জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের কাজে এমনিতেই বেশির ভাগ সংসদ সদস্যের ভূমিকা হ্যাঁ–না ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমিত। গত দুটি সংসদে হাতে গোনা কয়েকজন সংসদ সদস্যকে বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিতে দেখা গেছে। এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সে সংখ্যা আরও কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর কারণ শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব। যেহেতু মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর বিল সংসদে ওঠে, তাই সরকারি দলের সদস্যরা এটি নিয়ে আলোচনা করতে চান না। বিল নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা, বিলে কোনো জনস্বার্থবিরোধী কিছু থাকলে তা নিয়ে কথা বলা—এগুলো মূলত বিরোধী দলের কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গত ৩০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। গত ৫ মার্চ দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। এই অধিবেশনে দুটি বিল পাস হয়েছে। এতে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে বিরোধী দলের চারজন এবং সরকারি দলের দুজন মিলিয়ে মোট ছয়জনকে বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব আনতে দেখা গেছে। ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাউকে বিলের ওপর কোনো প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নিতে দেখা যায়নি।
গত একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপি থাকা অবস্থায় ১২-১৩ জন এবং বিএনপি পদত্যাগ করার পর ৮-১০ জন সংসদ সদস্য বিলের ওপর বিভিন্ন প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নিতেন। তার আগে দশম সংসদে এই সংখ্যা ৯– ১০ জনে সীমাবদ্ধ ছিল।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনসহ জাতীয় সংসদে মোট ৩৫০টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টির আসন ১৩টি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আছেন ৬২ জন। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টির একজন করে সংসদ সদস্য আছেন। বাকিরা সবাই আওয়ামী লীগের।
অংশগ্রহণ নেই বিলের সংশোধনীতে
সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বিগত কয়েকটি সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা এই কাজে অংশ নেন না। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা যেসব সংশোধনী প্রস্তাব আনেন, সাধারণত সেগুলো গ্রহণ করা হয়। মূলত কোনো বিল পাস হওয়ার আগে যখন বিলের কোনো অংশে সরকার সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করে, তখন সরকারি দলের সদস্যদের কেউ কেউ সংশোধনী প্রস্তাব করে থাকেন।
অন্যদিকে বিরোধী দলের সদস্যদের আনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীগুলো গ্রহণ করেন না মন্ত্রীরা। যেগুলো গ্রহণ করা হয়, সেগুলো মূলত শব্দগত বা দাঁড়ি, কমা সংশোধন। এতে বিলের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না।
চলতি সংসদের প্রথম অধিবেশনে যে দুটি বিল পাস হয়, তার একটি হল বহুল আলোচিত ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) (সংশোধন) বিল’। এটি সংশোধন করে দ্রুত বিচার আইন স্থায়ী করা হয়। বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণ এবং সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন মোট তিনজন সদস্য। তাঁরা সবাই জাতীয় পার্টির। তাঁরা হলেন মুজিবুল হক, হাফিজ উদ্দীন আহম্মেদ ও মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী। অবশ্য তাঁদের কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। এর বাইরে সবার ভূমিকা ছিল হ্যাঁ–না ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
প্রথম অধিবেশনে পাস হওয়া দ্বিতীয় বিলটি হলো ‘অফশোর ব্যাংকিং বিল’। এই বিলে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। আর সরকারি দলের সংসদ সদস্য সেলিম মাহমুদ ও শফিকুল আলম চৌধুরী বিলে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সরকারি দলের সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল।
জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতাসহ সংসদে তাঁদের সদস্য আছেন মোট ১৩ জন। সাধারণত বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা বিলে সংশোধনী প্রস্তাব দেন না। অন্য সদস্যরা এটি করে থাকেন। এবার জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন প্রথমবারের মতো সংসদে এসেছেন। আগামী অধিবেশন থেকে বিল পাসের ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
মন্ত্রিসভায় একটি আইনের খসড়া অনুমোদন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তা জাতীয় সংসদে তোলেন। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, বিল সংসদে তোলার পর মন্ত্রী ইচ্ছা করলে তা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করতে পারেন। তবে সাধারণত বিল পরীক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন মন্ত্রীরা। মন্ত্রীর এই প্রস্তাবের ওপর সংসদ সদস্যরা ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেন।
আগ্রহ কম সংসদীয় কমিটিতেও
সংসদীয় কমিটিতে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরা বিল নিয়ে আলোচনা করেন। দেখা গেছে, তাতেও বেশির ভাগ সময় কমিটির ১০ সদস্যের সবাই অংশ নেন না। প্রথম অধিবেশনে পাস হওয়া দুটি বিলের মধ্যে দ্রুত বিচার–সংক্রান্ত বিলটি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছিল। ওই বৈঠকে কমিটির ১০ জন সদস্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৫ জন। আর অফশোর ব্যাংকিং বিল নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় ১০ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ছয়জন।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর সংসদে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণের প্রস্তাব করে থাকেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। এ পর্যায়েও বিলের ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করার সুযোগ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী একটি বিবৃতি দিয়ে থাকেন। মন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রস্তাব গ্রহণ বা নাকচের জন্য আবার ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে অংশ নেন সংসদ সদস্যরা।
পাস হওয়ার আগে বিলের কোনো দফা সংশোধন করা প্রয়োজন মনে করলে দফাওয়ারি সংশোধনী নোটিশ দিতে পারেন সংসদ সদস্যরা। আলোচনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী চাইলে সংশোধনী গ্রহণ করতে পারেন। এ পর্যায়ে আবারও ‘হ্যাঁ-না’ ভোট হয়। জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তির পর আবারও ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে বিলটি পাস হয়।
দীর্ঘ এই প্রক্রিয়ায় সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা হ্যাঁ, না ভোট দেওয়াতেই সীমিত থাকে। বিলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার কথা মূলত বিরোধী দলের।
সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এবার যেভাবে সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে আইন প্রণয়ন কাজে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কমবে। এর কারণ শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা। বিলে মূলত বিরোধী দলই সংশোধনী প্রস্তাব এনে থাকে বা বিলের মন্দ দিক থাকলে তার সমালোচনা করে থাকে। এবারের সংসদে বিরোধী দল সংখ্যায় ছোট। স্বতন্ত্র যাঁরা তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এ ছাড়া তিনি মনে করেন, যেহেতু কোনো বিল সংসদে আসার আগে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়ে আসে, তাই এটি নিয়ে সরকারি দলের সদস্যরা সমালোচনা করতে চান না।
prothom alo