আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কী ফুল ফোটাল

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, শত ফুল ফুটবে। আওয়ামী লীগের আরেক ক্ষমতাধর নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছিলেন, অনেক ফুল ফুটবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ফুলই ফুটল না এক ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ছাড়া।

এর মধ্যে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন আরেক কথা। তিনি ফুল ফোটানোর পদ্ধতি ‘ফাঁস’ করে দিয়েছেন। বিএনপির সব নেতা-কর্মীকে এক রাতের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ‘টোপ’ দিয়েও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারেনি সরকার বলে তিনি জানিয়েছেন।

যা হোক, আওয়ামী লীগের এই তিন নেতার কথা শুনে আমরা ফুল ফোটানোর বিশদ রহস্য জানতে পারলাম। বুঝতে পারলাম, নানা কসরত করেও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত খুব বেশি ফুল ফোটাতে কেন পারল না? বলতে গেলে ফুল ফুটেছে কেবল একটি।

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর রাতারাতি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করছেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগ বিএনপির আর কোনো নেতাকে দলছাড়া করতে পারেনি।

তৃণমূল বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক নিয়ে কয়েক নেতা নির্বাচন করছেন বটে; কিন্তু তাঁরা কেউই বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নন। যেমন আইনজীবী তৈমুর আলম খন্দকারের কথাই বলাই যায়।

নারায়ণগঞ্জের এই বর্ষীয়ান নেতা খুব হইচই করে তৃণমূল বিএনপিতে গেলেন। ভোটের মাঠে তিনি খুব বেশি পরীক্ষিত নেতা নন। নারায়ণগঞ্জে কোনো ধরনের নির্বাচন করে জিতেছেন বলে জানা নেই।

শেষ পর্যন্ত এই তৈমুর আলম খন্দকারের মতো নেতাদের দিয়ে আওয়ামী লীগ ফুল ফুটাতে চেয়েছিল। তৈমুররাও চলে এলেন। কিন্তু তাঁদের রসায়নটা জমেনি তেমন। তাই তৈমুর আলমের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করবেন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।

তৈমুরের জিতে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? নেতা ও ব্যক্তি হিসেবে গোলাম দস্তগীর জনপ্রিয়। আর যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে, তাতে তৈমুরের আশা করার খুব সুযোগ আছে কি? নৌকা প্রতীকের বিপরীতে তিনি কতটুকু বা কী পাওয়ার আশা করেন!

আলোচিত হিরো আলম বার কয়েক সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস পেয়ে নির্বাচনে লড়ছিলেন। কিন্তু শেষটায় ভোটকেন্দ্র থেকে দৌড়ে পালিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে যে আরও কাউকে দৌড় দিতে হবে না, এর নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনী মাঠে নামার আগে হিরো আলমের মতো দৌড় দেওয়ার শক্তি হাঁটুতে আছে কি না, তা কিছু নেতাদের অন্তত ভেবে দেখা উচিত ছিল।

এই নেতারা আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে গিয়ে ফুল হয়ে ফোটার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ফুলের বাগানেই ঠাঁই হলো না। তাঁরা পথের পাশেই পড়ে রইলেন। তাদের মাড়িয়েই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জিতে আসবেন সম্ভবত।

তবে আওয়ামী লীগ তাঁদের আশ্বাস দিয়েছে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, তবে কি তারা আশা করেন যে আওয়ামী লীগের ভোটাররা নৌকা বাদ দিয়ে তাঁদের ভোট দেবেন!

জোর করে ফুল ফুটাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কিছু নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে অনেকেই বলে থাকেন, কিন্তু এই নেতারা রাজনীতিতে আর পুনর্বাসিত হতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ, দেশের রাজনীতি এখন পরিষ্কার দুভাবে বিভক্ত। এক পক্ষে আছে যেনতেন প্রকারে ভোটের পক্ষে। আরেক পক্ষ বলছে নাগরিকদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য আমলযোগ্য হলে বলতে হয়, যানবাহনে আগুন-ভাঙচুরের মামলাসহ বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলার তাহলে কোনো সারবত্তা নেই। এ ঘটনা প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আটক ও শাস্তি দিয়েছে।

কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের মুক্তির ঘটনায়। শাহজাহান ওমর নিউমার্কেট এলাকায় একটি বাস পোড়ানোর মামলায় আটক ছিলেন। কিন্তু রাতারাতি তাঁর জামিন ও মুক্তি হলেও একই মামলায় আটক অন্য বিএনপি নেতাদের জামিন হয়নি।

কৃষিমন্ত্রীর ভাষায়, ওই নেতারা রাজি হননি, তাই জামিন পাননি। আর শাহজাহান ওমর রাজি হয়েছেন, তাই মুক্তি পেয়েছেন।

পরিশেষে আওয়ামী লীগের এই ফুল ফোটানোর প্রক্রিয়ায় দুটি জিনিস সাব্যস্ত হলো। কিছু লোক নির্বাচন করতে গিয়ে এখন মাঝদরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। এমনিতেই রাজনীতিতে তাঁদের শক্ত অবস্থান ছিল না। এখন যদি দল কূল হারিয়ে নির্বাচনে গিয়ে জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়ে বা হারতে হয়, তবে বেশ বেকায়দায়ই পড়তে হবে তাঁদের।

আরেকটি হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের গণহারে আটক ও ইচ্ছেমতো মুক্তির টোপ দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের আইনের শাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    প্রথম আলো