক হয়ে ওঠে। তাই বলছি, লেখকের যেমন পড়ালেখার মূল্য দিতে হবে প্রকাশককে, তেমনি একজন প্রকাশকই পারে তাকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে।  কিন্তু মূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। প্রকাশক যখন একজন লেখককে তৈরি করলো, তখন লেখকগণ উড়াল দিয়ে চলে যায় অন্য কোনো জায়গায়। কারণ আর কিছুই না। লেখক মনে করে এখানে তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া অর্থনৈতিক বিষয়াবলি তো আছেই। সে মনে করে এখান থেকে চলে গেলে আরও বেশি টাকার মালিক হওয়া যাবে। তাই কোনো প্রকাশকই  লেখক ধরে রাখতে পারে না। আবার এমনও হয় কোনো ধনকুবের প্রকাশক মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আমাদের তৈরি করা লেখককে ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আসলে কিছু বলার থাকে না।

প্রশ্নপ্রকাশনা শিল্পে দুই দশকের অভিজ্ঞতায় দুর্বল দিকগুলো কি?
-আমার বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রকাশনায় সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো আপসকামিতা। এখান  থেকে আমরা বের হতে পারছি না। এক. লেখকরা লিখে দেয়, কিন্তু যথাযথ সম্পাদনার ব্যবস্থা নাই। কারণ লেখক মনে করেন  সে যথাযথ ভাবেই লিখেছেন। এখানে হাত দেয়া যাবে না। দুই. বেশির ভাগ প্রকাশনার সম্পাদনা বিভাগ নেই। তিন. বাংলাদেশের কাগজ ব্যবহার করলে দুই ধরনের কাগজ চোখে পড়ে। আমি হয়তো অফহোয়াইট কালারের অর্ডার দিয়েছি। আমাকে দিয়েছে ডিপ অফহোয়াইট কালার। এখানে বই বাঁধাই হওয়ার পর দেখা যায় একই বইতে দুই রকমের কাগজ। চার. আমি বাঁধাইয়ের আগে কারখানায় একটা ড্যামি পৌঁছে দিই। তাতে বইয়ের মাপ ও মার্জিন থাকে। তারপরও দেখা যায় বাঁধাইকারক মার্জিন ঠিক রাখেনি। বোর্ড বড় বা ছোট করে  ফেলছে। সব সময়ই আমরা এই ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।