অর্থ পাচারের অর্থনীতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : মানিলন্ডারিং বা অর্থ পাচার প্রত্যেক দেশের জন্যই জাতীয় জটিল সমস্যা। বিশেষ করে যে সব দেশ বৈদেশিক মুদ্রা ও বিনিয়োগের সঙ্কটে ভোগে তাদের জন্য মানিলন্ডারিং বহুমুখী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। যে দেশে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব সেসব অর্থনীতি মানিলন্ডারিংয়ের কারণে বেশি সমস্যায় পড়ে। কারণ পুঁজি সঙ্কটগ্রস্ত দেশ থেকে টাকা যদি বিদেশে চলে যায় তাহলে উন্নয়নঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। বোঝা যায় ওই দেশ পুঁজি ধরে রাখতে পারছে না। পুঁজি ধরে রাখতে না পারার কারণে তাদের সব সময়ই প্রয়োজনীয় পুঁজির জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে। পুঁজিস্বল্পতার দেশ থেকে মানিলন্ডারিং বা পুঁজি পাচারের অর্থই হচ্ছে অর্থনীতির জন্য ইন্টারনাল হ্যামারেজ বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, যা সেই অর্থনীতির রেজিলিয়েন্ট পাওয়ারকে দুর্বল বা অক্ষম করে দিতে পারে। জাপান বা আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বা মানিলন্ডারিং হলে তাদের হয়তো খুব একটা ক্ষতি হয় না। কারণ এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সক্ষমতা তাদের আছে। তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি আছে। তবুও সেসব দেশে মানিলন্ডারিং কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে মানিলন্ডারিং হলে সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয় না। কষ্টার্জিত কিংবা দুর্নীতিজাত কিংবা ব্যাংক থেকে ক্ষমতা খাটিয়ে জালিয়াতি করে নেয়া যে টাকা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হতে পারত সেই অর্থ বিদেশে বিনিয়োগে ব্যবহৃত হতে দেয়াটাই আত্মঘাতী।

অর্থ পাচারের মতো ঘটনা কখন ঘটে? যখন কোনো দেশে অবৈধ বা অস্বচ্ছভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে সেই টাকা ব্যবহারের অবাধ সুযোগ নেই তখনই ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার হয়। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীরা যদি তাদের অর্থ অভ্যন্তরীণভাবে বিনিয়োগ বা ব্যবহারের সুযোগ পায় বা ব্যবহারে বাধ্য থাকে তাহলে পাচারের সম্ভাবনা কম থাকে। যে দেশে পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে অবৈধ অর্থ অর্জনের সুযোগ কম এবং পাচারের ও বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ কম সেই দেশ থেকে সাধারণত অর্থ পাচার হয় না। যেহেতু অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ কর দফতরের কাছে ঘোষণা দেয়ায় কর পরিশোধের সমস্যা, যেহেতু সামাজিকভাবে তা প্রকাশ ও গ্রহণযোগ্য নয়, যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন তারা সেই অর্থ ব্যবহারের জন্য বিদেশে পাচার করেন। আবার এমন দেশ আছে যেখানে বিদেশ থেকে অর্থ আহরণকে (তাদের ভাষায় ফরেন ইনভেস্টমেন্ট) অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়, সেখানে উৎস দেশের সেই অর্থ বৈধ কি অবৈধ তা নিয়ে তারা ভাবে না। সে নিরিখে মানিলন্ডারিং এবং অর্থ পাচার ঠেকাতে হলে বিশে^র সবগুলো দেশকে একযোগে উদ্যোগ নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো একক দেশের পক্ষে অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব নয়।

দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ যদি ভালো থাকে তাহলে অর্থ পাচার সচরাচর কম হয়। মূলত এবং মুখ্যত বাংলাদেশের মতো দেশে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ অবারিত থাকা, ব্যাংক লুট করার সুযোগ থাকা এবং বিনিয়োগের অনুকূল ও কার্যকর পরিবেশ না থাকার কারণেই অর্থ পাচার হয়। অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অবৈধভাবে অর্জিত টাকা আছে কিন্তু সঙ্গত কারণে সেই টাকা বিনিয়োগ করা হয় না বা যায় না। ফলে মানিলন্ডারিং বাড়ছেই। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উপায় উৎসমুখে বন্ধ না হলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ অর্থবহ হবে না। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যৌথভাবে চেষ্টা করলেই মানিলন্ডারিং এবং মুদ্রা পাচার কমানো বা থামানো সম্ভব হতে পারে। কোনো দেশ থেকে যাতে মুদ্রা পাচার এবং মানিলন্ডারিং হতে না পারে তার ব্যবস্থা যেমন সেই দেশকে করতে হবে, তেমনি যে দেশে মুদ্রা পাচার হয়ে যাবে সেই দেশেরও উচিত হবে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা তাদের অর্থনীতিতে প্রবেশ ও ব্যবহার হতে না দেয়া। কোনোভাবে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা চলে গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশেও সেই টাকা ফেরত দানের ব্যবস্থা থাকা দরকার। কাজেই যে দেশ থেকে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয় এবং পাচারকৃত মুদ্রা যে দেশে যায় উভয় দেশকেই এটি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা (গ্লোবাল প্রোগ্রাম এগেইনস্ট মানিলন্ডারিং) আছে, বাংলাদেশও ইউএনের সে ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ পাচার পরিমাণ ও প্রকারে বেড়ে যাওয়ায় দেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে আয়-বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার চিত্র ও চরিত্র যেমন ফুটে উঠছে, তেমনি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলায় সামাজিক শক্তির তথা সহন ক্ষমতার (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) অবক্ষয়, নৈতিক মূল্যবোধের বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। করোনার কারণে যেমন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। করোনাকালীন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোও সঙ্কুুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যাপকভাবে কর্মী ছাঁটাই করেছে। ব্যয় সঙ্কোচনের লক্ষ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে অথবা কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমিত হয়েছে, প্রতিনিয়তই দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীতে দেশে বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে যাবে। বিদেশ থেকে অনেকেই কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও বেকার সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলছেন। বেকার সমস্যা বেড়ে গেলে দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে বা পাবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা দেশে ফিরে আসার ফলে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতিতে। প্রথমত, তারা দেশে ফিরে আসার কারণে বেকার সমস্যা তীব্রতর হবে। একই সাথে তারা যে রেমিট্যান্স পাঠাতেন তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আগামীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে যে উন্নয়নের ধারা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল তার পেছনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করত। আগামীতে তা অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে। করোনার কারণে মানুষের হাতে অর্থ কমে যাওয়ার কারণে তারা এখন সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।

অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে বর্তমানে একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত অপারগতা ও আয়-বৈষম্যের কারণে কিছু লোকের ক্রয়ক্ষমতা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর বিপরীতে সীমিত আয়ের মানুষদের ক্রয়ক্ষমতা প্রচণ্ডভাবে সঙ্কুুচিত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতিতে তাদের জীবন ধারণ, যাপন ও অবলম্বন দুরূহ ও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে বৈশি^ক সমস্যা হিসেবে দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাত নির্মাণ চলছে। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে হাতে জমানো অর্থ ব্যয় করে পরিবারের ভরণপোষণ করতে হচ্ছে। আর্থিক সামর্থ্যও কমে গেছে। তাই তারা চাইলেও আগের মতো পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে পারবেন না। সবচেয়ে অসুবিধায় রয়েছেন ইনফরমাল সেক্টরের মানুষরা যারা শহর ও গ্রামে বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট দোকান দিয়ে তার আয় থেকে সংসার চালাতেন তারা। তারা ক্রমেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এক সময়ে ছোট ব্যবসায়ের মাধ্যমে তাদের সংসার চালাতেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তাদের অনেকেই আর আগের ব্যবসায় ফিরে আসতে পারবেন না। কারণ তারা ইতোমধ্যেই সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য সঞ্চিত ব্যবসায়ের পুঁজি খুইয়ে বসেছেন। তাদের যদি প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহ করা না যায় তাহলে তাদের পক্ষে আর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা কোথা থেকে প্রয়োজনীয় পুঁজি পাবেন সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজি বিদেশে পাচার হয়েছে বা হচ্ছে নানা পন্থায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরের সাথে পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত ছিলেন তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্তরাও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ কমে গেলে সম্পৃক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা একটি সিস্টেমের মধ্যে ছিলেন। সেই আর্থসামাজিক সিস্টেম ভেঙে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কাঁধে দায় চাপিয়ে বা চাপানোয় তাদের ক্ষতিকর প্রভাব আলোচনায় প্রধানত অর্থনৈতিক ক্ষতিকে খণ্ডিত আকারে সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রচলিত সামাজিক সম্প্রীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি কিভাবে বা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা তেমন আলোচনায় আসে না; বরং ভেদবুদ্ধি জ্ঞানে মনুষ্যসৃষ্ট এই অচলাবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার প্রয়াসকে স্থিতিশীলতা নষ্টের নামাকরণে অন্যায়-অনিয়ম অবৈধ কার্যক্রম আরো অব্যাহত থাকুক সে ব্যাপারে যুক্তি তোলা হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রচলিত আর্থসামাজিক অবস্থা ব্যবস্থা অত্যন্ত মানবিক ও সহানুভূতিসম্পন্ন। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসবেন এটিই চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। একজনের আনন্দে অন্যজন আনন্দিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির গজেন্দ্রগামিতায় ক্রমান্বয়ে সেই সামাজিক অবস্থান, অন্তর্ভুক্তিমূলক থাকছে না। মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতে ফ্যাসিলিটেটর নিজেই বাদ সাধছে, বঞ্চিত করতে বরং ভক্ষকের ভূমিকায়। সিন্ডিকেট ও নিয়ন্ত্রকের প্রশ্রয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনের উদগ্র প্রবণতায়, অর্থবাজারের অর্থ লোপাট ও পাচারের মতো আত্মঘাতী দুরারোগ্য ব্যাধি সেই সামাজিক শক্তিকে আরো বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে। দ্রব্য ও সেবামূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদ ও দাবি তোলার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে একত্র হতে বাধা দিচ্ছে সিন্ডিকেটেড শক্তি। এটিই বিশ্লেষণযোগ্য যে, পরিস্থিতি কতটা অসহায়ত্বের দিকে কিভাবে ধাবিত হচ্ছে। ইতিবাচকতা থেকে নেতিবাচকতার দিকে অগ্রসর হওয়া মানে নেতিবাচকতার পুনর্বাসন। সঙ্কট সন্ধিক্ষণে ইতিবাচক, সমন্বয়ধর্মী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

নয়াদিগন্ত