- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ২১:৪১

দেশে চলছে ভয়াবহ তাপদাহ। জনদুর্ভোগ চরমে। ঘন ঘন লোডশেডিং জনজীবন অতিষ্ঠ। এর মধ্যেই একের পর এক মার্কেটে আগুনের লেলিহান শিখা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ। কিছুক্ষণ আগে যে ব্যক্তি কোটি টাকার মালিক ছিলেন, মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা তাকে পথের ফকির বানিয়ে দিচ্ছে। কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে এক রাতের ব্যবধানে হয়ে যাচ্ছেন ফুটপাথের ব্যবসায়ী। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এক মার্কেটের পোড়া গন্ধ শেষ হতে না হতে আরেকটি বড় মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রহস্য। রহস্য একটি জায়গায় ঘনীভূত হচ্ছে, বড় দু’টি মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত প্রায় একই সময়ে। ভোর বেলা। রমজান মাসের এ সময়ে বেশির ভাগ মানুষ ঘুমে থাকেন। নীরব থাকে রাজধানীর পথঘাট। এই সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সিটি করপোরেশনের বহুতল ভবন নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে আছে প্রশ্ন। প্রশ্ন রয়েছে নিউ সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও সিটি করপোরেশনের ফুটওভার ব্রিজ ভাঙার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে।
অগ্নিকাণ্ড কিভাবে ঘটেছে সেটি তদন্তের বিষয়। কিন্তু মোটা দাগে বলা যায়, এ দুটি মার্কেটে আগুন ধরার পেছনে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন নির্মাণের স্বপ্ন সিটি করপোরেশনের ছিল এটি তো তাদের বিবৃতিতেও প্রমাণিত। মার্কেটের কাউকে অবহিত না করে নিউ মার্কেটের ফুটওভার ব্রিজ কেন এত ভোরে ভাঙতে গেল তা কিন্তু রহস্যমুক্ত নয়।
হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন যখন আগুনের তপ্তদাহে পুড়ছে সরকার সেই দিকে দৃষ্টি না দিয়ে এ আগুনের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা খোঁজার কাজে ব্যতিব্যস্ত। অথচ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ‘সাহরির সময় সিটি করপোরেশন থেকে একটি টিম নিউ সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিশে ভাঙতে আসেন। নিরাপত্তা রক্ষীরা সিটি করপোরেশনের লোকদের নিষেধ করেছিলেন। ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা শোনেননি। শেষমেশ নিরাপত্তা কর্মীরা অন্তত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার কথা বলেন। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ব্রিজের সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে মার্কেটের তিন তলায় বিকট শব্দ হয়ে আগুন লেগে যায়। মূলত শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। ব্রিজের সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে এ শর্ট সার্কিট হয়। চার দিকে শুধু কাপড়ের দোকান। ওয়েল্ডিংয়ের আগুন মার্কেটে প্রবেশ করে আগুন লেগেছে। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট বণিক সমিতির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, সিটি করপোরেশন নিয়ম মেনে ব্রিজ ভাঙেনি। বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ না করার কারণে আগুন লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। নিউ সুপার মার্কেটের ইলেকট্রিশিয়ান বলেন, সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে আমি ভোর বেলা ব্রিজ ভাঙার খবর পেয়েছি। আমাকে ফোন করে সে বলে মার্কেটের পূর্ব পাশের ওভারব্রিজ ভাঙতে আসছে। ওখানে ইলেকট্রিক লাইন আছে ভেবে আমি দ্রুত সেখানে চলে যাই। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর আগে মার্কেটে আগুন লেগে যায়। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের রমজান মাসে সিটি করপোরেশন ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। এরপর এক বছর চলে গেল। তারা কোনো উদ্যোগ নিলো না। আর এখন ঈদের সময় নিউমার্কেট এলাকা কত ব্যস্ত। এখন তাদের ব্রিজ ভাঙতে হবে কেন? মালিক সমিতির সভাপতি মো: শহিদুল্লাহ বলেন, রাত ৩টার দিকে করপোরেশনের লোকেরা যখন ব্রিজ ভাঙতে আসে তখন তারা সেখানে ইলেকট্রিক লাইন আছে সেটি খেয়াল করেনি। তাই ব্রিজ ভাঙার সময় শক্তিশালী কিছু ব্যবহার করতে গিয়ে শর্ট সার্কিট হয়। পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ ভাঙতে গিয়ে আগুন লেগেছে। এ দিকে ব্যবসায়ীদের দাবির কয়েক ঘণ্টা পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক বিবৃতিতে বলেছে, আগুনের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কাজের সম্পর্ক নেই। কিন্তু পর পর দুটি মার্কেটে ভোর বেলা অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা’ (১৬ এপ্রিল, ২০২৩, মানবজমিন)।
সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন। এক মাসের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিসংযোগ নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো ষড়যন্ত্র। এ দেশের মানুষ যখন সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে রাজপথে আন্দোলনমুখী হচ্ছেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিচ্ছে; ঠিক তখন একটার পর একটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বিরোধী দলগুলোর মতে, চলমান আন্দোলন থেকে জনদৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতে ক্ষমতাসীনরা মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে।’ খোদ সরকার প্রধানও বিরোধী দলের দিকে আঙুল তুলে বলছেন, এ অগ্নিসংযোগের সাথে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। যেকোনো ঘটনা ঘটলে আগে তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের আগে যখন খোদ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো একটি বিশেষ মহলের দিকে ইঙ্গিত করে কথা বলা হয়; তখন তার তদন্ত রিপোর্ট কী হতে পারে তা সবারই জানা। তবে সর্বসাধারণের ধারণা সরকার মূল ঘটনা আড়াল করার অপচেষ্টা হিসেবে কৌশল করে বিরোধী রাজনীতির ঘাড়ে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করছে যাতে জনগণ সরকারের দিকে আঙুল তুলতে না পারে।
কিন্তু সরকারের এ আচরণ ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’ প্রবাদটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কথিত আছে, জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সর্বশেষ রোমান সম্রাট নিরো যিনি হত্যা, রক্তপাতকে খুব পছন্দ করতেন। অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সম্রাট নিরো। এমনকি ক্ষমতার জন্য নিজের মাকেও হত্যা করেন তিনি। বিষ খাইয়ে মেরেছেন সৎভাই ব্রিটানিকাসকে। এমন একজন শাসকের শাসনামলে ৬৪ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের ১৯ জুলাই রোম শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এটি ছিল রোমের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অগ্নিকাণ্ড। ছয় দিন ধরে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। রোমের ১৪ জেলার ১০টি আগুনে পুড়ে যায়। রোমবাসীর ধারণা, এ অগ্নিকাণ্ড সম্রাট নিরো নিজে ঘটিয়ে ছিলেন। কারণ ধ্বংসস্তূপের জায়গায় তিনি তার অবিস্মরণীয় স্থাপত্যকর্ম ‘ডোমাস অরিয়া’ বা স্বর্ণগৃহ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এ ধারণা আরো সত্য প্রতীয়মান হয়, যখন দেখা যায় যে অগ্নিকাণ্ডের পর ধ্বংসস্তূপে নিরো তার স্থাপত্যকর্ম তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এর জন্য তার প্রচুর অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। ফলে তিনি কর বাড়িয়ে দেন। মন্দিরগুলো থেকে অর্থ তুলতে শুরু করেন। অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেন। তা ছাড়া ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন তার প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন।
কিন্তু নিরো তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে খিষ্টানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, খ্রিষ্টানরা এ আগুন লাগিয়েছিল। এটি তিনি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। ওই সময়ে রোমে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ছিল খুব কম। তারা ছিল প্রান্তিক এবং অজনপ্রিয়। বলা হয়, শহরে আগুন দেয়ার শাস্তি হিসেবে খ্রিষ্টানদের অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন নিরো। তাদের ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, বন্য জন্তু দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয় এবং তাদের শরীরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এখানেই শেষ নয়, এসব শাস্তি দেয়ার সময় উৎসবও করা হতো। লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হতো এসব প্রত্যক্ষ করার জন্য।’ তাই অগ্নি সংযোগের ঘটনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি না করে এর প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি মাঠের আন্দোলনে সফল ছিল কিন্তু তাদের সেই সফলতার গায়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল বিএনপির আন্দোলনের সময় এটা সত্য। কিন্তু সেই আগুন কারা লাগিয়ে ছিল তাও কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিএনপির ব্যর্থতা ছিল সেই অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতে না পারা। এখনো বিএনপি আন্দোলন করছে কিন্তু হরতাল, অবরোধ না দেয়ায় গাড়িতে আগুন ধরানোর স্বপ্ন অধরাতে থাকায় এহেন কাণ্ড ঘটাচ্ছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
বাজারে পণ্যদ্রব্যের গায়ে আগুন। মার্কেটে কাপড়-চোপড়ের দামে আগুন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামে আগুন। দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের পেটে ক্ষুধার আগুন। সর্বত্র শুধু আগুন আর আগুন। এই আগুনের সাথে প্রতিদিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, মার্কেটে, বাজারে আগুন লেগে সব ছাই করে দিচ্ছে। সরকার কোনো আগুন সঠিক সময়ে নিভাতে পারছে না উপরন্তু সব কিছুতে বিরোধী রাজনীতির ত্রুটি খুঁজে তাদের বিরুদ্ধে হামলা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে প্রচার করে বেড়ায়। অনেক এমপি সংসদে গানের গলায় বলেন, আগামীতে নাকি সরকার মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হকারি করে বলবে, বিদ্যুৎ লাগবে গো বিদ্যুৎ? কিন্তু বাস্তবতা হলো, সারা দেশে গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এখন জনগণ সরকারকে জিজ্ঞেস করছে, সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা গেল কোথায়? সরকার কিছু মেগা উন্নয়নের নামে জনগণকে বোকা বানিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু জনগণ আজ জানতে চাইছে, ২২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম হলে কেন ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে? কেন বাকি ৭ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন না করে বছরে ১৫-১৮ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ জনগণের পকেট থেকে নেয়া হচ্ছে ? জনগণের টাকার এ অপচয় কেন? আসলে সবই হচ্ছে ধোঁকাবাজির খেল।
সরকার জনগণের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে সব কিছুতে মুখ বন্ধ রাখতে চাইছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? জনগণ চায় মুক্তি। নেভাতে চায় বাজারের আগুন, নিবারণ করতে চায় পেটের ক্ষুধা। তারা আর আগুন নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা চায় না, আগুনের লেলিহান শিখা তাদের সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই করে দিক। জনগণ চায় এই আগুনের খেলা বন্ধ হোক। তারা চায় প্রকৃত ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।