শিবলী সোহায়েল 6 June 2023
অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের অনেকেরই খুব একটা ধারণা নেই। আমরা অনেকেই জানিনা অস্ট্রেলিয়ার সংসদে বাংলাদেশের শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আলোচনার কথা। জিয়া সম্পর্কে তারা কতটা জানতেন এবং কি ধারণা পোষণ করতেন তাও সবার জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ভ্যালেরি ডি’ইস্টিং থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে ও মুসলিম বিশ্বে জিয়ার ভাবমূর্তি কেমন ছিল সে সম্পর্কে মোটামুটি জানা থাকলেও অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে আমরা প্রায় বেখবর। আজ থেকে ঠিক বিয়াল্লিশ বছর আগে দোসরা জুন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যে আলোচনা হয়েছিল তার বিবরণ থেকে এ সম্পর্কে কিছুটা অবগত হওয়া যায়। সেই আলোচনার কিছু অংশ আজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই প্রথম বাংলাদেশেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় বাহাত্তর সালের চারই এপ্রিল, যুক্তরাজ্য চারই ফেব্রুয়ারি এবং অস্ট্রেলিয়া একত্রিশে জানুয়ারি। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার পর জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্যও অস্ট্রেলিয়া ছিল অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেসময় অস্ট্রেলিয়ার সাহায্য গ্রহীতা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ।
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তখন একাত্তর সালের নভেম্বরের চার তারিখে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই প্রস্তাবে ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের সাহায্যের আবেদন করা হয় এবং পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
বোঝা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান সবসময় বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল এবং অন্যতম দাতা দেশ হিসেবে এদেশের পরিস্থিতির দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে একাত্তর সালে অস্ট্রেলিয়া শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করলেও পঁচাত্তরে তার মর্মান্তিক হত্যা নিয়ে কোন শোক প্রকাশ করেনি। কিন্তু কেন? তারা কি তাহলে শেখ মুজিবের দুঃশাসন সম্পর্কে অবহিত ছিল?
এদিকে উনিশশ একাশি সালে জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর অস্ট্রেলিয়ার সংসদে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করে বক্তব্য রাখেন। এরপর সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদ সদস্য এই শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনা রাখেন। তাদের দীর্ঘ বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কেন জিয়াউর রহমানকে এই সম্মান এবং শেখ মুজিবকে নয়। পাঠকদের সুবিধার জন্য বক্তব্যের কিছু অংশ নিচে বাংলায় উল্লেখ করছি এবং অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের ওয়েবসাইট থেকে মূল আলোচনাগুলোর লিঙ্ক লিখার শেষে যুক্ত করে দিচ্ছি। জিয়া আর্কাইভ নামে একটি ওয়েব সাইট চোখে পড়ল। সুন্দর উদ্যোগ। তবে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে জিয়াকে নিয়ে এই আলোচনার কোন তথ্য সেখানে দেখলাম না। যারা এই আর্কাইভের উদ্যোক্তা তারা নিচের লিঙ্কগুলো থেকে তথ্য নিয়ে আর্কাইভে সংযুক্ত করে নিতে পারেন। ভবিষ্যতে গবেষকদের কাজে লাগবে।
একাশি সালের দোসরা জুন, অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের মাত্র দুই দিন পর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ম্যালকম ফ্রেজার, ফেডারেল পার্লামেন্টে এই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রায় সারে ছয়শ শব্দের এই দীর্ঘ প্রস্তাবে তিনি বলেন, “গত ৩০ শে মে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যিনি ১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তার মৃত্যুতে এই সংসদ গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং তার পরিবার এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে”।
তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিয়ার অবদানের কথা, তিনি বলেন, “প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার একটি প্রধান কারণ ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং এর বিপুল জনসংখ্যার প্রতি তার একনিষ্ঠতা । রাষ্ট্রপতি জিয়াউর খাদ্য ঘাটতি এবং দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। আপনারা অনেকেই জানেন যে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খাদ্য সহায়তা এবং অন্যান্য সহায়তা গ্রহণকারী হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার তালিকায় শীর্ষে ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর এই বছর বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন আগের তুলনায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হন। এটি একটি অসাধারণ রেকর্ড এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে দেশে বিদেশে কোনও প্রচেষ্টাই বাদ রাখেননি …”।
প্রধানমন্ত্রী জিয়াকে শুধু বাংলাদেশের নেতা নয় বরং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি উত্তর-দক্ষিণ বিতর্কের মধ্যে তার মতামতের জন্য সকলের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন এবং ইসলামিক কনফারেন্সের মধ্যে তিনি নিজেকে একজন স্বাধীন ও মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর কমনওয়েলথের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন”।
এরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই বক্তব্যে কমনওয়েলথ রিজিওনাল মিটিং সহ বিভিন্ন সময়ে জিয়ার সাথে তাঁর আলাপ আলোচনার কথা তুলে ধরেন। এবং জিয়ার নির্মম হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকার এবং জনগণ এই ঘটনায় কতটা হতবাক হয়েছেন তা উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, “আমি বহুবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছি। আমি তাকে পছন্দ এবং সম্মান করি। আমি নিশ্চিত যে আজ এই সংসদে, সকল সম্মানিত সদস্যরা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দার প্রস্তাবনাকে সমর্থন করবেন”।
খেয়াল করে দেখুন এগুলো বাংলাদেশের হাই কমিশনার অথবা দলীয় কোন প্রোপাগান্ডা নয়। সরাসরি অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে রেকর্ডকৃত এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। আজকাল তো বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে উঁচু গলায় বলতে শোনা যায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নাকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রোল মডেল হিসেবে দেখেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইটে গেলে এমন কোন বৈঠক বা বক্তব্যের হদিস কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের হাইকমিশনারদেরকে আজকাল দেশের প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে দলীয় কর্মীর মত আচরণ করতে দেখে হতবাক হতে হয়। রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে এধরণের মিথ্যা প্রচারণার আশ্রয় নিতে হয় তা পাঠকরা নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন।
এবারে দেখি ঐদিন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিরোধী দলের নেতা কি বলেছিলেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা উইলিয়াম (বিল) জর্জ হেডেনের কথা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেন শেখ মুজিব নয় জিয়া তাদের কাছে অধিক সম্মানিত। তিনি উল্লেখ করেন, “……… রাষ্ট্রপতি জিয়াউর ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির নায়ক। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনিই প্রথম রেডিওতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি শুধু একজন সৈনিকই ছিলেন না, তার চাইতেও অনেক বড় ছিলেন। …… তিনি শেখ মুজিবুরের একদলীয় শাসনের অবসান ঘটান, ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৭৭ সালে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। ইসলামের প্রতি তার নিজের অঙ্গীকারের প্রতিফলন হিসাবে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কঠোর নীতি বাতিল করলেও ধর্মীয় উগ্রতা ও চরমপন্থাকে প্রশ্রয় দেননি। ……… পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি শেখ মুজিবুর ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে সরে আসেন, তবে কখনো তিনি চরম ভারত-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেননি। … তিনি পশ্চিমের সাথে দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন”।
লক্ষ্য করে দেখুন শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন এবং এই একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রায়নের জন্য তারা জিয়ার প্রশংসা করেন। প্রায় ছয়শ শব্দের এই বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রপতি জিয়াউরকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হবে ‘ট্রিকল-ডাউন ইফেক্ট’ এর মত অর্থনৈতিক দর্শন প্রত্যাখ্যান করার জন্য। … সংক্ষেপে, এই দর্শনটি ছিল একটি উন্নয়নশীল দেশের ধনীরা আরও যত ধনী হবে এর সুফল ততটাই ধীরে ধীরে সমাজের নিচের স্তরগুলোতে পৌঁছবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া এই তত্ত্বকে বাতিল করে তৃণমূল উন্নয়নে নজর দেন। তিনি একটি সুষম ভূমি বণ্টন কর্মসূচি চালু করেছিলেন। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অর্থায়ন ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন যাতে করে ১৯৮১-৮২ সালের মধ্যে বাইরে থেকে খাদ্য সহায়তার ৪০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব হয়। , গুরুতর জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং অর্থায়ন করেন। ……… তিনি তার দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং ক্ষুদ্রতম গ্রামগুলিতে অবিরাম ভ্রমণ করেছিলেন, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে উৎসাহ ও শক্তি সঞ্চার করেছিলেন……”।
জিয়ার ভূমিকার এমন যথাযথ বর্ণনা আমি দেশের বিশিষ্টজনদের কাছ থেকেও পাইনি। তাই এই বক্তব্যগুলো এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করলাম। তাছাড়া দেশের মানুষের কাছ থেকে তো জিয়ার অবদানের কথা শুনেই থাকি, এবার অস্ট্রেলিয়ানদের মুখ থেকেও শোনা হল। শুধু অস্ট্রেলিয়াই নয় জিয়া যেখানেই গেছেন কাজের কথা বলেছেন, আর যাদের সাথেই কথা বলেছেন তাদেরকেই তিনি তাঁর দূরদর্শিতা ও কাজের মাধ্যমে মুগ্ধ করেছেন। তাই জিয়া শুধু দেশেই নয় বিশ্বেও আজো সমাদৃত।
লেখক: ডেপুটি এডিটর, আমার দেশ। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি একজন লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।