আইএমএফের ঋণ রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২৬ অক্টোবর ২০২২, ২৩:৩৫
বাণিজ্য উদারীকরণের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। – ছবি : বিবিসি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বাংলাদেশ সরকার যে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে, ওই বিষয়ে আলোচনা করতে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল বুধবার বাংলাদেশে এসে কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে।

১০ সদস্যের এ প্রতিনিধি দল আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবে।

সংস্থাটির পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, এ সফরে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার ও নীতি বিষয়ে আলোচনা করবে।

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। টাকার সাথে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য। ওই সঙ্কট সামলাতেই এখন আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ চাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নেয়ার চেষ্টা চলছে।

অতীতে দেখা গেছে, যেকোনো দেশেই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ নীতিগত কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়ে থাকে। অনেক সময় এমন কঠোর শর্ত দেয়া হয়, যার বাস্তবায়ন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আইএমএফের সাথে এ ঋণের আলোচনা শুরু হয়েছে এমন সময়, যখন দেশ অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটে রয়েছে। অন্যদিকে সামনের বছর রয়েছে সাধারণ নির্বাচন। সেজন্য কঠোর শর্ত দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি সদস্য দেশ। এর আগে একাধিকবার এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে। তবে তা কখনো ১০০ কোটি ডলারের সীমা পার হয়নি।

রেমিটেন্স কম আসা ও রফতানি আয়ের তুলনায় জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি অনেক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়েও দেশটি জটিলতায় পড়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট সামলাতে বাজারে ডলার ছেড়েছে বাংলাদেশে ব্যাংক। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ অক্টোবর দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আরো ঋণ পেতে আলোচনা শুরু করেছে, সেখানেও প্রভাব ফেলতে পারে এ ঋণ। তাই প্রতিনিধি দলের এ সফরকে আইএমএফের শর্তগুলোর প্রতি সরকারের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য ঋণটি জরুরি হলেও সরকারেরও দরকষাকষির সুযোগ রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আইএমএফের এ ঋণটা যে কারণে চাওয়া হয়েছে, ওই কারণগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন যে অবস্থায় আছে, ভবিষ্যতে তা আরো বেশি সঙ্কটাপন্ন হতে পারে। তাই এখনই ঋণটা নিয়ে নিলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা একটা নিরাপত্তা হিসাবে কাজ করবে। তবে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা এখনো বেপরোয়া পর্যায়ে যায়নি। তাই ঋণ নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ আছে।

ধ্যাপক সায়মা হক আরো বলেন, তারা যেসব শর্তের কথা বলে, তার অনেকগুলো আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদরাই বলে আসছেন। সরকার নিজেও সেটার দরকার বোধ করে। যেমন করখাতের সংস্কার। কিন্তু হয়তো নানা কারণে তারা ওইটা বাস্তবায়নে কঠোর হতে পারেনি। এ জাতীয় শর্ত নিয়ে তো আপত্তি নেই। কিন্তু কোনো শর্ত নিয়ে যদি দ্বিমত হতে পারে বলে মনে হয়, সেসব নিয়ে সরকার কিছুটা দর কষাকষি করতে পারে।

যখন কোনো দেশ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা রিজার্ভ নিয়ে সঙ্কটে পড়ে, তখন সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হয়। আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু শর্ত দিয়ে থাকে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, কঠোর শর্তের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ সাধারণত আইএমএফের ঋণ নিতে আগ্রহী হয় না। কারণ এসব শর্ত বাস্তবায়ন করতে দিয়ে অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের ভেতরে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে শর্তের কথা জেনেও অনেক দেশ এখন আইএমএফের ঋণ সহায়তা চাচ্ছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি মনে করি, এসব শর্তের ব্যাপারে কিছুটা হলেও সরকারের সম্মতি আছে। তা না হলে তারা এত দূর যেত না। আইএমএফের স্টেটমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে, তারাও আশাবাদী, এখানে কিছু হবে। সরকারও চাপের মধ্যে আছে। কিছু করতে হলে তাদের দ্রুত করতে হবে। এখানে খুব বেশি দেরি করার সুযোগ সরকারের কাছে নেই।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে এবার রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকলেও আওয়ামী লীগ ঋণটি নিতে চায়। কারণ, খুব না ঠেকলে কোনো দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয় না। বাংলাদেশ এবার বিপদে পড়েছে বলেই তাদের কাছে গেছে। বড় অংকের ঋণ চাচ্ছে। এখন তাদের শর্তগুলো গিলতে হবে। দ্রুত আমাদের রিজার্ভ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সামনে ১৪ থেকে ১৫ মাস পরে নির্বাচন।

তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা যেভাবে হোক, আইএমএফকে খুশি করে ঋণটা পেতে চাইবে। তাদের এটা করতেই হবে। কারণ, যতক্ষণ তারা সরকারে আছে, ততক্ষণ এটা করা ছাড়া তাদের উপায়ও নেই। তবে নির্বাচনের আগে বিরোধীরা এটার সুযোগ নিতে চাইবে। তারা এটার কড়া সমালোচনা করবে। নির্বাচনের আগে এটা নিয়ে একটা উত্তাপ শুরু হবে। যদিও এ পরিস্থিতিতে থাকলে তারাও একই পদক্ষেপ নিত। সরকারে থাকলে এটা করা ছাড়া এখন করার কিছু নেই।’

আইএমএফ কি কি শর্ত দিতে যাচ্ছে, কোন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে, এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পরিষ্কারভাবে কিছু জানানো হয়নি।

সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফ স্টাফ ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টরের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, সেসব সুপারিশ বা শর্ত এবারের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।

এর মধ্যে রয়েছে :
বাংলাদেশের রাজস্ব ও কর নীতির সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে রাজস্ব বাড়াতে হবে। সেজন্য ব্যয়ভার সীমিত করতে হবে এবং ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থায় আমানত ও ঋণের যে সীমা বেধে দেয়া আছে, সেটা তুলে দিতে হবে।

মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন করতে হবে। মুদ্রাবাজারের ওপর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে হবে।
রিজার্ভ যথেষ্ট থাকলেও সেটা সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা ও সতর্কতা নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে বিধিমালার কঠোর বাস্তবায়ন ও নজরদারি জোরালো করতে হবে। বিশেষ করে আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে যাতে খেলাপি ঋণ হ্রাস পায়।

আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা এবং পুঁজিবাজার শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

করোনা ভাইরাসের সময়কার খরচের নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হলেও সেটা প্রকাশ করা উচিত।

রফতানির বহুমুখীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ নেয়া, উৎপাদন বাড়ানো, মানব সম্পদের উন্নয়ন ও দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

জলবায়ু পরিবর্তনে পদক্ষেপ ও তহবিল বরাদ্দে সংস্কার কার্যক্রমেরও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, এর মধ্যে রাজস্ব ও কর খাতের সংস্কার, আমানত ও ঋণের সুদ হারের সীমা তুলে দেয়া, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কয়েকটি শর্ত আইএমএফ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে।

ডলার সঙ্কটের কারণে এরই মধ্যে মুদ্রাবাজারের ওপর থেকে কর্তৃত্ব অনেকটাই তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের পরামর্শ মেনে অতীতে যেমন বাংলাদেশের লোকসানে থাকা পাটকল বন্ধ করা হয়েছিল, তেমনি ভ্যাট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। অর্থনীতির জন্য লাভজনক হলেও ওই সময় এসব সিদ্ধান্তে বিক্ষোভও হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যা জনগণের জন্য ভালো হবে না।

তিনি আরো বলেন, ‘তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কি, আমাদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কোন ধরনের শর্ত দেবেন, সেটা এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে আমরা মনে করি, জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে যেটা ভালো হয়, সরকার ওই রকম সিদ্ধান্তই নেবে।’

হানিফ আরো বলেন, কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি এমন কোনো শর্ত দেয়, যেটা দেশের অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে অথবা জনগণের মধ্যে কষ্ট তৈরি করতে পারে, অবশ্যই সরকার ওই ধরণের কোনো প্রস্তাবে রাজি হবে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দেবে, তার অনেকগুলো বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছুটা সময় পাবে বাংলাদেশ। যেমন রাজস্ব খাতের সংস্কারে হয়তো তিন বা চার বছর সময় পাওয়া যাবে। আবার কিছু কিছু পদক্ষেপ আশু নেয়ার জন্য বলতে পারে সংস্থাটি। যেমন বর্তমানে আমানত ও ঋণে যে ছয় ও নয় শতাংশ সুদের হার রয়েছে, সেটা তুলে দিতে বলতে পারে। এর দ্রুত বাস্তবায়ন চাইতে পারে আইএমএফ। আর্থিক সংস্কার করতে গেলে সেটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হলেও অনেক সময় জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যেখানে সামনের বছর নাগাদ বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানে এসব সংস্কার বাস্তবায়নে কতটা আগ্রহী হবে সরকার।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসলে দেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে এসব সংস্কার করা ছাড়া, আইএমএফের শর্ত মানা ছাড়া সরকারের সামনে বড় কোনো বিকল্প নেই। কারণ, সেটা করতে গেলে শুধু আইএমএফ নয়, বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো অন্য সংস্থাগুলোরও আস্থা হারাবে সরকার। আবার দেশের রিজার্ভ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি আর মুদ্রাবাজারের যে অবস্থা, তাতে সরকারের একার পক্ষে বেশি দিন টেনে নেয়া কঠিন হবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলেন, আইএমএফের শর্ত খুব বেশি কঠোর হলেও তাতে যদি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে, তাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কমে যাবে। ফলে রাজনৈতিক কারণে সাধারণ নির্বাচনের সময় এ নিয়ে আলোচনাও হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলেন, এখনো নির্বাচনের জন্য এক বছরের বেশি সময় বাকি রয়েছে। তার আগেই দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট সামলাতে হবে বর্তমান সরকারকে। একইসাথে সঙ্কট সাথে নিয়ে নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে কিছু সংস্কার করে স্থিতিশীল অর্থনীতিসহ নির্বাচনে যাওয়াই আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিকভাবে বেশি লাভজনক হবে। আওয়ামী লীগ হয়তো ওই পথই বেছে নিয়েছে।

সূত্র : বিবিসি