আওয়ামী লীগে গণসংযোগ, বিএনপিতে ‘সক্রিয় হওয়ার’ বার্তা

আওয়ামী লীগে গণসংযোগ, বিএনপিতে ‘সক্রিয় হওয়ার’ বার্তা

এবারের ঈদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক বাস্তবতা বেশ ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এলাকায় ব্যস্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে। জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে ঈদকেন্দ্রিক গণসংযোগ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা এলাকায় গিয়ে জেলজুলুমে হতাশ হয়ে পড়া মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত ও ‘সক্রিয় হওয়ার’ বার্তা দিচ্ছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র চার মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দলীয় প্রতীক না দেওয়ায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থার এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি উপজেলায় দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ঈদ ঘিরে নিজেদের মতো করে গণসংযোগ করছেন।

অন্যদিকে সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে হতাশা ভর করেছে। রোজায় মাসব্যাপী গণ–ইফতারের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় ঈদের সময়েও নেতারা হতাশ হয়ে পড়া তৃণমূলের কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদে এবার নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ৮ মে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি ও দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে।

উপজেলার ভোটে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ

উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে এবারের ঈদকে বেছে নিয়েছেন। ঈদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রার্থিতার বিষয়টি জানান দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি দলের অনেক নেতা সদ্য বিদায়ী রমজান মাসে ইফতারসামগ্রী বিতরণ, ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ নিয়মিতভাবে নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় তাঁরা ঈদের দিনেও নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে ঈদের জামাতে অংশ নেওয়াসহ জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

কুষ্টিয়া জেলার খোকসা ও সদর উপজেলায় প্রথম ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই।

এবারের নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে লড়বেন আতাউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের সময় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ মেলে। সামনে নির্বাচন। ঈদের সময় হলেও দলের নেতা-কর্মীরা এখন নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত। তবে তাঁর নির্বাচনী এলাকা সদর উপজেলায় দলীয় কোন্দল নেই বলে দাবি করেন তিনি।

মাদারীপুরে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাচা-ভাতিজার লড়াইকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত। ঈদকেন্দ্রিক গণসংযোগেও দুই পক্ষের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মাদারীপুরের কেন্দ্রীয় পৌর ঈদগাহ মাঠে জেলার প্রধান জামাতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খান এবং সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান খান অংশ নেন।

সংসদ সদস্য শাজাহান খানের সঙ্গে ঈদের জামাতে অংশ নেন তাঁর ছেলে ও সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আসিবুর রহমান খান। নামাজ শেষে শাজাহান খান ও তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খান মুসল্লিদের সঙ্গে কোলাকুলির মাধ্যমে দোয়া, ভোট ও সমর্থন চান। একইভাবে শাজাহান খানের চাচাতো ভাই সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান খানও মুসল্লিদের কাছে ভোট চান।

মাদারীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীরা রোজার শুরু থেকেই মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন। ঈদের দিনেও তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। সদর উপজেলায় একই পরিবারে দুই প্রার্থী হলেও তাঁদের দুজনকে ঘিরে দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

কর্মীদের সক্রিয় করার চেষ্টায় বিএনপি

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের সময় সব নেতাই নিজের এলাকায় যান। ঈদ ধর্মীয় উৎসব হলেও গণসংযোগ হয়। নেতারা কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার কাজ করবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পরাজিত নই, যুদ্ধের ময়দানে আছি। জনগণ আমাদের পক্ষে আছে। চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে—নেতারা এবার এই বার্তা নিয়েই এলাকায় গেছেন।’

এবার রমজান মাসে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল বিএনপি। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পুরো রমজানে সব মহানগর, জেলা, উপজেলাসহ একবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ইফতার অনুষ্ঠান হয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, ইফতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি এবং তাঁদের সক্রিয় করা গেছে। বিগত আন্দোলনে গুম, খুন এবং অঙ্গহানির শিকার নেতা-কর্মীদের পরিবার ও স্বজনদের অর্থসহায়তা, ঈদসামগ্রীও দেওয়া হয়।

বিএনপির নেতারা বলছেন, রমজান মাসের ধারাবাহিকতা রাখতে এবার ঢাকায় ঈদ না করে নিজ নিজ এলাকায় যেতে দলের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে নিজ এলাকায় হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে বলা হয়েছে। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঈদ করার পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকৌশল ঠিক করার নির্দেশনা রয়েছে। ঈদকেন্দ্রিক কুশল বিনিময়ে ভবিষ্যৎ আন্দোলন কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়ে সচেষ্ট হতে বলছেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ ময়মনসিংহে নিজ এলাকায় গেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ দুঃসহ অবস্থায় রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী নেতা-কর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন নেতারা। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে নেতারা বার্তা দিচ্ছেন, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শেষ হয়নি। ঘুরে দাঁড়িয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটাতে নেতা-কর্মীদের সক্রিয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি জনগণকেও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে বলা হয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ভোট বর্জনের পর এখন উপজেলা নির্বাচনেও দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলটি আবারও সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে তৃণমূলকে সক্রিয় করতে চাইছে।

আর আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানো ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি তাদের তৃণমূলের বিভেদও দূর করতে চাইছে।

এখন বড় দুই দলের নেতারাই ঈদের সময়টা কাজে লাগিয়ে তাঁদের নিজ নিজ দলের লক্ষ্য অর্জনে তৃণমূলে তৎপর রয়েছেন।

prothom alo