আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিভেদ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ

অভ্যন্তরীণ বিভেদ কমাতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। কিন্তু এই কৌশলের কারণে দলের তৃণমূলে বিভেদ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনেকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব নিজেরাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যেসব জেলা ও উপজেলায় সংসদ সদস্য দলীয় সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন, সেখানে এই প্রবণতা বেশি।

চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মাদারীপুরসহ দেশের সাতটি জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১০ জন নেতার সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদে বক্তব্যে উঠে এসেছে, প্রার্থিতা নিয়ে দলে দ্বন্দ্ব-বিভেদ বাড়ছে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভেদ; অনেক জায়গায় সংসদ সদস্য ও তাঁদের পাল্টা পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ বিভেদ কমাতেই উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে এতে কতটা লাভ হবে, সেই প্রশ্নে এখন আলোচনা চলছে দলটিতে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা নিজেরাই যখন মনোনয়ন বোর্ডের ক্ষমতা নিচ্ছেন, তখন জাতীয় নির্বাচনে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা আরও প্রকট হবে।

আগামী ঈদুল ফিতরের পর মে মাসে চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে। যাঁরা প্রার্থী হতে আগ্রহী, তাঁরা এখন থেকেই পোস্টার টানানোর পাশাপাশি গণসংযোগে নেমেছেন। বিভিন্ন উপজেলায় যাঁরা মাঠে নেমেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। প্রার্থিতা নিয়ে দলটির তৃণমূলে দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে কোনো কোনো জায়গায়। গতকাল বুধবার কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য একজন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর গাড়ির বহরে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে আগামী ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। একই দিন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে এবং আরও কিছু পৌরসভারও ভোট হবে।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগ বর্ধিত সভা করে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে তাহসীন বাহারকে। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তিনি কুমিল্লা সিটি এলাকা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যও। কুমিল্লা মহানগর কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই বাহাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ।

তবে আওয়ামী লীগের কুমিল্লা মহানগর সহসভাপতি আঞ্জুম সুলতানার নেতৃত্বে আলাদা পক্ষ আছে। মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমানও (তানিম) প্রার্থী হয়েছেন। তবে সংসদ সদস্যের প্রভাবে তাহসীন স্থানীয়ভাবে দলের সহায়তা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছেন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার আওয়ামী লীগের কৌশলের ব্যাপারে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল যদি মনে করে কাউকে একক প্রার্থী করলে জয় পাওয়া সহজ হবে, সেটা তারা করতে পারে। তবে কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে না পারে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

সংসদ সদস্যদের পেছনে প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ

২০১৫ সালে আইন হওয়ার পর স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট শুরু হয়। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের দল থেকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করেছে।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, এখন সম্ভাব্য প্রার্থীরা স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পেছনে ছুটছেন। বলা যায়, এখন মনোনয়ন বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই চলে গেছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের হাতে।

দিনাজপুরে চতুর্থ ধাপে আগামী মে মাসের দিকে উপজেলা নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান। গত শনিবার সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত হয়।

বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, ফেনীসহ আরও কিছু জেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যরা একক প্রার্থী ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানতে পেরেছে।

‘স্বতন্ত্র কৌশলের’ প্রভাব

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করা নেতাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত ও জয়ী দুই নেতাই এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

প্রথম আলোর হিসাবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৮ জনকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল। দলের নেতা-সমর্থকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন ২৬৯ জন। এর মধ্যে ৫৮ জন জয়ী হয়েছেন।

সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক আ ম ম মিনহাজুর রহমান সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত নৌকার প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর পক্ষে থাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরীও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য তৎপর হয়েছেন।

একইভাবে বাঁশখালী ও পটিয়া উপজেলা পরিষদেও সংসদ নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে। বাঁশখালীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক সিকদার বর্তমান সংসদ সদস্য (স্বতন্ত্র) মুজিবুর রহমানের পক্ষে ছিলেন। তিনি উপজেলায় নির্বাচন করবেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর পক্ষে থাকা খোরশেদ আলমও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।

পটিয়ায় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলামের পক্ষে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তিমির বরণ চৌধুরীসহ কয়েকজন উপজেলায় ভোট করার তৎপরতা চালাচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর পক্ষে থাকা বর্তমান নারী ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগমও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে চান।

একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের সময় যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, এখন তাঁরা এসে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সমর্থন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন।

পরিবার-স্বজনদের প্রাধান্য, তৃণমূলের অনৈক্য

এবার দলীয় প্রতীক না থাকায় স্থানীয় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনের প্রার্থী হওয়ার প্রবণতাও বাড়বে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী বাছাই করলে কুমিল্লার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহারের মেয়ে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন না-ও পেতে পারতেন। কিন্তু উন্মুক্ত থাকার কারণে সংসদ সদস্য বাবা তাঁকে সামনে এনেছেন।

মাদারীপুর সদর উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান খান সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের ভাই। গত রোববার সদর উপজেলায় শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খানকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দলের নেতাদের ধারণা, এবার ভাইয়ের বদলে ছেলেকে সামনে আনবেন শাজাহান খান। অন্যদিকে শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান খানকে জেলা আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোথাও একক প্রার্থী করুক আর না করুক, এটা বলতে পারি যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’ সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা বাড়ল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার কী ক্ষমতা বাড়ল, এর চেয়ে বড় কথা গণতান্ত্রিক চর্চা আরও প্রসারিত হবে।

তবে দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অন্য একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের ভাইবোন ও শ্যালকের ছড়াছড়ি দেখা যেতে পারে। কারণ, অনেক উপজেলায় সংসদ সদস্যরা নিজ আত্মীয়দের স্বতন্ত্র প্রার্থী করতে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। এর ফলে তৃণমূলে বিভেদ বাড়বে বলেই মনে করছেন তিনি।

Prothom Alo