তিলকে তাল করার গল্প

  • ড. আবদুল লতিফ মাসুম
  •  ২৪ মে ২০২৩, ২০:২৫
তিলকে তাল করার গল্প। –

রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে সদা ক্ষুব্ধ এক প্রতিবেশী প্রায়ই আমার ওপর চড়াও হন। তার এসব প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত ও উত্ত্যক্ত হই। কেন আদার কেজি ৫০০ টাকা? কেন ওয়াসার চেয়ারম্যান সত্য কথা বলতে গিয়ে হারাবে তার পদ? কেন মন্ত্রীর পরিবারের পকেটে ঢুকবে শত কোটি টাকা? এমনভাবে তিনি জবাবদিহির ভাষায় প্রশ্ন করেন, এর জন্য আমিই যেন অনেকটা দায়ী। আমিই যেন সরকারের একটি অংশ।

তিনি ভালো করেই জানেন, আমি সরকারের কেউ নই। আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯তম সদস্য দাবি করতে পারেন যিনি, তিনিই সরকার। সেরকম পদ-পদবি আমার নেই। তবুও তিনি রাগ ঝাড়েন আমার ওপর। আমি তাকে মনে করিয়ে দেই- দেয়ালেরও কান আছে। সরকার ও সরকারি দলের বিরুদ্ধে এরকম রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ ঝাড়লে তার ওপর খড়গ আসতে পারে। সহজ-সরল এই মানুষটি সত্যিই ভয় পেয়ে যান। মনে পড়ে, আসলেই আমরা ভয়ের রাজত্বে বসবাস করছি। অথচ স্বাধীনতার অর্থ ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের ভাষায়- ‘Freedom from fear’। যাই হোক, এই তিনিই সে দিন সন্ধ্যায় জানালেন, বিএনপি নাকি আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, কে সেই অধম যে এমন অন্যায় ও অস্বাভাবিক উক্তি করতে পারে। তিনি বললেন, শীর্ষস্থানীয় কেউ। খন্দকার মোশাররফ না হয় মির্জা আলমগীর! আমি বললাম, তা হতেই পারে না। তাদের উচ্চমর্যাদা, পদ ও ব্যক্তিত্ব- এই মন্তব্য করার মতো উপযুক্ত নয়। তাহলে কে? দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির অতি উগ্র কেউ? খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। খোঁজ পড়ে গেল সব জায়গায়। অবশেষে জানা গেল, তিনি হচ্ছেন জেলা পর্যায়ের নাম নেহাত এক নেতা। সে নাম নেহাত হোক তাই বলে কি এ কথা সে বলতে পারে? সুস্থ শরীরে স্বাভাবিকভাবে? আসলে সে কি বলেছিল জানতে চেষ্টা করি আমরা। ক্ষুব্ধ প্রতিবেশী সাফাই গাইলেন তার পক্ষে। রাগ-দুঃখ-ক্ষোভে মানুষ কত কী বলে! মা সন্তানকে বলে না? ছেলে বাবাকে বলে না? আর এগুলো তো রাজনীতির ভাষা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো এমনই। আমি বললাম, তাই বলে তো তিনি হত্যার হুমকি দিতে পারেন না। পাশ থেকে বলে উঠল আমার এক ছাত্র ‘না! না! সে তো সরাসরি হত্যার হুমকি দেয়নি।’

তাহলে কি বলেছিল? প্রশ্ন করি। ওই ছাত্র দৈনিক পত্রিকা এনে আমাদের দেখায়, রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ গত শুক্রবার পুঠিয়ায় এক জনসভায় বলেছেন, ‘আমরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সব কিছু করব। কোনো ২৭ দফা ১০ দফা বুঝি না। এক দফা, একটিই দাবি- শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠানো (নিউএজ, ২৩ মে-২০২৩)।
আমার ওই ছাত্র তার ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলল, ভাষাটি ক্ষোভের। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি চাওয়া হয়েছে এখানে। কবরে পাঠানোর শব্দটি আসলে প্রতীকী অর্থে, হত্যার অর্থে নয়। আমি ছাত্রকে বললাম, তোমার বক্তব্যও সাফাইমূলক। তবে হ্যাঁ! ধরলে ধরা যায়, না ধরলে কিছু নয়। লিও টলস্টয় বলেছেন- ‘There is nothing good or bad in this world, but thingking make it so’. কঠিন করে দেখলে আসলেই তো ভালো-মন্দ সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। যে যেমন চিন্তা করে। ক্ষুব্ধ প্রতিবেশী অবশেষে বললেন, ‘আওয়ামী লীগ তিলকে তাল করেছে’।

গণতান্ত্রিক বিশ্বে নেতা-নেত্রীদের কত যে গালমন্দ শুনতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। এ সম্পর্কে মজার মজার কত গল্প আছে। গণতন্ত্রে সহনশীলতার বিকল্প নেই। আমাদের দেশেও বড় বড় রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে বড় বড় লেখা হতো। সেকালে আমাদের রাজনীতিবিদরা সবাইকে নিজ গুণে ক্ষমা করে দিতেন। সময় যতই অতিক্রান্ত হচ্ছে, সহনশীলতার মাত্রা ততই শূন্যে পৌঁছাচ্ছে। তিলকে তাল করার গল্প এর আগেও অসংখ্যবার ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক প্রধানমন্ত্রীর মৃদু সমালোচনা করেছিলেন। তার চাকরি গেছে, জেল হয়েছে। ওই একই কারণে বিদেশে তিনি ভালো আছেন। এ দেশে ১৪ বছরের কিশোরও গ্রেফতার হয়েছে তাকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য। হয়তো বা তিনি এসবের খবরও রাখেননি। তবে সেই যে কথা ‘রাজা যা বলে, পারিষদ বলে তার শতগুণ’। রাজশাহীর ঘটনায় দেখা গেছে- নায়কদের চেয়ে, খলনায়কদের অপতৎপরতা।

তিলকে তাল করা বাংলা ভাষায় একটি পরিচিত প্রবচন। সামান্য থেকে অসামান্যকরণকে এ ভাষায় প্রকাশ করা হয়। কোনো কিছুই না, অথচ একে অনেক বড় করে দেখাতে হবে। তখন সে বিষয়কে রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও উপসংহার টানা হয়। বাংলাদেশে এ মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিবেশে আন্দোলনরত বিএনপিকে ঠেঙ্গানোর জন্য একটি অজুহাতের প্রয়োজন ছিল। বিএনপিকে বারবার উসকে দেয়া সত্ত্বেও তারা জ্বালাও-পোড়াওয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে না। অপর দিকে, বিদেশের চাপ কতটা গভীর ও ব্যাপক তা নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলেই বোঝা যায়। পাবলিক বলাবলি করে- ‘হেতারা হাগল ওঁই গেছে’। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে তটস্থ তারা। আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান তীব্রতায় শঙ্কিত তারা। চলমান আন্দোলনকে তারা মনে করেছিল রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। এখন হিসাব-নিকাশ মিলছে না। তাদের ভাষায়- রাজপথের অশান্ত আন্দোলনকে শান্তির মিছিল দিয়ে অনুসরণ করবে তারা। এখন হঠাৎই প্রতিরোধের ঘোষণা। এখন তারা প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে প্ররোচিত করছে বিএনপিকে। উদ্দেশ্য- সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা।

তখন তারা নিজেরা নিজেদের ঘরে আগুন দিয়ে নালিশ দেবে প্রভুদের কাছে। নির্বাচনের কয়েক মাস বাকি থাকতে আওয়ামী লীগের এই প্রতিরোধ কৌশল পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক। মফস্বলের অখ্যাত এক নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসাবধানতাবশত বক্তব্যের রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাচ্ছে তারা। গ্রামে বলে- ‘কেউ দিয়েছে গুঁতো, পেয়েছে এক ছুতো’। আওয়ামী লীগের এই আকস্মিক আন্দোলন সম্পর্কে এ কথাটি বলা যায়। উল্লেখ্য, গত ২১ মে ঢাকায় এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এখন থেকে শান্তি-সমাবেশ নয়, সারা দেশে বিএনপিকে প্রতিরোধ করতে হবে।’ এ ধরনের অবস্থান নেয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে রাজশাহীর সেই অখ্যাত বিএনপি নেতার উক্তিকে বিখ্যাত করতে চাইছেন তিনি। তিনি বরাবরের মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। বিএনপির আন্দোলন যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হয়ে একদফার আন্দোলনে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখনই এই প্রতিরোধের ঘোষণাটি এলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী কোরবানির ছুটির পর বিরোধী দল সূচিত আন্দোলন বহুমুখী ও সর্বাত্মক আকার ধারণ করবে। সব বিরোধী দল আরো ঘনিষ্ঠভাবে, আরো শক্তভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবে। সরকারি কৌশল আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠার আগেই একে নস্যাৎ করে দিতে হবে। এটি স্পষ্ট যে, জেলাপর্যায়ের এক নেতার অনাহুত বক্তব্যকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দমননীতিকে জায়েজ করতে চাইছে।

মশা মারতে যেমন কামান দাগার গল্প আছে, ঠিক তেমনি ওই নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যকে সম্বল করে সারা দেশে একটি তাণ্ডব সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তারা। ক. আওয়ামী লীগ দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের আহ্বায়ক জানিয়েছেন। খ. একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পার্টি সেক্রেটারি আওয়ামী লীগ ও তার সব অঙ্গ সংগঠনকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে কর্মসূচি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। গ. ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে শহর-বন্দর-গ্রামে ও উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হামলা, মামলা ও হয়রানির খবর আসছে। ঘ. ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বড় বড় সভা-সমাবেশ করেছে। ঙ. যুবলীগ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুরূপ সভা-সমাবেশ করেছে। সারা দেশের শাখাগুলোকে আন্দোলনের আয়োজন করার নির্দেশ দিয়েছে। চ. বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতিটি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সভার নামে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ছ. এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষক সমিতির মতো পেশাজীবী সংগঠন উত্তেজনা প্রশমনের পরিবর্তে নিরপেক্ষতা অতিক্রম করে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়েছে। জ. হাইকোর্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন- কথিত হুমকিদাতার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা অবহিত করার জন্য। ঝ. এ দিকে দেশের ২৩ জন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হুমকির ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সদাসতর্ক থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। ঞ. অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজশাহীর পুঠিয়া থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে এ মামলাটি করা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বাদি হয়ে মামলাটি করেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিশোধস্পৃহা লোকেরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করেছে।

রাজনীতিতে এ ধরনের হত্যার হুমকি গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো হত্যা বা হত্যার হুমকি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দার্হ। রাজনীতির মোকাবেলা রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। রক্তপাত কেবল রক্তপাতই ডেকে আনে। শত্রুতা শত্রুতার সৃষ্টি করে। আর রাজনীতি কখনোই শত্রুতার বিষয় নয়। বিরোধিতা মানে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কখনোই প্রতিরোধ নয়। সবাই জানি, ‘Every action has its equal and opposite reaction’। ‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ’। সুতরাং শান্তির বদলে অশান্তি নয়, প্রীতির বদলে প্রতিরোধ নয়, তিলকে তাল করা নয়। সহনশীলতা, সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মধ্যে রাজনীতির বিচরণ চাই। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের আদর্শলিপি পাঠের আহ্বান জানাই : ‘ক. কটুবাক্য কহা অনুচিত; খ. খলের বাক্য না করিবে বিশ্বাস; গ. গর্ব করা ভালো নয়।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]