অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এক মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়!

অর্থবছর শেষ হয়েছে পাঁচ মাস আগে। অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ করেছে গতকাল। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে মোট ব্যয় হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ মাস জুনে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।

শেষ মাসটিতে এ বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের পরও গত অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে সংশোধিত বরাদ্দের ৮৬ দশমিক ১৫ শতাংশে। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে মোট ৬ লাখ ৭১ হাজার ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে পরিচালন খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। পরে বাজেট সংশোধন করে পরিচালন খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৪ লাখ ১৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ব্যয়ের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯০ কোটি টাকায়। গোটা অর্থবছরের পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ২১ কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে সরকারের মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩ কোটি টাকায়।

সরকারের সাবেক অর্থ সচিব এবং সাবেক মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। ফলে জুনে যখন থোক অর্থ পরিশোধ করা হয়, তাতে সরকারের ঋণ ব্যয় বেড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় এরই মধ্যে ঋণ নেয়া হয়ে গেছে কিন্তু সে সময় খরচ তার তুলনায় কম। যদিও এর বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে একটি সঠিক ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। এতে সরকারের ঋণ ব্যয় কমে যাবে এবং একটি কাঠামোর মধ্যে থাকবে।’

আলোচ্য হিসাব বছরে সরকারের মাসপ্রতি ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যয়ের গতি ছিল মন্থর। আর দ্বিতীয়ার্ধে ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এবং অর্থবছরের শেষ মাসে তা এসে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চে। জুনে সরকারের ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে পরিচালন খাতে ৫২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ৯৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন ব্যয় ছাড়াও পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে কিছু কর্মসূচি থাকে যেখানে অর্থবছরের শেষে বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। স্বায়ত্তশাসিত কিছু সংস্থায় জুনে অনুদানের অর্থ দেয়া হয়। সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ জুনে পরিশোধ করা হয়। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যেও কিছু মূলধনি ব্যয় থাকে। সরকারি কেনাকাটার ব্যয়ও এ সময় বেশি হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও বরাবরই জুনে বেশি অর্থ পরিশোধ করা হয়ে থাকে।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি এম মো. আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণত আমাদের দেশে যেটা দেখা যায় যে ‘‌সারা বছর বসে থাকে আর অর্থবছরের শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়ো করে ব্যয় করে। তার ফলে যে উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয় সেগুলোর যথার্থ ব্যবহার হয় না। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পে তো অনেক সময় কাজ না করেই টাকা দেয়া হয়, যাতে করে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটি দেখানো যায়। তা না হলে পরবর্তী সময়ে অর্থ বরাদ্দ কমে যেতে পারে। এখানে সময়মতো ব্যয় করা এবং যে উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হচ্ছে সেটি যাতে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

সরকারের পরিচালন খাতে ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় ঋণের সুদ পরিশোধ ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের সুদ পরিশোধ খাতে ৮৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা। যেখানে ঘোষিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

গত অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ঘোষিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে সংশোধিত বরাদ্দের ৭২ দশমিক ১ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।

সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সার্বিক দুর্বলতার কারণেই এমনটি ঘটে থাকে। অপ্রাসঙ্গিক ব্যয় ও আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রাখাই হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ। একদিকে রাজস্ব আয় আসতে থাকবে এবং অন্যদিকে সেখান থেকে খরচ করা হবে সেটিই হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায় রাজস্ব আয় হচ্ছে না বা হয়নি, কিন্তু খরচ করে যাচ্ছে। আর এ খরচ করতে গিয়ে বিল পরিশোধ করা হয় না কিংবা দেরিতে করা হয়। কারণ রাজস্ব আয় না আসার কারণে এসব বিল আটকে রাখা হয়। পুঞ্জীভূত এসব খরচ মে ও জুন মাসের ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়। এ সময় বর্ষাকাল থাকে। সে সময় এত বেশি খরচ হওয়ার কথা না। কিন্তু আগের মাসগুলোর অপরিশোধিত বিল এ সময় পরিশোধ করা হয় বলে সার্বিকভাবে এ সময়ে বেশি ব্যয় দেখা যায়। তাছাড়া বাজেট সংশোধনের জন্যও অনেক সময় অপেক্ষা করা হয়। ফলে সংশোধিত বাজেট হওয়ার পর ব্যয়ের গতি বাড়ে। অথচ সময়মতো বিল পরিশোধ করা হলে সরকারি ব্যয়ে একটি ধারাবাহিকতা থাকত।’

বাজেট প্রণয়নের শুরুতেই গলদ থেকে যায় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‌আগের বছরের বাজেটের প্রকৃত খরচ এবং সামনের বছরের প্রবৃদ্ধি ধরে বিশ্লেষণ ও হিসাব করেই বাজেট প্রণয়ন করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এগুলো হিসাব না করেই বড় অংকের বাজেট দেয়া হচ্ছে। ফলে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এসে দেখা যায় এটি খরচ করা যাচ্ছে না। তখন সংশোধন করে এর আকার কমানো হয়। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে আগে থেকেই যদি জানা যেত যে কোন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা লাগবে না, তাহলে সেটি অন্য যেসব খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন সেখানে বণ্টন করা যেত। অন্যদিকে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে বাজেটে ঘাটতি থেকে যায়। আর এ ঘাটতি পূরণে সরকারকে ঋণ করতে হয়। এতে ঋণের সুদ বাবদও সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়।’

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা সামান্য কমিয়ে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ হয়। যদিও আলোচ্য অর্থবছরের ১২ মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকায়।

সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হয়েছে, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময় কর-জিডিপি অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশে, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সবসময়ই শুরুর দিকে ব্যয় কম থাকে। এরপর সেটি বাড়তে থাকে এবং জুনের দিকে সবচেয়ে বেশি হয়। এটি ঠিকই আছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও গুণগত মান বজায় থাকছে কিনা সেটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করি। পাশাপাশি গণমাধ্যমের সংবাদও আমাদের জন্য সহায়ক হয়। তবে জনবল কম থাকার কারণে আইএমইডি প্রত্যাশা অনুসারে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর।’

বনিক বার্তা