- গোলাম মাওলা রনি
- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
২০০৯ সালের ঘটনা। ভারতের দার্জিলিং থেকে উত্তরবঙ্গের স্থলবন্দর হয়ে ফিরছিলাম ঢাকায়। জনৈক সরকারি কর্তার নিমন্ত্রণে নাটোরে এক রাতের জন্য যাত্রাবিরতি করলাম। খবর পেয়ে পূর্বপরিচিত আরেক কর্তা, যিনি উপজেলা নির্বাহী প্রধান হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। আমি তার মহাব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি অত্যন্ত পুলকিতচিত্তে মুখে রাজ্যের বিরক্তি আর অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘স্যার আর পারছি না, স্থানীয় এমপি মহোদয় পুলাপান মানুষ। রাজনীতি বোঝেন না। তাকে সারাক্ষণ বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়া ছাড়াও স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং নেতাকর্মীদের সব আবদার মোকাবেলা করে তাদের এমপি সাহেবের পক্ষে রাখার জন্য দিন-রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়।’ আমি ইউএনওর কথার উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, আপনি তো নিজে জীবনে রাজনীতি করেননি। তো এখন কিভাবে রাজনীতির তাত্ত্বিক গুরু হলেন এবং একজন সংসদ সদস্যের অলিখিত অভিভাবকে পরিণত হলেন।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান, ব্রিটেনের প্রয়াত রানীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ ও আরো বহুবিধ কর্মজনিত কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন রয়েছেন বটে, প্রায় পৌনে দুই শ’ সফরসঙ্গী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বিরাট একটি বিমান ভাড়া করে ১৮ দিনের লম্বা সফরে দেশ ত্যাগ করেছেন। তার অনুপস্থিতিতে দেশের সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অনবরত গোলাগুলি করে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে চলেছে। তার সোনার ছেলের দল এবং স্বর্ণালি কন্যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইডেন কলেজে আওয়ামী লীগের ভাবমর্যাদার দফারফার জন্য নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, যা দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হচ্ছে এবং আওয়ামী ক্ষমতা চরিত্র ও প্রকৃতির একটি নবরূপ উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি নয়া ভাবমর্যাদা সৃষ্টি হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের কী গুরুত্ব বা এখানে বক্তৃতা দিলে কী উপকার হয় তা গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে বিশ্ববাসী বুঝতে পারেনি। এ কারণে ইদানীংকালে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে থাকেন। এবারের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদি যাননি। জার্মানির চ্যান্সেলর গিয়েছিলেন মাত্র দশ ঘণ্টার জন্য। তিনি সাধারণ বাণিজ্যিক ফ্লাইটে সম্পূর্ণ একাকী গিয়েছিলেন এবং তার ব্যাগটি বহন করার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। এমতাবস্থায় মিসেস হাসিনা ওয়াজেদের জাতিসঙ্ঘ যাত্রা নিয়ে বিবেকসম্পন্ন লোকজনেরা সমালোচনা না করে পারছেন না। অধিকন্তু দেশের সীমান্তে যখন যুদ্ধাবস্থা যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিবসহ ২০১৮ সালের সেই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃতকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা কিভাবে ১৮ দিন দেশের বাইরে থাকতে পারেন এবং তার এই দীর্ঘ প্রবাসযাত্রার সাথে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কতটা নির্ভর করছে তা আজ বলার চেষ্টা করব।
চাঁদের দেশের ভারসাম্যহীন পরিবেশের আদলে আমাদের সমাজে যেকোনো পিয়ন কোটিপতি হয়ে বড় কর্তার গালে চড় বসিয়ে কর্তার স্ত্রীর সাথে সখ্য গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবর্তে চা-ছমুচা-সিংগারা নিয়ে গর্ব হতে পারে অথবা মারামারী অশ্লীলতা অবিচার ব্যভিচারের সূতিকাগার হয়ে যেতে পারে। চকিদার চোর হয়ে কেবল চুরিচামারি নয় গৃহের মালিকও হয়ে যেতে পারে। বিদ্যাহীনেরা বিদ্যার শিক্ষক, নীতিভ্রষ্টরা ন্যায়নীতির প্রশিক্ষক এবং শক্তিহীনেরা শক্তির আধাররূপে সমাজ কর্তৃক পূজিত হতে পারে। আইন অঙ্গুলি হেলনে বদলে যেতে পারে এবং বিচারপ্রার্থী ও বিচারক বিচারের পরিণতি সম্পর্কে কোনো কিছু নাও জানতে পারেন। অন্যায়কারীর সাহস বৃদ্ধি এবং সৎ মানুষের আতঙ্ক চান্দের দেশের ভারসাম্যহীন পরিবেশে অহরহ ঘটতে পারে।
সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে। পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমঝোতায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। একধরনের শূন্যতা, অনিশ্চয়তা এবং অন্ধকারের হাতছানিতে তাদের অন্তরে হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাদের দৈনন্দিন কর্মে এখন কোনো ধারাবাহিকতা নেই এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মনোবলও নেই। সবাই অর্জিত অর্থের নিরাপদ সংরক্ষণ এবং পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে দিনের একটা সময় খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। ফলে পুরো আওয়ামী সমাজ সংসার ও রাজ্যে ত্রিমাত্রিক অভিনব রসায়ন সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত, যারা দু’হাতে টাকা-পয়সা লুটপাট করেছে এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে তারা এখন দেশ কাল দল সব বাদ দিয়ে অর্জিত অর্থের মোহজনিত শোকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। যারা পদ-পদবি ও ক্ষমতা ভোগ করেছে বিশেষত আমলা কামলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তারাও অবসরজনিত কারণে অথবা ক্ষমতার রাধা চক্রে পড়ে পদ-পদবি বঞ্চিত হয়ে আওয়ামীবিদ্বেষী হয়ে এক নব রূপ ধারণ করেছে।
দ্বিতীয়ত, বিকৃত বুদ্ধিজীবী, সুবিধাবাদী ও পোষ্য সুশীলরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলছে, ওরা পেয়েছে আমরা তো পাইনি। অন্য দল বলছে, কিছু পেয়েছি বটে তবে অপমানের পরিমাণটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এভাবে তো এই সমাজে বাস করা যাবে না। সুতরাং আবহাওয়া পরিবর্তনের আগেই নিজেকে বদলানোর যে বুদ্ধি তা এখন সুবিধাবাদী বৃদ্ধিজীবীদের নিদারুণভাবে ভোল পাল্টাতে প্রভাবিত করছে।
তৃতীয়ত, যেসব বিদেশী রাষ্ট্র, দেশীয় প্রভাবশালী চক্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা অতীতে শর্তহীন সহযোগিতা করেছে তারা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং কেউ কেউ কঠিন শর্তসাপেক্ষে নতুন সমঝোতা করতে চাচ্ছে, যা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
উল্লিখিত ত্রিমাত্রিক রসায়নের যোগফল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছে। ফলে অনাগত দিনের রাজনীতির পরিণতি তাদের জন্য এবং আওয়ামী লীগের জন্য কী ফলাফল ঘটাতে যাচ্ছে তা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আওয়ামী লীগের উদ্যম হ্রাস পাচ্ছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর উদ্যম জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। নিত্যকার পত্রিকার পাতা বিভিন্ন রকম গরম গরম খবরে ভরে যাচ্ছে এবং রাজপথ এবার সত্যিকার রাজনীতির সূতিকাগারে পরিণত হতে যাচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা বোধহয় আমার আর বলার দরকার হবে না- সম্মানিত পাঠক খুব সহজেই সার্বিক অবস্থা আন্দাজ করে নিতে পারবেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য