আক্রমণের শিকার ছাত্রদল-ছাত্র অধিকার পরিষদ:L ঢাবিতে ৩৮ হামলা, বিচার হয়নি একটিরও

logo

মরিয়ম চম্পা

৯ অক্টোবর ২০২২, রবিবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৮ বার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় ঘুরেফিরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম এলেও কোনো হামলার ঘটনায় মামলা কিংবা  অভিযোগ নেয়নি পুলিশ। উল্টো হামলার শিকার নেতাকর্মীরাই মামলার আসামি হয়েছেন।  ২০১৯ সাল থেকে গত ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর  বিভিন্ন সময়ে ১০ থেকে ১২ বার হামলা হয়েছে। এই সময়ে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কয়েকটি। চলতি বছরের মে এবং সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের উপর দুটি বড় হামলার ঘটনা ঘটে।  হামলার ছবি-ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ-ছাত্রদল পাল্টাপাল্টি ৩টি মামলা করে শাহবাগ থানায়। মামলায় অজ্ঞাত ৪০০ জন এবং ছাত্রদলের ৫০ থেকে ৬০ জন এবং ছাত্রলীগের ৩২ জনকে আসামি করা হয়। এর আগে হামলার ঘটনায় তারা বিভিন্ন সময় শাহবাগ, নিউমার্কেট, রমনা, মতিঝিলসহ একাধিক থানায় অভিযোগ করতে গেলেও অভিযোগ নেয়নি পুলিশ।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর পর থেকে ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর ২৬ বার হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। 

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে মোট ৩২টি মামলা চলমান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলা নিষ্পত্তির পথে রয়েছে।  গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।  ছাত্রদল নেতাকর্মীরা ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এতে সংগঠনের ১০ নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছাত্রদলের অভিযোগ, ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তবে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এই হামলার ঘটনাকে ছাত্রদলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।  গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় আবরার ফাহাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলার পর সংগঠনটির ২৪ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ২টি মামলা করেন ছাত্রলীগের ২ নেতা। মামলায় ২৪ জন নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।  ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে গেলেও তা আমলে নেয়নি প্রশাসন। মে মাসে তাদের ওপর হওয়া হামলার ঘটনায় প্রথমে থানায় অভিযোগ করলে তা পুলিশ আমলে নেয়নি।

এরপর ছাত্রদল নেত্রী মানসুরা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি পরবর্তীতে আদালত নথিভুক্ত করলেও মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে বাদী সূত্র। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। মামলার পর উল্টো বাদীসহ ছাত্রদলের অন্য নেতাকর্মীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ, ক্লাস-পরীক্ষা থেকে শুরু করে কোনো কার্যক্রমই স্বাভাবিকভাবে করতে পারছে না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী মানসুরা জানান, মামলাটি আদালত আমলে নিলেও আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। উল্টো এই ছাত্রদলকর্মী বিভিন্নভাবে চাপের মধ্যে রয়েছেন বলে জানান। মামলার পর যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাড়িওয়ালাকে বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। পরে বাড়ির মালিক বাসা ছাড়ার নোটিশ দেন। এরপর বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে একপর্যায়ে সংগঠনের বিষয়টি গোপন রেখে বাসা ভাড়া নেন।  এ বিষয়ে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল মানবজমিনকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টির মতো হামলা করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এবং একশ’র মতো মামলা চলমান রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই ছাত্রলীগ এবং পুলিশ বাদী হয়ে করেছে। যেখানে প্রায় ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আমার নিজের নামেই ৭টি মামলা চলমান।

গত মে মাসে হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের ৩৩ নেতাকর্মী ও ছাত্রলীগের অজ্ঞাত ১০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মারধর, হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। এই মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। চিহ্নিত ছাত্রলীগ কর্র্মীদের গ্রেপ্তার কিংবা দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।  সর্বশেষ হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে তারা শুধুমাত্র ছাত্রলীগের অভিভাবক। এবং তারা সরকার ও ছাত্রলীগের পৃষ্টপোষক।     গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ও ডাকসু’র সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ২৬বার আমাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা হয়েছে। কোটা সংস্কার হামলা থেকে শুরু করে বেশকিছু মামলায় আমাদের হাজিরা দিতে হচ্ছে। ২৫০ জনকে আসামি করে হওয়া মামলাগুলো চলমান রয়েছে। অধিকাংশ হামলার ঘটনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঘটিয়েছেন। গত শুক্রবার হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় আমাদের আহত ২৪ জন নেতাকর্মীদের আসামি করে দুটি মামলা করে ছাত্রলীগ। এরপর আমরা স্বেচ্ছায় কারাবরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আদালতে গেলে আদালতের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলে আসি। আমাদের নেতাকর্মীদের জামিন না দেয়ায় আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে লড়াই চালিয়ে যাবো। মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধুমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনের হওয়া একটি মামলার চার্জশিট প্রদান করেছে। বাকি মামলাগুলো পেন্ডিং রেখে আমাদের হয়রানি করার জন্য মামলাগুলো জমিয়ে রাখা হচ্ছে।

গণঅধিকার পরিষদের নেতা ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ছাত্রলীগ আমাদের ওপর বিভিন্ন সময়ে ২৬বার হামলা করেছে। আমার বিরুদ্ধে হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ডাকসু’র হামলার পরে নুর এবং আমার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ একই আইনে একটি মামলা করে। এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ভিসি’র বাসায় ভাঙচুর এর অভিযোগ এনে আমাকে একমাত্র আসামি করে একটি মামলা করা হয়। আমাদের বিরুদ্ধে মোট ৩২টি মামলা হয়েছে।  এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, শুক্রবার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় একজন ছাত্রলীগ নেতার দাঁত ভেঙে পড়ে গেছে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাজে বাধা প্রদানসহ ছাত্রঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অভিযোগ এনে মোট দুটি মামলা করেছে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় ২৪ জন ছাত্রঅধিকার নেতাকে গ্রেপ্তার শেষে আদালত কারাগারে পাঠিয়েছে। এর আগে ছাত্রদল নেতাকর্মীদেরও ওপর হওয়া মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি থানায় সম্প্রতি যোগদান করেছি। কাজেই পুরোনো মামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত জানা নেই।

এসব মামলা তদান্তাধীন রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।   ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম মামলার বিষয়ে বলেন, এসব মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বলা যাবে কোনটির অ্যাকশন হয়েছে কোনটির হয়নি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রাব্বানীকে এ ঘটনায় একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতিবেদন পেলে পরবর্তীতে আমরা বুঝবো আমাদের করণীয় কী আছে। শাহবাগ থানায় ছাত্র অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী ঢাবি’র কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন বলেন, ছাত্র অধিকার পরিষদের কমর্সূচির সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম আবরার ফাহাদের হত্যার সুষ্ঠু বিচার হয়েছে মর্মে তাদের কর্মসূচি বন্ধ রাখতে বললে ছাত্র অধিকার প্রক্টরিয়াল টিমের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আমরা প্রোক্টরিয়াল টিমকে সহয়তা করতে গেলে আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মী এবং ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীর ওপর তারা হামলা করলে আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে মামলা করি।