মিহির স্বরূপ শর্মা
দশকের পর দশক আদানি গ্রুপ শেয়ার বাজারে নির্লজ্জ কারসাজি এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতি করেছে—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পুঁজিবাজার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এমন অভিযোগ তোলার পর সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে যখন আদানি গ্রুপ আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিচ্ছিল তখন তাদের ঠাটবাট তাদের অস্বীকারসূচক ভঙ্গিকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল।
আদানি গ্রুপের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা যুগেসিন্দর সিং একটি বিশালাকৃতির ভারতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় তাঁকে যতটা না একটি অভিযুক্ত কোম্পানির নির্বাহী মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁকে একজন সরকারি কর্মকর্তা মনে হচ্ছিল। তিনি পরিষ্কারভাবে এই বার্তাটি দিচ্ছিলেন: যদি আপনি আদানির বিরুদ্ধে লাগতে আসেন, তাহলে আপনি প্রকৃতপক্ষে ভারতের বিরুদ্ধেই লাগতে এসেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটি পুরোপুরি অসত্যও নয়। বন্দর, সড়ক, রেল, বিমানবন্দর এবং বিদ্যুৎসহ বড় বড় খাতে বিনিয়োগ করা আদানি গ্রুপ এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনাধীনে এগিয়ে চলা ভারতের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে কাজ করছে। এই গ্রুপটি গত দুই দশক ধরে মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে কাজ করছে।
কিন্তু স্বজনতোষীবাদের (ক্রোনিজম) কথা উঠলে প্রায়শই যে পয়েন্টটি বাদ পড়ে যায়, সেটি হলো, আদানি না থাকলে ভারত সরকারকে একজন আদানিকে উদ্ভাবন করতে হতো। কারণ আমরা এখন যে উন্নয়ন মডেল বেছে নিয়েছি তার জন্য সরকারের আদানি গ্রুপের মতো ঝুঁকি নেওয়া ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নদের’ একান্ত দরকার। এর বাইরে আপনি আর কী আশা করতে পারতেন যখন কিনা অন্য অনেক দেশের মতো ভারতও সাবেকি ঘরানার শিল্প নীতি বাঁচাতে প্রথাগত বাজার-সহায়ক কাঠামোগত সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে?
হিন্ডেনবার্গ তাদের প্রতিবেদনে যা বলেছে তার বেশির ভাগই ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন কোনো খবর না। তাঁরা বহু বছর ধরে ভালো করে জানেন, আদানি সাম্রাজ্যের ভিত্তি আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত এবং এই গ্রুপটির অর্থায়নের চূড়ান্ত উত্সটি উল্লেখযোগ্যভাবে অস্বচ্ছ। আদানির শেয়ার সাধারণত এমন সূক্ষ্ম ও স্থিতিশীলভাবে লেনদেন হয় যে খুব কম লোকই বিশ্বাস করতে চাইবে যে আদানি কোম্পানিগুলো খুচরা বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করতে শুরু করেছে। এমনকি সরকারি খাতের ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা কোম্পানি উভয়ই আদানির কোম্পানি নামে সর্বস্ব খাঁটিয়ে অবলীলায় বাজি ধরে থাকে।
না, এটি ভারতীয়দের জন্য বড় ভয়ের কিছু না। তাদের আসল ভয় অন্য কিছুতে। সেটি হলো, গৌতম আদানি এবং তাঁর কোম্পানিগুলো যা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, তা আদতে তারা করতে পারবে না। তারা যে সড়কগুলো তৈরি করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা কি আসলে তা করতে পারবে? যে বন্দরগুলো উন্নয়নের ভার তাদের দেওয়া হয়েছে, তারা কি আসলে তা করতে পারবে? তারা অন্য কোম্পানিগুলোকে হারিয়ে দিয়ে যে বিমানবন্দরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়েছিল, তা কি তারা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারবে? বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানিই তা করতে সক্ষম হয়নি।
আদানির কোম্পানিগুলোকে শুধু যে ভারতের পরিকাঠামোর বিস্তৃত অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা নয়। তারা সেই সব খাতের অংশীদার হিসাবেও সরকারের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে যেসব খাতকে আমাদের শিল্পনীতি-নির্ধারকেরা ভারতের প্রবৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সরকার কি চায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো সোলার প্যানেল তৈরির কারখানা স্থাপন করুক? জবাবে আদানি বলছে, এটি করতে তারা দায়বদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী মোদি কি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে একটি কড়া লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন? জবাবে আদানি বলছে, এটি পূরণে তাদের অঙ্গীকার করতে সময় লাগবে না। আমরা অস্ত্রশস্ত্রে স্বনির্ভর হওয়া নিয়ে কি উদ্বিগ্ন? আদানি বলবে, চিন্তা নেই, আদানি একটি ‘ “মেক ইন ইন্ডিয়া” র অধীনে দেশীয় প্রতিরক্ষা ইকোসিস্টেম’ তৈরি করার উদ্যোগ নেবে। নীতি নির্ধারকেরা কি সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইন নিয়ে চিন্তিত? গৌতম আদানি চট করে ‘সম্পূর্ণরূপে স্থানীক এবং আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনের সঙ্গে সংযুক্ত একটি মূল্য শৃঙ্খলের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেবেন।
আদানি গ্রুপ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পুঁজি কোত্থেকে জোগাড় করছে তা নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। এর মধ্যে কিছু লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারতের কাছে পুঁজির অভাব নেই। তবে সেই পুঁজি খাঁটিয়ে কাজ উঠিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা থাকা দরকার, নিশ্চিতভাবে ভারতের সেই সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আর আদানির কোম্পানিগুলো সেই সক্ষমতা সরবরাহেরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের যা প্রয়োজন তা মেটাতে একদিকে সরকারি খাত যেমন খুবই অদক্ষ; অন্যদিকে বেসরকারি খাত রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন।
সরকারি খাত খুব শিগগিরই কোনো বিষয়ে সক্ষম হতে যাচ্ছে, এমনটি নয়। রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে পারে এমন নিয়ন্ত্রক, আইনি এবং প্রশাসনিক সংস্কারও নীতিনির্ধারকদের আলোচনার টেবিলের বাইরে রয়ে গেছে। এই অবস্থায় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির যা প্রয়োজন তা আদানি ছাড়া আর কে তৈরি করতে চাইবে?
সরকারি সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে অন্তহীন আত্মবিশ্বাস, বাইজান্টাইন শাসকদের মতো কঠোর বিধিবিধান মানার ক্ষমতা এবং প্রচুর অর্থের ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা মোদির ভারতে আদানি ছাড়া আর কারও নেই। অনেকে মনে করেন, আদানি এত বড় যে তাঁর ভরাডুবি হতেই পারে না। আসলে তা নয়। বরং এটি বলা যায়, আদানি মোদি সরকারের কাছে এতটাই অনন্য যে তিনি ব্যর্থ হতেই পারেন না।
ব্যর্থতার হাত ধরে আদানি নিজের পতনের সঙ্গে ভারতের শিল্প নীতিকেও তলানিতে নিয়ে যাবেন। আদানির ওপর ভরসা করে যে কোম্পানিগুলো বাজি ধরেছে শুধু তারা নয়, এর জের ভারতের ব্যাংক, ভারতের রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি ভারতের নাগরিকদের জের টানতে হবে
সরকারি খাতের ব্যাংক, পেনশন তহবিল, দেশের বাইরে থাকা অজ্ঞাতনামা মূলধন-যেখান থেকেই অর্থ আসুক না কেন, ভারতের প্রবৃদ্ধির জন্য যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সেই অর্থ কতটা উত্পাদনশীলভাবে ব্যয় করা হচ্ছে। কার্যকর অলিগার্করা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তারা একটি দেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা জানতে রাশিয়ার দিকে তাকাতে পারেন। এটি নিশ্চিত যে অযোগ্য অলিগার্করা এক কথায় বিপর্যয়কর।
যদি গৌতম আদানির কোম্পানিগুলো তাঁর অঙ্গীকারের একটি ভগ্নাংশও পূরণ করতে পারে, তাহলে হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা ইতিমধ্যে কাগজে-কলমে দেখানো অর্জনের কাছে পৌঁছাতে পারে। আর যদি তাঁর কোম্পানিগুলো সেটুকু প্রতিশ্রুতি পূরণেও ব্যর্থ হয়, তাহলে তাঁর বিনিয়োগকারীরা যা হারাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারাবে ভারত। সেই ব্যর্থতার হাত ধরে আদানি নিজের পতনের সঙ্গে ভারতের শিল্প নীতিকেও তলানিতে নিয়ে যাবেন। আদানির ওপর ভরসা করে যে কোম্পানিগুলো বাজি ধরেছে শুধু তারা নয়, এর জের ভারতের ব্যাংক, ভারতের রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি ভারতের নাগরিকদের জের টানতে হবে।
- ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মিহির স্বরূপ শর্মা একজন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ যিনি অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো ও ব্লুমবার্গ নিউজের কলামিস্ট।