আড়াই টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছাড়িয়েছে ১০টাকা! গ্রাহকের কাঁধে দামের বোঝা

ইসমাইল আলী: দেশে গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়েছে। যদিও এর প্রায় অর্ধেক নিয়মিতই বসে থাকে। শীতকালে এ বসে থাকার হার বাড়ে। তবে অপরিকল্পিতভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ে। ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় আড়াই টাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ছাড়িয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে সরকার ভর্তুকি বৃদ্ধি করেছে বিদ্যুৎ খাতে। তবে তাতেও কাজ হয়নি, প্রতি বছর বাড়ছে লোকসান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) ও গ্রাহক পর্যায়ের দাম বাড়ানো হয়েছে। কয়েক দফা দাম বৃদ্ধির পরও গত অর্থবছর রেকর্ড লোকসান করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বিতরণকারী এক সংস্থা ও চার কোম্পানি। এতে আগামী নির্বাচনের পর আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। তবে এবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে পিডিবি।

সূত্র জানায়, পিডিবি চাচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের জন্য ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম রাখা হবে। এ ধরনের গ্রাহকদের ভর্তুকি দেয়া হবে। তবে ২০০ ইউনিটের বেশি বিলে কোনো ধরনের ভর্তুকি দেয়া হবে না। সেক্ষেত্রে বর্ধিত হারে তথা গড় উৎপাদন ব্যয়ের সমহারে বিল আদায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও গত ১৯ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে এ ধরনের ইঙ্গিত দেন।

পিডিবির গত ১৫ বছরের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল দুই টাকা ৫৩ পয়সা। পরের অর্থবছর তা সামান্য বেড়ে হয় দুই টাকা ৫৮ পয়সা। ২০১০-১১ অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতা অনেকটাই বাড়ে। ওই বছর বেশ কয়েকটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। এর প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন গড় ব্যয় বেড়ে হয় তিন টাকা ৯৫ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৩৬ পয়সা ও ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৭৭ পয়সা।

২০১৩-১৪ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়ে। ওই অর্থবছর গড় ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৮ পয়সা। পরের অর্থবছর তা এক পয়সা কমে দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নি¤œমুখী হওয়ার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে। ওই অর্থবছর গড় ব্যয় কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর তা সামান্য বেড়ে হয় পাঁচ টাকা ৬৯ পয়সা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন গড় ব্যয় আবারও ছয় টাকা ছাড়ায়। ওই অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা ৩৩ পয়সা।

পরের দুই বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় হ্রাস পায়। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা এক পয়সা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৯১ পয়সা। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারও বাড়তে শুরু করে। ওই অর্থবছর তা বেড়ে হয় ছয় টাকা ৬১ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ৮৪ পয়সা। আর সর্বশেষ গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় (সাময়িক হিসাবে) ১০ টাকা ১৭ পয়সা।

এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকায় সরকারের ভর্তুকি এ খাতে বাড়াতে হয়। তবে তা দিয়ে বাড়তি ব্যয়ের চাপ মেটানো যায়নি। এজন্য বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে পাইকারি ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। যদিও পাইকারি মূল্যহার একবার সামান্য কমানো হয়েছিল। তবে গ্রাহক পর্যায়ে কখনোই কমেনি বিদ্যুতের দাম।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১১ সালের শুরুতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম ছিল দুই টাকা ৩৭ পয়সা। বর্তমানে তা ছয় টাকা ৭০ পয়সা। আর ২০১০ সালের শুরুতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিল তিন টাকা ৯২ পয়সা। বর্তমানে তা আট টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮২ দশমিক ৭০ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২১ দশমিক ১৮ শতাংশ। যদিও বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে বাল্ক মূল্যহার ছয় টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তবে বর্তমানে গড় উৎপাদন ব্যয় ১০ টাকার বেশি। এতে বাল্ক মূল্যহার কমপক্ষে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হলে তা উৎপাদন ব্যয়ের সমান হবে। তবে বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধি করলে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। গত অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে তিন ধাপে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। যদিও বাল্ক মূল্যহার দুই ধাপে ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।

বাল্ক মূল্যহার বেশি বাড়ানোয় বিতরণকারী চারটি কোম্পানিই লোকসান করেছে। অপর বিতরণকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের লোকসানও একই কারণে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য বিতরণকারী কোম্পানি ও সংস্থা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য বারবার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে আগামীতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ধরনের কিছুটা পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ধনী ও দরিদ্রদের জন্য দুই সøটে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের নির্দেশনা দিয়েছেন।

গত ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তার অর্ধেকেরও কম টাকা বিল দেয়া হয়। এজন্য দুটো সøট আলাদা করতে বলেছি। স্বল্প আয়ের জন্যÑতাদের জন্য এক রকম আর যারা খুব বড়লোক, অনেক বেশি এয়ারকন্ডিশন, লিফট এটা-সেটা ব্যবহার করে, তাদের জন্য মূল্যটা একটু উচ্চ করে দেব। সেভাবে দুটা সøট করে দেব। সেই ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছি ইতিমধ্যেই।’

এদিকে ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি তুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে পিডিবির। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে একাধিক বৈঠকে এ ধরনের প্রস্তাব করা হয়। সেখানে জানানো হয়, ছোট পরিবার ও সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ২০০ মেগাওয়াটের মধ্যেই থাকে। এদের ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ দেয়া যেতে পারে। তবে যেসব বাসায় এসি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার অনেক বেশি হয়। তাই তাদের ভর্তুকি দেয়ার কোনো মানেই হয় না। এ ধরনের গ্রাহকদের থেকে উৎপাদন মূল্যে বিল আদায় করা উচিত।